মানুষের সবচেয়ে বেশি উপকার করা পশুর অন্যতম গরু। বাংলা পড়াতে গিয়ে বাল্যকালে গরুর রচনা লিখতে দিতেন পাঠশালার গুরু ও শিক্ষকরা। কারও কারও জীবনে গরু দিয়েই রচনা লেখার শুরু। সেখানে গরুর উপকারের কথা লিখতে কেউ ছিল না ভীরু। অথচ এ ছাত্রছাত্রীরা বড় হলে তাদের মধ্যে নানা রূপক অর্থে গরু নিয়ে রং-তামাশা হয় শুরু।
কোরবানির আগে ‘বিরাট গরু ছাগলের হাট’ লেখা ব্যানার দেখে অভ্যস্ত অভিজ্ঞজনের চোখ। অথচ ইদানীং শোনা যায় এখানেও নাকি মাঝারি ও ছোট গরু-ছাগলরা বৈষম্যের শিকার। বাজারে মাঝারি ও ছোট সাইজের গরু-ছাগলের সংখ্যা বেশি হলেও কেন লেখা হবে ‘বিরাট গরু-ছাগলের হাট’?
আসলেই তো! হাটে সাজানো সব গরু-ছাগল তো বিরাট নয়।
তাহলে বিরাট গরু-ছাগলের হাট বলা হবে কেন? তবে সুখের কথা হলো, শাহবাগে অবরোধ ও রাজপথে আন্দোলন ছাড়াই পরিবর্তন আনা হয়েছে ব্যানারে। ‘বিরাট গরু-ছাগলের হাট’-এর বদলে গেটে ও ব্যানারে লেখা হয়েছে—‘গরু-ছাগলের বিরাট হাট’। এরপর কোনোরকম থামল গরু-ছাগলের হাটের ব্যানার নিয়ে গৃহযুদ্ধ।
কোরবানির গরু-ছাগল বড় না ছোট, সে প্রশ্ন ছাপিয়ে গত বছর বড় প্রশ্ন হয়ে ওঠে গরু বা ছাগলের বংশ পরিচয়। উচ্চবংশীয় হলেই গরু বা ছাগলের দাম উঠে যেত সাধারণ বা যৌক্তিক দামের কয়েকগুণ বেশি। আর বংশ নির্বাচনের একমাত্র কর্তৃত্ব ছিল রাজধানীর মোহাম্মদপুরের একটি প্রতিষ্ঠানের ওপর। দেশের কোথাও তাদের কোনো শাখা ছিল না।আপিল করার মতো কোনো উচ্চতর প্রতিষ্ঠানও ছিল না। তাই তাদের বাজারজাত করা উচ্চবংশীয় একটি ছাগলের মূল্য নির্ধারিত হয় ১৫ লাখ টাকা।
অর্থনীতিতে দাম বাড়লে চাহিদা কমে, এমন তত্ত্বের বিপরীত তত্ত্ব হলো—আভিজাত্য প্রমাণ ও প্রকাশ করে, এমন বিলাসবহুল পণ্যের ক্ষেত্রে দাম বাড়লেও চাহিদা বাড়ে। এ তত্ত্ব প্রমাণ করতে সেই উচ্চবংশীয় ছাগল কিনতে হুমড়ি খেয়ে পড়ে তথাকথিত ওপরতলার মানুষরা। এমন ইঁদুর দৌড়ে শেষ পর্যন্ত জিতে যায় ১৯ বছরের এক যুবক। এরপর একই ফ্রেমে বন্দি হয় উচ্চবংশীয় ছাগল এবং ছাগলটির ক্রেতা ও বিক্রেতা। সুপার ডুপার ভাইরাল হয় সেই ছবি। তবে সেই ছবি দেখে জনমনে প্রশ্ন ওঠে—‘কোনটি ছাগল?’
ছাগল ক্রেতা ছিলেন এক বিস্ময় যুবক। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের সব চোখ, লেন্স, দুরবিন ও স্যাটেলাইট খুঁজতে থাকে কে ছাগল কেনা গর্বিত এই যুবক? চার পায়ের ছাগল কি আর দুই পায়ের মানুষের চোখ দুটিকে ফাঁকি দিতে পারে? ঠিকই বেরিয়ে পড়ে ছাগলের অবস্থান এবং ছাগল ক্রেতার পরিচয়। বাংলাদেশের জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের এক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তার সন্তান ১৫ লাখ টাকায় এই ছাগল ক্রয় করেন বাবাকে উপহার দেওয়ার জন্য। ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা এই বাবা তার প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে দেশের বাইরে থেকে আসা সব গরু-ছাগলের ওপর কর আদায় করতেন। তা ছাড়া কোরবানির হাট ও পশুর হাটে যত গরু-ছাগল বিক্রি হয়, তার হাসিলের ওপর এবং কোরবানির পশুর হাট ইজারার জন্য যে দাম ওঠে, তার ওপর কর আদায়ের দায়িত্বও এ কর্মকর্তার প্রতিষ্ঠানের। সুতরাং এমন কর্মকর্তার সুপুত্র বাবার জন্য একটি সুদর্শন ছাগল তো কিনতেই পারেন? কিন্তু বেরসিকজনের প্রশ্ন যুবকের আয়ের উৎস কী? এমন প্রশ্ন কেন্দ্র করেই ছাগল নিয়ে শুরু হয় পাগল-কাণ্ড। কিছুদিন দৌড়ের ওপর থাকেন সেই রাজস্ব কর্মকর্তা। আর জুলাই বিপ্লবের পর তিনি লাপাতা হয়ে যান। তবে ইদানীং রাজস্ব ভবনে লেজেগোবরে অবস্থা সৃষ্টি করে তিনি নাকি আবারও স্বপদে ফিরে আসার পথ খুঁজছেন হারিয়ে যাওয়া গরু খোঁজার মতো। পারেন তো এখনই যেন গরুর শিং দিয়ে গুঁতিয়ে ফেলে দিতে চান রাজস্বের বড় মিয়াকে।
অন্যদিকে ছাগল তো ছাগলই। তার কি আর বদনামের শেষ আছে? কেউ একটু বেশি কথা বললেই বলা হয়, ছাগলের মতো বকবক করো কেন? ভুল হলে বলে ছাগল নাকি, এত ভুল করো? একটু তৃপ্তি করে খেলেই শুনতে হয় ছাগলের মতো সারা দিন মুখ চলে কেন? গায়ে ঘাম জমলেই খোঁটা দেয় ছাগলের গায়ের গন্ধ বলে। স্বাস্থ্য একটু ভালো হলেই শুনতে হয় ‘যেন আস্ত খোদার খাসি!’ এমন কত কিছু নিয়েই যে চলে কেবল হাসাহাসি।
তবে ছাগলের একটা দুঃখও আছে। কথায় কথায় বলা হয়—‘পাগলে কি না করে ছাগলে কি না খায়?’ অথচ কেউ বুঝতে চায় না পাগল অনেক কিছুই করে না। যেমন কোনো পাগল কখনো হিসু করে প্রতিপক্ষকে ভাসিয়ে দেওয়ার হুমকি দেয় না। কোনো পাগল নিজে নিজে ভোটের তারিখ নির্ধারণ করার বয়ান দেয় না। তবুও শুনতে হয় পাগলে কি না বলে। অন্যদিকে ছাগলের দুঃখ আরও বেশি। ছাগল ঘুষ খায় না। অথচ ঘুষ খাওয়া মানুষরাই নিম্নপদবির কর্মচারীদের মুখ বন্ধ রাখতে ছাগল বললে তাচ্ছিল্য করে। ছাগল মদ খায় না, গাজা খায় না, ইয়াবা খায় না, ফেনসিডিল খায় না, চাঁদা খায় না, কমিশন খায় না—তবুও শুনতে হয় ছাগলে কি না খায় প্রবাদ।
ছাগলের তুলনায় বেশি উপকার করেও শান্তিতে নেই গরু। ক্লাসের দুর্বল ছাত্রকে গরু বলতেই পছন্দ করেন নির্দয় শিক্ষকরা। অথচ তারাই বলেন, কত গরু পিটিয়ে মানুষ করলাম, তোকে কিছু করতে পারলাম না। যে বা যারা বাংলাদেশ ব্যাংকের টাকা চুরি করে, তারা হয়ে যান মহামান্য হ্যাকার। অথচ গরু চুরি করলেই যেন যত সমস্যা। ‘গরু চোর’ যেন পৃথিবীর নিকৃষ্ট মানুষ। ১০০ বছর আগেও কেউ গরু চুরি করে থাকলে তার বংশের কারও বিয়ের সময় সেই প্রসঙ্গ চলে আসে। এমন গরু চোরের চেয়ে সুব্রত বাইনও যেন ভালো।
ষাঁড় গরুকে আরও নাদুসনুদুস করতে লিঙ্গান্তর ঘটানো হয়। এতে লিঙ্গের পরিবর্তন হলেও ষাঁড়ের মগজ, বুদ্ধি বা ব্রেনের কোনো কিছুরই পরিবর্তন করা হয় না। অথচ লিঙ্গান্তরিত ষাঁড় অপারেশন শেষ হলেই হয়ে যায় ‘বলদ’। যেন অপারেশন করে তার সব বুদ্ধি ফেলে দেওয়া হয়েছে। বোকাসোকা ছাত্র আর কম মেধার কর্মচারীকে ‘বলদ’ বলে মনে শান্তি পান কেউ কেউ। অনেকে আবার অন্যকে বলেন ‘আবাল’! অথচ সারা দিন তিনিই বকেন আবোল-তাবোল।
সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে অনেকের মতো গরুও ভাইরাল হয়। বিশেষত প্রতি বছর কোরবানির আগে বিশাল বিশাল গরু নিয়ে মেতে ওঠে একশ্রেণির ইউটিউবার। এসব গরুর ‘হাম্বা’ ডাক নিয়ে শুরু হাম্বিতাম্বি। মানুষ গরু আকিকা দিয়ে বাচ্চাদের নাম রাখে। আর ইউটিউব প্রেমিকরা আকিকা ছাড়াই গরুর নাম রাখে। সুলতান, কিং, বাহাদুর, টাইগার, রাজা, বাদশা, সম্রাট, লাদেন, মানিক, রতন, কালা মানিক, লাল বাদশা, মাস্তান, টিপু সুলতান, মেসি, বুলেট, মিসাইল, রোনালদো, বস, মহারাজ, জাঁহাপনা, সাদ্দাম, গাদ্দাফি ইত্যাদি। দেশ-বিদেশের কিছু নায়ক ও ভিলেনের নামেও গরু আছে। তবে নিরাপদে আছেন নায়িকা ও খলনায়িকারা। এ নিয়ে লিঙ্গবৈষম্য ও ইভটিজিংয়ের মামলা করতে পারে ষাঁড় ও বলদের দল।
তবে এসব নামকরা গরুর নাকি এবার খবর আছে। গত বছরের ভাইরাল ছাগল-কাণ্ডের পর এবার নাকি বড় গরুর দুই পাশে বসে আছেন রাজস্ব বিভাগ ও দুদকের সদাজাগ্রত কর্মীরা। কারও হাতে হারিকেন, কারও হাতে বাঁশ। ভাইরাল বড় গরু কিনলেই ক্রেতার আয়ের উৎস, আয়কর বিবরণী, ঢাকায় বাড়ির ঠিকানা, ব্যাংকের জমা ইত্যাদি নিয়ে শুরু হবে ড্রামা। ধরা পড়লে নাই ক্ষমা। আমার সম্পাদক বলেন, আর লিখিস না, কলম এবার থামা। এর চেয়ে বেশি লিখলে গায়ে থাকবে না জামা। এসব গরুর পেছনে আরও আছে তোরই চাঁদাবাজ মামা।
লেখক: মেজর (অব.), গবেষক, বিশ্লেষক ও কলামিস্ট
ইমেইল: [email protected]
মন্তব্য করুন