সাইদুর রহমান সাঈদ
প্রকাশ : ১৮ জুলাই ২০২৫, ১২:০০ এএম
আপডেট : ১৮ জুলাই ২০২৫, ০৭:৪৭ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ
চারদিক

চাঁদাবাজ নিয়ন্ত্রণে যা দরকার

চাঁদাবাজ নিয়ন্ত্রণে যা দরকার

জুলাই-গণঅভ্যুত্থান পরবর্তী ছাত্র-জনতার ও রাজনৈতিক দলগুলোর সম্মতিতে অন্তর্বর্তী সরকার গঠিত হয়। নতুন বাংলাদেশ গড়ার প্রত্যয় নিয়ে এ সরকার এরই মধ্যে প্রায় সাড়ে ১১ মাস সময় পার করেছে। দেশের ক্রান্তিকালে সরকারকে অর্থনৈতিক, রাজনৈতিকসহ নানা জাতীয় ও আন্তর্জাতিক ইস্যু নিয়ে বিভিন্ন সমস্যা মোকাবিলা করতে হচ্ছে। সরকার দায়িত্ব গ্রহণের পর থেকে তাদের কিছু ক্ষেত্রে ইতিবাচক সাফল্য থাকলেও ব্যর্থতাও দৃশ্যমান। বিশেষ করে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি শুরু থেকেই টালমাটাল অবস্থায় রয়েছে।

পূর্ববর্তী ফ্যাসিস্ট সরকার পুলিশ-র্যাব তথা আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যদের দিয়ে রাজনৈতিক নেতাকর্মীদের দমনপীড়ন করতে গিয়ে চরম বিতর্কিত করে তোলে। ফলে জুলাই জাগরণের দিনগুলোতে পুলিশ-র্যাবসহ আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর প্রতি সাধারণ জনমনে চরম ক্ষোভ ও অসন্তোষ সৃষ্টি হয়। আন্দোলনের চূড়ান্ত মুহূর্তে পুলিশের মনোভাব ভেঙে পড়ে। বাহিনী হিসেবে সাধারণ জনতার বিরুদ্ধে দাঁড়ানোর কারণে পুলিশ ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর অনেক সদস্য গ্রেপ্তার, মামলা-হামলার শিকার হন। অনেকেই চাকরি ত্যাগ এবং দেশত্যাগ করেন। অনেকেই কারাগারে আটক আছেন, অনেকেই আত্মগোপনে চলে যান। ফলে একটি পেশাদার বাহিনীতে জুলাইয়ের গণঅভ্যুত্থান বিরাট প্রভাব ফেলে। পুলিশ বাহিনীর মনোবল ভেঙে পড়ে এবং দেশজুড়ে নানা বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি হয়, যা সরকার নানাভাবে চেষ্টা করেও পুরোপুরি সফল হতে পারেনি। যার ফলে এখনো পরিস্থিতি স্থিতিশীল বা স্বাভাবিক হয়নি।

আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর দুর্বলতার সুযোগে মানুষ আইন নিজের হাতে তুলে নিয়ে ব্যাপকমাত্রায় মব জাস্টিসের সূত্রপাত ঘটায়। দেশের নাজুক সময়ে নানা অপরাধ মাথাচাড়া দিয়ে ওঠায় তা নিয়ন্ত্রণ করা আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর জন্য বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়ায়। বর্তমানে দেশের বিভিন্ন স্থানে মব, চাঁদাবাজি ও দখলবাজি কেন্দ্র করে একের পর এক চাঞ্চল্যকর ও নির্মম হত্যাকাণ্ড সংঘটিত হচ্ছে। পাশাপাশি দেশের বিভিন্ন স্থানে নারী নির্যাতন ও ধর্ষণের ঘটনাও লক্ষ করা যাচ্ছে। এসব ঘটনা সংবাদমাধ্যম ও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে প্রকাশিত হলে জনমনে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে। সরকার এসব অপরাধ নিয়ন্ত্রণে আপ্রাণ চেষ্টা করলেও পুলিশ এবং আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর প্রো-অ্যাকটিভ প্রচেষ্টার অভাবে প্রত্যাশিত সফলতা এখনো আসেনি।

দেশের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি স্থিতিশীল করতে অন্তর্বর্তী সরকার গঠনের পরপরই পুলিশের পাশাপাশি সেনাবাহিনীকে নির্বাহী ক্ষমতা প্রদান করা হয়। কয়েক দিন পরিস্থিতি কিছুটা নিয়ন্ত্রিত থাকলেও দীর্ঘমেয়াদে টেকসই ও দৃশ্যমান উন্নতি দেখা যাচ্ছে না। এ ক্ষেত্রে দেশে শান্তি-শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে নাগরিক অধিকার বিষয়ে সবার মধ্যে সচেতনতা তৈরি। এ লক্ষ্যে পুলিশ ও জনগণকে নিয়ে গঠিত কমিউনিটি পুলিশিং ব্যবস্থা উল্লেখযোগ্য ভূমিকা পালন করতে পারে।

বাংলাদেশে ২০০০ সালে কমিউনিটি পুলিশিং ব্যবস্থা চালু হলেও নগ্ন দলীয়করণ, অবহেলা ও দক্ষতা-ঘাটতির কারণে এ মহৎ উদ্যোগ কার্যকরভাবে বাস্তবায়িত হয়নি। অথচ কমিউনিটি পুলিশিং একটি অংশগ্রহণমূলক পদ্ধতি, যেখানে পুলিশ ও জনগণ একসঙ্গে অপরাধ দমন ও প্রতিরোধে কাজ করে। এর মূল উদ্দেশ্য হলো—স্থানীয় জনগণের সক্রিয় অংশগ্রহণের মাধ্যমে সমাজে শান্তি ও শৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠা।

এ ব্যবস্থার আওতায় ওয়ার্ড, ইউনিয়ন, থানা, জেলা ও সিটি করপোরেশন পর্যায়ে কমিটি গঠন করে মাদক, নারী ও শিশু নির্যাতন, ইভটিজিং, ধর্ষণ, কিশোর গ্যাংসহ অন্যান্য সামাজিক অপরাধ প্রতিরোধে জনসম্পৃক্ত কার্যক্রম পরিচালনার কথা ছিল। কিন্তু বাস্তবে এসব কমিটির অনেকগুলোই অকার্যকর বা কেবল কাগজে-কলমে সীমাবদ্ধ রয়ে গেছে।

বর্তমানে দেখা যাচ্ছে, মব বা সংঘবদ্ধ জনতা অপরাধীকে নিজ হাতে বিচার করছে, যা দেশের আইন ও শৃঙ্খলার জন্য অত্যন্ত বিপজ্জনক বার্তা বহন করে। চাঁদাবাজি ও দখলবাজির মতো অপরাধে সাধারণ মানুষের জীবন ও সম্পদ হুমকির মুখে পড়ছে। এ পরিস্থিতিতে কমিউনিটি পুলিশিং ব্যবস্থাকে নতুন করে ঢেলে সাজানো জরুরি। পুরোনো নিষ্ক্রিয় কমিউনিটি পুলিশের কমিটিগুলো ভেঙে দিয়ে নতুন করে কার্যকর ও নিরপেক্ষ কমিটি গঠন করা দরকার। প্রতিটি ওয়ার্ড, ইউনিয়ন, থানা, জেলা ও সিটি করপোরেশন পর্যায়ে সমাজের বিভিন্ন শ্রেণির প্রতিনিধি যেমন—শিক্ষক, তরুণ, ধর্মীয় প্রতিনিধি, সচেতন রাজনৈতিক ব্যক্তি এবং সুশীল সমাজের সদস্যদের অন্তর্ভুক্ত করে কমিউনিটি পুলিশিং কমিটি গঠন করা প্রয়োজন। সেইসঙ্গে সংশ্লিষ্ট থানার একজন দায়িত্বশীল অফিসারকে নির্দিষ্ট এলাকাভিত্তিক দায়িত্ব দিয়ে কমিটির সঙ্গে সমন্বিতভাবে কাজ করার ব্যবস্থা করতে হবে। এ ছাড়া প্রতি পাক্ষিক বা মাসিক ভিত্তিতে এলাকাভিত্তিক জনসচেতনতামূলক সভা, সেমিনার ও মুক্ত আলোচনার আয়োজন করা যেতে পারে, যেখানে স্থানীয় জনগণ ও তরুণ সমাজকে সম্পৃক্ত করে অপরাধ প্রতিরোধে সচেতনতা সৃষ্টি করা হবে। পাশাপাশি স্কুল, কলেজ, মাদ্রাসা ও ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানেও এসব অপরাধের ভয়াবহতা এবং সামাজিক পরিণতি নিয়ে আলোচনা করা হলে, সমাজে ব্যাপক সচেতনতা সৃষ্টি হবে। বিশ্বের অনেক দেশ কমিউনিটি পুলিশিংয়ের মাধ্যমে অপরাধ দমনে উল্লেখযোগ্য সফলতা অর্জন করার নজির রয়েছে। সুতরাং, সরকার ও প্রশাসন আন্তরিকভাবে চাইলে এবং এ ব্যবস্থাকে কার্যকরভাবে সক্রিয় করলে মব, চাঁদাবাজি ও দখলবাজির মতো রাষ্ট্র ও সমাজবিরোধী কার্যক্রম অনেকাংশেই নিয়ন্ত্রণে আনা সম্ভব। সমাজে শান্তি ও শৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠায় কমিউনিটি পুলিশিং হতে পারে একটি কার্যকর ও টেকসই পথ।

সাইদুর রহমান সাঈদ

শিক্ষার্থী, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়

কালবেলা অনলাইন এর সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিডটি অনুসরণ করুন

মন্তব্য করুন

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

ঢাকায় বৃষ্টি নিয়ে আবহাওয়া অফিসের নতুন বার্তা

১৯ জুলাই : কী ঘটেছিল ইতিহাসের এই দিনে

শনিবার রাজধানীর যেসব এলাকার মার্কেট বন্ধ

১৯ জুলাই : আজকের নামাজের সময়সূচি

স্ত্রীকে তালাক দিয়ে ২৫ কেজি দুধ দিয়ে গোসল 

সেনাবাহিনীর হাতে ইয়াবাসহ পুলিশ সদস্য আটক 

ইবি ছাত্রের রহস্যজন্যক মৃত্যুর তদন্তের দাবিতে ছাত্রশিবিরের টর্চ মিছিল

বাঙলা কলেজ শিক্ষার্থী শহীদ সাগরের মৃত্যুবার্ষিকী আজ

কেশবপুরে ৩১ দফার প্রচারণায় বিএনপির কেন্দ্রীয় নেতা অমলেন্দু দাস অপু

মাদ্রাসা টিকে আছে বলেই আমাদের ওপর বিভিন্ন ঝড় ঝাপটা আসে : ধর্ম উপদেষ্টা 

১০

ইউনিভার্সিটি ইনোভেশন হাব স্বপ্ন গড়ার সূতিকাগার

১১

রাজবাড়ী জেলা ছাত্র কল্যাণ পরিষদ বাঙলা কলেজ শাখার কমিটি গঠন

১২

গণঅভ্যুত্থান মেহনতি মানুষের কষ্ট লাঘব করেনি : সাইফুল হক 

১৩

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রশিবিরের সাবেক সাধারণ সম্পাদকের ফেসবুক পোস্ট

১৪

মাদকাসক্ত যুবককে পিটিয়ে হত্যা করল মা ও ভাই

১৫

এবার পুলিশের সামনেই চাপাতি দেখিয়ে ছিনতাইয়ের ভিডিও ভাইরাল 

১৬

বৃষ্টির দেখা নেই, আমন চাষে বিপাকে কৃষক

১৭

প্রাথমিকে বৃত্তি পরীক্ষায় কারা সুযোগ পাবে, বাছাই হবে যেভাবে

১৮

হাসপাতালের লিফটের নিচে পড়ে ছিল রোগীর অর্ধগলিত লাশ

১৯

পরিবারের সবাই ইয়াবা বিক্রেতা, অতঃপর…

২০
X