ড. সাইমুম পারভেজ
প্রকাশ : ০৬ মে ২০২৫, ১২:০০ এএম
আপডেট : ০৬ মে ২০২৫, ০৮:২৯ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ

সংস্কার হওয়া উচিত নির্বাচিত সরকারের হাতে

সংস্কার হওয়া উচিত নির্বাচিত সরকারের হাতে

ড. সাইমুম পারভেজ বিএনপি চেয়ারপারসনের পররাষ্ট্রনীতিবিষয়ক বিশেষ সহকারী; অসলোর নরওয়েজিয়ান স্কুল অব থিওলজি, রিলিজিয়ন ও সোসাইটির জ্যেষ্ঠ গবেষক (সহযোগী অধ্যাপক)। বাংলাদেশের সাম্প্রতিক রাজনৈতিক পরিস্থিতি, বিএনপির অবস্থান, আগামী নির্বাচন, নির্বাচনে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের প্রভাবসহ নানা বিষয়ে কালবেলার সঙ্গে কথা বলেন তিনি

কালবেলা: গত এক বছরে দেশের রাজনীতি অভূতপূর্ব পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে গেছে। গণঅভ্যুত্থান, আওয়ামী লীগ সরকারের পতন, অন্তর্বর্তী সরকারের দেশ পরিচালনা এবং ছাত্রদের নতুন রাজনৈতিক দল গঠনসহ অনেক কিছু হয়েছে। এই মুহূর্তে একদিকে আওয়ামী লীগ নিষিদ্ধের দাবি; অন্যদিকে নির্বাচন নিয়ে অস্পষ্টতা, সবমিলে রাজনৈতিক পরিস্থিতি নিয়ে আপনার মূল্যায়ন কী?

সাইমুম পারভেজ: ইতিহাস খুঁজলে দেখা যায়, বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক পথযাত্রায় অনেক ধরনের বাঁকবদল ঘটেছে। আমরা এখন একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ সময় পার করছি। আজ থেকে হয়তো ১০ বা ২০ বছর পর আমরা এ সময়ের গুরুত্বটা বুঝতে পারব। গত বছরের জুলাই-আগস্টে ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে একটি ফ্যাসিস্ট সরকারের পতন ঘটেছে। ফলে দেশে একটি নতুন দিগন্তের সূচনা হয়েছে। তবে এখনো আমাদের অভীষ্ট লক্ষ্যে পৌঁছতে পারিনি। লক্ষ্যে পৌঁছানোর যাত্রা যতটা সহজ হওয়ার কথা ছিল, তা হচ্ছে না। আমরা দেখেছি অন্তর্বর্তী সরকারকে প্রথমে সব রাজনৈতিক দল এবং গণতন্ত্রের পক্ষের শক্তিগুলো মিলে সমর্থন দিয়েছে। এখন দেখতে পাচ্ছি, সেটাকে পুঁজি করে সরকারের একটি অংশ ক্ষমতা দীর্ঘায়িত করার চেষ্টা করছে। মনে রাখতে হবে, অন্তর্বর্তী সরকারকে জনগণ দায়িত্ব দিয়েছে একটি নির্দিষ্ট সময়ের জন্য, দীর্ঘস্থায়ী বা অনির্দিষ্ট সময়ের জন্য নয়। যত তাড়াতাড়ি নির্বাচনের একটি সুনির্দিষ্ট তারিখ ঘোষণা হবে, ততই সবার জন্য মঙ্গল হবে।

সংস্কার ও নির্বাচনকে সাংঘর্ষিকভাবে নেওয়া হয়েছে। অনেকে বলার চেষ্টা করছেন, একটি নির্বাচিত সরকার এলে আর সংস্কার হবে না। কিন্তু সংস্কার একটি চলমান প্রক্রিয়া। আপনি কখনোই কয়েক মাস বা এক বছরের মধ্যে কোনো সুনির্দিষ্ট এবং পূর্ণাঙ্গ সংস্কার করতে পারবেন না। সংস্কার যেহেতু একটি রাজনৈতিক প্রক্রিয়া, তাই সেটি রাজনৈতিক দলের মাধ্যমেই হতে হবে। সুতরাং আমরা এই অন্তর্বর্তী সময়ে কোন কোন বিষয়ে আমাদের সংস্কার প্রয়োজন, সে বিষয়ে একটি ঐকমত্য তৈরি করতে পারি। কিন্তু সংস্কার হওয়া উচিত নির্বাচিত সরকারের হাত ধরে।

কালবেলা: প্রশ্ন উঠছে, ১৯৯১ সালে একবার সংস্কারের চেষ্টা করা হয়েছিল কিন্তু সেটা কাজ করেনি। এবারও নির্বাচনের মাধ্যমে যে সরকার আসবে তারা সংস্কার করবে তার নিশ্চয়তা কী? এ প্রশ্নটি সামনে রেখেই অন্তর্বর্তী সরকার চাইছে কিছু সংস্কার করে যেতে। আপনি এ বিষয়টা কীভাবে দেখেন?

সাইমুম পারভেজ: সবকিছুতে শেষ পর্যন্ত গণতন্ত্রের শক্তির জয় হতে হবে। অর্থাৎ একটি গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার সৌন্দর্য হচ্ছে জনগণের হাতে এর ক্ষমতা থাকা। আলোচনার খাতিরে যদি ধরে নিই, বিএনপি আগামী নির্বাচনের মাধ্যমে সরকার গঠন করবে। তারপর বিএনপি যদি তার প্রতিশ্রুত সংস্কার না করে তাহলে জনগণের হাতে ক্ষমতা আছে পাঁচ বছর পর বিএনপিকে আর ভোট না দেওয়ার। মানুষ তখন নতুন সরকারকে ক্ষমতায় নিয়ে আসবে। অর্থাৎ আমরা যে সংস্কারের কথা বলছি, সেই সংস্কার এমন একটি রাজনৈতিক ব্যবস্থা তৈরি করবে যাতে রাজনৈতিক দল এবং রাজনীতিবিদদের একটি জবাবদিহি তৈরি হয়। সেটুকু সংস্কার অবশ্যই করা দরকার।

আপনি যদি রাজনীতিবিদ এবং রাজনৈতিক দলগুলোকে অবিশ্বাস করেন তাহলে সেটা বিরাজনীতিকরণকে উৎসাহিত করা হবে। বিরাজনীতিকরণকে উৎসাহিত করা হলে সেটা রাজনীতিবিদদের বৈধতা চ্যালেঞ্জ করবে। অর্থাৎ যেখানে সমস্যা সেখানেই আমাদের সমাধান খুঁজতে হবে। সমস্যা যদি রাজনীতিবিদদের বা রাজনৈতিক সিস্টেমের হয় তাহলে সেই সিস্টেমটি পরিবর্তন করা এবং জবাবদিহির সম্মুখীন করার ব্যবস্থা করতে হবে। কিন্তু রাজনীতিবিদদের সাইডলাইনে রেখে সংস্কার করা হবে এবং পরবর্তীকালে রাজনীতিবিদরা সে সংস্কার অনুযায়ী চলবেন সেটা সঠিক হবে না। অনির্বাচিত সরকার যদি পূর্ণাঙ্গ সংস্কার করে দেন এবং ভবিষ্যৎ ক্ষমতায় আসা রাজনীতিবিদরা যদি সেই সংস্কারের সঙ্গে একমত না হন তাহলে তারা আবার তাদের মতো করে সাজাবে।

কালবেলা: সংস্কার কেন রাজনৈতিক সরকারের হাতেই হতে হবে? অন্তর্বর্তী সরকারও তো সংস্কার সম্পন্ন করে যেতে পারে?

সাইমুম পারভেজ: একেকটি শ্রেণি বা পেশার একেকটি কাজ রয়েছে। আপনার জ্ঞান থাকতে পারে, আপনি একজন উচ্চশিক্ষিত হতে পারেন, কিন্তু যে পেশার যে লোক তাকে সেটা করতে দিতে হবে। আমরা এ সিস্টেম তৈরি করেছি যে, গণতান্ত্রিক পথযাত্রায় রাজনীতিবিদরাই দল পরিচালনা করবেন, সেইসঙ্গে রাষ্ট্রও পরিচালনা করবেন।

আপনার যত বড় ডিগ্রি থাকুক, যতই আন্তর্জাতিক গ্রহণযোগ্যতা থাকুক, আপনাকে কিন্তু মাটি ও মানুষকে বুঝতে হবে। আপনাকে দেশের রাজনৈতিক প্রেক্ষিত বুঝতে হবে। আপনাকে দেশের ইতিহাস বুঝতে হবে এবং বাংলাদেশের মাটি ও মানুষের সঙ্গে কোন রাজনীতি বেশি গুরুত্বপূর্ণ এবং খাপ খাবে সেটা বুঝতে হবে। এসব বোঝাপড়া কার সবচেয়ে বেশি? এ বোঝাপড়া বেশি যারা মাটি ও মানুষের সঙ্গে মিশে থাকেন সেই রাজনীতিবিদের। আমি আপনি রাজনীতিবিদদের অপছন্দ করতে পারি। আমি তাদের দুর্নীতিবাজ বলতে পারি, বলতে পারি যে তারা আমাদের আশা-আকাঙ্ক্ষার সঠিক প্রতিফলন ঘটাননি। কিন্তু এটাই সত্য, দিনশেষে তারাই সাধারণ মানুষের সঙ্গে থাকেন। তারা ২৪ ঘণ্টা একটি পেশা পালন করেন, যে পেশা সবসময় সাধারণ মানুষকে যুক্ত রাখে।

সবচেয়ে দুর্নীতিবাজ রাজনীতিকেরও একটি ফলোয়ার গ্রুপ থাকে। তারও কিছু মানুষকে উপকার করার ধারা রয়েছে। মানুষের সঙ্গে তার চলাফেরা রয়েছে বলেই তিনি রাজনীতিবিদ। ফলে একটি দেশ পরিচালনা করার জন্য যারা দায়িত্বপ্রাপ্ত, যাদের এ অধিকার রয়েছে এবং সেটা তাদের পেশা, তাদেরই আমাদের রাষ্ট্র পরিচালনায় আনতে হবে। সুতরাং এখন তাদের সঠিকভাবে পরিচালনা করবেন কি না, তাদের জবাবদিহির আওতায় আনবেন কি না এবং তাদের এক ধরনের মনিটরিংয়ের মধ্যে রাখবেন কি না, সেটাই আমাদের দায়িত্ব। এটাই সিভিল সোসাইটির দায়িত্ব। এটা রাজনীতির বাইরের মানুষদের দায়িত্ব। দিনশেষে দেশ পরিচালনা করতে হবে রাজনীতিবিদদের মাধ্যমেই।

কালবেলা: স্বাধীনতার ৫৩ বছর অতিক্রান্ত হয়েছে। আমাদের যতটুকু অর্জন তার বেশিরভাগ রাজনীতিবিদদের হাতেই হয়েছে। কিন্তু এটাও দেখা গেছে, আদর্শনির্ভর রাজনীতির চেয়ে স্বার্থনির্ভর রাজনীতিই বেশি হয়েছে। বহুবার প্রচেষ্টা চালানো হয়েছে এ ধারা পরিবর্তনের, কিন্তু সেটা সম্ভব হয়নি। এখান থেকে বের হওয়ার জন্য আপনার পরামর্শ কী?

সাইমুম পারভেজ: গত ১৫ বছরে বাংলাদেশ এমন একটি সময় পার করেছে, যা এর আগে সেভাবে আসেনি। এখানে রাজনীতিবিদরা খুন হয়েছেন, গুম হয়েছেন, মিথ্যা মামলা ও হয়রানির শিকার হয়েছেন। অনেকে তাদের এলাকা ছাড়তে বাধ্য হয়েছেন, অনেকে আবার দেশ ছাড়তে বাধ্য হয়েছেন। অনেকে শহরে লুকিয়ে থেকে রিকশা চালিয়ে দিনানিপাত করেছেন, অনেক পরিবার নষ্ট হয়েছে। এই ত্যাগ ও বঞ্চনা যদি তারা মনে রাখেন, তাহলে হয়তো এ দেশের রাজনীতি অন্যরকম হবে। আমরা এরই মধ্যে তার কিছু প্রতিফলন দেখতে পাচ্ছি।

বাংলাদেশে অনেক বিষয়ে রাজনৈতিক-অরাজনৈতিক পক্ষগুলোর মধ্যে দ্বিমত রয়েছে। এখানে বড় রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে রয়েছে—বিএনপি, জামায়াতে ইসলামী, এনসিপি এবং বামপন্থি ও ধর্মভিত্তিক কিছু দল। এ রাজনৈতিক শক্তিগুলোর মধ্যে অনেক বিষয়ে দ্বিমত লক্ষ করা যাচ্ছে, আবার অনেক বিষয়ে তারা একমতও। যেমন—এতদিন নির্বাচন এবং তত্ত্বাবধায়ক সরকার প্রশ্নে একটি সন্দেহের দোলাচল ছিল। কিন্তু এখন প্রায় সব রাজনৈতিক দলই চায় তত্ত্বাবধায়ক সরকার থাকবে। তিনটি রাজনৈতিক দলই চায় যে কোনো মূল্যে একটি সুষ্ঠু নির্বাচন করতে হবে। তারা সবাই চায় দেশের পররাষ্ট্রনীতি হবে শিরদাঁড়াসম্পন্ন। সবাই চাই জনগণের ম্যান্ডেট মেনে নির্বাচন। ফলে অনেক দ্বিমতের ভিড়েও কিছু ঐকমত্য আমরা দেখতে পাচ্ছি।

রাজনীতি সবসময় আদর্শভিত্তিক হওয়ার দরকার নেই। রাজনীতি যদি র‌্যাশনাল বা যৌক্তিক হয়, একটা দল যদি ক্ষমতা আসার জন্য সুস্থ নির্বাচন এবং দেশ পরিচালনার অন্যান্য ব্যবস্থা অনুসরণ করে এবং মেনে চলে, তাহলে আমরা একটি সুস্থ ব্যবস্থাপনা দেখতে পাব।

কালবেলা: রাষ্ট্র সংস্কার প্রশ্নে বিএনপির অবস্থান কী, বিএনপি কী ধরনের সংস্কার চিন্তা করছে?

সাইমুম পারভেজ: ২০১৬ সালে খালেদা জিয়া ভিশন ২০৩০ ঘোষণা করেন। এ ভিশন ২০৩০ নিয়ে বাংলাদেশের বিভিন্ন জেলায় যাওয়া হয়, সিভিল সোসাইটির সঙ্গে আলোচনা হয়। কিন্তু সেটা মিডিয়ায় সেভাবে আসেনি। কারণ সে সময় মিডিয়ার ওপর এক ধরনের নিষেধাজ্ঞা ছিল, মিডিয়াকে নিয়ন্ত্রণ করা হচ্ছিল। ২০২১ সালে বিএনপি ২৭ দফা ঘোষণা করে। এরপর শরিক দলগুলোর সঙ্গে বসে, সবার মতামত নিয়ে বিএনপি ৩১ দফা ঘোষণা করে। যদিও আমরা এটিকে বিএনপির ৩১ দফা বলি, কিন্তু প্রকৃতপক্ষে এটি শুধু বিএনপির ৩১ দফা ছিল না। এটা ছিল সব শরিক দলের মতামতের ওপরে ভিত্তি করে তৈরি করা ভিশন। বিএনপি এবং অন্যান্য শরিক দলের সমন্বিত রাষ্ট্র সংস্কারের/মেরামতের পরিকল্পনা। ২০২৩ সালে বিএনপি ৩১ দফা ঘোষণার পর থেকে এখন পর্যন্ত তারা বিভিন্ন পর্যায়ে নিয়মিত ওয়ার্কশপ ও সেমিনার আয়োজন করছে এবং সেই ওয়ার্কশপগুলোতে তারেক রহমান নিজে উপস্থিত থাকছেন। অনলাইনে যুক্ত থেকে তিনি মানুষের প্রশ্নের উত্তর দিচ্ছেন অর্থাৎ তিনি ওপরে সীমাবদ্ধ না থেকে নিচে যাওয়ার চেষ্টা করছেন। সাধারণ জনগণের কাছে পৌঁছানোর চেষ্টা করছেন। অনেক সময় সাধারণ মানুষের চাওয়াকে ভিত্তি করে তিনি গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। বিএনপি এখনো ৩১ দফা উন্মুক্ত রেখেছে, তারা বলছে এটা ফাইনাল কোনো কিছু নয়। বরং এটাকে আমরা আরও পরিমার্জন করতে পারি, নতুন করে সংযোজন করতে পারি। দলীয়ভাবে বিএনপির আধুনিকীকরণ শুরু হয়েছে। বিএনপির রাজনীতির মধ্যে জনগণের কথাকে গুরুত্ব দেওয়ার প্রবণতা আমরা আশাব্যঞ্জকভাবে দেখতে পাচ্ছি। কতটুকু সফলতার মাধ্যমে এটা আমরা পালন করতে পারব সেটা সামনের দিনগুলোতে বোঝা যাবে।

কালবেলা: এখন রাজনীতিতে মতামত তৈরির ক্ষেত্রে ডিজিটাল প্ল্যাটফর্ম একটি বড় ভূমিকা রাখছে। বিভিন্ন ক্ষেত্রে সোশ্যাল মিডিয়ার একটি বড় প্রভাব কাজ করছে। এর ভালো ও মন্দ দিকগুলো কী দেখছেন এবং আগামীর রাজনীতিতে এটি কেমন ভূমিকা রাখবে বলে মনে করেন?

সাইমুম পারভেজ: বর্তমানে পৃথিবী একটি হাইব্রিড মিডিয়ার যুগ। এই হাইব্রিড ওয়ার্ল্ডের একদিকে অনলাইন মিডিয়া রয়েছে, অফলাইন মিডিয়া রয়েছে এবং পাশাপাশি রয়েছে সোশ্যাল মিডিয়া। এই প্রত্যেকটা মিডিয়ার আবার একটির সঙ্গে আরেকটির ওভারল্যাপিং রয়েছে। তাই অনলাইন ও অফলাইন ওয়ার্ল্ডকে আলাদাভাবে বিশ্লেষণ না করাই ভালো। বরং এ দুটি মিলে একটি নতুন পৃথিবী তৈরি করেছে, সেই বাস্তবতাটা আমাদের বুঝতে হবে। আমরা দেখতে পাচ্ছি, বর্তমান সময়ে ভার্চুয়াল মিডিয়া সরাসরি ভোটের রাজনীতিতে বড় ভূমিকা না রাখলেও মানুষের জনমত তৈরির ক্ষেত্রে বড় ভূমিকা রাখছে। বিশেষ করে আরবান মিডিল ক্লাস মানুষের মতামত প্রভাবিত করতে বেশ কিছু স্বাভাবিক যোগাযোগমাধ্যমের সেলিব্রেটিরা বড় ভূমিকা রাখছেন।

কিন্তু একটি বিষয় মনে রাখতে হবে, অনলাইনে মতামত তৈরি এবং এর প্রভাব খুব ক্ষণস্থায়ী। কারণ সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম নিজেই ক্ষণস্থায়ী একটি মাধ্যম। আমি আপনি যখন সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে একটি স্টোরি বা একটি তথ্য শেয়ার করি সেটার মেয়াদ মাত্র কয়েক ঘণ্টা। তারপর প্ল্যাটফর্মের অ্যালগরিদম অনুযায়ী সেটা পেছনে পড়ে যায় যদি সেটা ভাইরাল না হয়। ভাইরাল হলে সেটা বারবার রিপ্রডিউস হয়। এখানে একটি মজার বিষয় হলো, একটি কনটেন্ট ভাইরাল হলে আগের ভাইরাল কনটেন্টটি আর সামনে থাকে না। অর্থাৎ একটি দিয়ে আরেকটি ঢাকা পড়ে যায়।

কালবেলা: বিএনপি ক্ষমতায় এলে দেশের প্রেস ফ্রিডম কেমন হবে? মানুষ কি নির্বিঘ্নে তাদের মতামত প্রকাশ করতে পারবে?

সাইমুম পারভেজ: আমরা বিএনপির পক্ষ থেকে সবসময় প্রেস ফ্রিডমের কথা বলেছি। আমরা বলছি যে, ডিজিটাল সিকিউরিটি অ্যাক্টের মতো এরকম কোনো নিপীড়নমূলক আইন আমরা করব না। আমরা বলছি, র‍্যাবের মতো নিপীড়নমূলক কোনো বাহিনী থাকবে না। আমরা এমন একটি বাংলাদেশ তৈরি করব যেখানে রাজনীতিবিদদের নামে কার্টুন ছাপলে তার বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হবে না। আমরা আগের বিএনপির আমলেও এই চর্চা দেখেছি। বিএনপি ক্ষমতায় থাকাকালে বিএনপির নেতৃত্ব এবং নেতাদের নিয়ে গণমাধ্যমে অহরহ কার্টুন ছাপা হয়েছে। বিএনপি কখনো সেগুলোতে বাধা দেয়নি। আমরা সামনেও বাধা দেব না কারণ এটাই গণতন্ত্রের সৌন্দর্য।

কিন্তু এটাও সত্য, এরকম শিথিলতা ও স্বাধীনতাকে অনেকে মিস ইউজ করতে পারে। এটা এমনভাবে ব্যবহার করতে পারে যেটা রাষ্ট্রের নিরাপত্তা ও স্থিতিশীলতা নষ্ট করে। ফলে আমাদের এ দুটির মধ্যে এক ধরনের ব্যালান্স তৈরি করতে হবে। আমরা মনে করি কনটেন্টের জবাব কনটেন্ট দিয়েই দেওয়া উচিত। অর্থাৎ আমাদের প্রচুর ইতিবাচক ও রাষ্ট্রের গঠনমূলক কনটেন্ট রেডি করে ভ্রান্ত ন্যারেটিভগুলো মোকাবিলা করতে হবে। ন্যারেটিভের যুদ্ধ ন্যারেটিভ দিয়েই হতে হবে। আওয়ামী লীগ ন্যারেটিভের যুদ্ধ বন্দুক দিয়ে করার চেষ্টা করেছিল। ফল কী হয়েছে সেটা আমরা দেখেছি। বিএনপি মানুষের বাক স্বাধীনতা রক্ষা করতে চায়।

কালবেলা: ৫ আগস্টের পর ধর্মভিত্তিক রাজনৈতিক দলগুলোর কার্যক্রম বাড়তে দেখা যাচ্ছে। বাংলাদেশের ভোটের রাজনীতিতে ধর্মের প্রভাব কতটুকু দেখছেন?

সাইমুম পারভেজ: ভোটের রাজনীতিতে আসলে ধর্মের প্রভাব কতটুকু সেটা বোঝা যাবে ভোটের পরেই। কারণ, গত তিনবার এমন সাজানো নির্বাচন হয়েছে যেখানে কোনো রাজনৈতিক দল কত ভোট পাচ্ছে বা জনগণের সমর্থন কতটুকু পাচ্ছে সেটা বোঝার কোনো উপায় ছিল না। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ধর্মভিত্তিক রাজনৈতিক দলগুলো একটি বিস্তৃত এবং এক ধরনের শক্তিশালী উপস্থিতি লক্ষ করা যাচ্ছে। এটা দেখে মনে হতেই পারে যে তাদের জনসমর্থন আগের থেকে বেড়েছে। তবে আমি এখনো নিশ্চিত নই। আসলে সাধারণ মানুষের মধ্যে তাদের জনভিত্তি রয়েছে কি না, সেটা নির্বাচনের আগে বোঝা সম্ভব নয়।

কালবেলা: গত সরকারের আমলে বিরোধী দলগুলোকে এমনভাবে দমনপীড়ন করা হয়েছিল যে, তারা নির্বাচনও বয়কট করতে বাধ্য হয়। এ সময় আমরা গৃহপালিত বিরোধী দল নামে একটি টার্মও মানুষের মুখে শুনেছি। বাংলাদেশের নতুন রাজনৈতিক বাস্তবতায় বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর কি প্রধান বিরোধী দল বা ক্ষমতায় যাওয়ার সম্ভাবনা আছে বলে মনে করেন?

সাইমুম পারভেজ: আগামী যে নির্বাচিত সরকার বাংলাদেশের দায়িত্ব গ্রহণ করবে আমার মনে হয় তারা বাংলাদেশের ইতিহাসে অন্যতম সুষ্ঠু একটি নির্বাচনের মাধ্যমে বিজয়ী হয়ে দায়িত্ব গ্রহণ করবে। একটি সুস্থ নির্বাচনের মাধ্যমে দায়িত্ব গ্রহণ করা সরকার বিগত ফ্যাসিস্ট সরকারের ছেড়ে যাওয়া নীতি গ্রহণ করবে না বলেই আমরা আশা করব। সে কারণে গৃহপালিত বিরোধী দল বলে কিছু থাকবে না। যারা বিরোধী দল তারা বিরোধী দলই থাকবে। তারা সম্মানের সঙ্গেই বাংলাদেশের রাজনীতি করবে। আমাদের মনে রাখতে হবে ডামি প্রার্থী এবং ডামি নির্বাচনের সে সময় থেকে বাংলাদেশ বেরিয়ে এসেছে।

কালবেলা: নির্বাচন নিয়ে বিএনপির অবস্থান কী? বিএনপি কবে এবং কখন নির্বাচন চাইছে?

সাইমুম পারভেজ: বিএনপির শীর্ষ নেতৃবৃন্দ বারবার বলেছেন, তারা দ্রুত নির্বাচন চান। তারা বলেছেন, অন্তর্বর্তী সরকারকে অনির্দিষ্টকালের জন্য শর্তহীন সমর্থন দেওয়া সম্ভব নয়। এ কারণে এখনই একটি নির্বাচনের তারিখ ঘোষণা করতে হবে। নির্বাচনের রোডম্যাপ কখনো ছয় মাসব্যাপী হয় না। একটি নির্দিষ্ট তারিখ জানাতে হবে যে এদিন নির্বাচন হবে। নির্বাচনের একটি রোডম্যাপ থাকবে যেখানে তপশিল ঘোষণার তারিখ, মনোনয়ন জমাদানের তারিখ এবং নির্বাচনের তারিখ সবকিছু পরিষ্কার থাকবে।

সরকার যুক্তি দিচ্ছে, নির্বাচনের জন্য তারা পুলিশ ও প্রশাসনকে প্রস্তুত করতে পারেনি। কিন্তু এই বিষয়টার সঙ্গে আমরা একমত নই। সরকার যদি পুরো দেশ পরিচালনা করতে পারে তাহলে একটা দিনে নির্বাচন কেন পরিচালনা করা যাবে না! সরকারের উচিত অবশ্যই ডিসেম্বরের মধ্যে নির্বাচন অনুষ্ঠিত করা এবং ডিসেম্বরের কত তারিখে নির্বাচন হবে সেটা এখনই ঘোষণা দেওয়া।

শ্রুতিলিখন: মুজাহিদুল ইসলাম

কালবেলা অনলাইন এর সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিডটি অনুসরণ করুন

মন্তব্য করুন

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

ইতিহাস গড়ল এশিয়াটিক মাইন্ডশেয়ার

মুশফিকুল ফজল আনসারীর বাবা মারা গেছেন 

শক্তিশালী সেই দেশের প্রেসিডেন্টকে কৃতজ্ঞতা জানাল পাকিস্তান

ছেলের চুরির অভিযোগে মাকে নাকে খত, বিএনপি নেতা গ্রেপ্তার

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের জন্মদিন আজ

জামায়াত নেতা এটিএম আজহারের আপিল শুনানি শুরু

দেশ ছাড়লেন সাবেক রাষ্ট্রপতি আবদুল হামিদ

আবারও ভারত-পাকিস্তানের ব্যাপক গোলাবর্ষণ

ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠিত হলে ভবিষ্যতে জালিম আর ফিরবে না : জামায়াত আমির

পারমাণবিক যুদ্ধ বাধতে পারে, হুঁশিয়ার করলেন পাকিস্তানের প্রতিরক্ষামন্ত্রী

১০

আশুলিয়া ভূমি অফিসে স্বচ্ছ সেবায় নতুন দৃষ্টান্ত স্থাপন করলেন এসিল্যান্ড সাদিয়া আক্তার

১১

অসময়ে পানি বৃদ্ধি, যমুনার গর্ভে ১০ বসতভিটা

১২

দুপুর ১টার মধ্যে ৬০ কিমি বেগে ঝড়ের পূর্বাভাস

১৩

ব্যারিস্টার আব্দুর রাজ্জাকের কবর জিয়ারতে জামায়াতের আমির

১৪

গাজীপুরে দুই সাংবাদিকের নামে অপপ্রচারের অভিযোগ

১৫

ভারতে ইরানের পররাষ্ট্রমন্ত্রী, সম্পর্ক জোরদারের বার্তা

১৬

শিথিল ‘শাটডাউন’ / আজ খুলছে পলিটেকনিকের তালা

১৭

শেখ হাসিনার ব্যক্তিগত কর্মকর্তা মিজান গ্রেপ্তার

১৮

লাহোরের ওয়ালটন রোডে একাধিক বিস্ফোরণ 

১৯

রাষ্ট্র গঠনে তরুণদের জায়গা করে দিতে হবে : সেলিমা রহমান

২০
X