প্রতি বছর বর্ষা মৌসুমে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের উপকূলীয় জনপদ। জলবায়ু পরিবর্তনজনিত প্রভাবে বারবার এ অঞ্চলের ওপর দিয়ে বয়ে যাচ্ছে ঘূর্ণিঝড় এবং জলোচ্ছ্বাস। একটানা বৃষ্টির ফলে নদীর পানি বৃদ্ধি পেয়ে বেড়িবাঁধ ছাপিয়ে যাচ্ছে। এতে উপকূল রক্ষা বাঁধে দেখা দিচ্ছে ভাঙন। ফলে বছরের এ সময় এলেই সংশয় আর উৎকণ্ঠা নিয়ে দিন কাটছে উপকূলবর্তী মানুষের। উপকূলের মানুষ দীর্ঘদিন ধরে প্রকৃতির সঙ্গে সংগ্রাম করে টিকে আছে এ জনপদে। কিন্তু বারবার উপকূল ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ায় একটি সময় গিয়ে অনেকে স্থানত্যাগ করে অন্যত্র পাড়ি দিচ্ছে। এতে দেখা দিচ্ছে পারিবারিক, সামাজিক সমস্যাসহ নানা সংকট। এ বছর বৃষ্টি মৌসুমে উপকূলে বড়সড় কোনো ঘূর্ণিঝড়ের প্রভাব না পড়লেও, সাম্প্রতিককালে সাতক্ষীরার আশাশুনিতে কপোতাক্ষ নদের বেড়িবাঁধ ও তালা উপজেলার শাহাজাতপুর গ্রামে কপোতাক্ষের বেড়িবাঁধে ফাটল দেখা দিয়েছে। ফলে জোয়ারের পানি বৃদ্ধি পেয়ে যেকোনো সময় বেড়িবাঁধ ভেঙে গিয়ে বিস্তীর্ণ এসব এলাকা প্লাবিত হতে পারে। এজন্য উপকূলীয় জনপদের মানুষ এখন দুশ্চিন্তার মধ্যে দিয়ে দিন পার করছে। এ সমস্যা থেকে মুক্তি পেতে উপকূলের মানুষ এক যুগেরও বেশি সময় ধরে আন্দোলন-সংগ্রাম করে আসছে। কিন্তু তাদের এ চিৎকার, আর্তনাদ সরকারের নীতিনির্ধারণী মহল পর্যন্ত পৌঁছেও পৌঁছাচ্ছে না। ফলে বারবার প্লাবিত হয়ে তাদের স্বাভাবিক জীবনযাপন বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। দেশের অনান্য অঞ্চলের থেকে উপকূলীয় জনপদের মানুষ কয়েক বছর পিছিয়ে যাচ্ছে। তাই তাদের দিকে সরকারের সংশ্লিষ্ট দপ্তরের জরুরি ভিত্তিতে নজর দেওয়া প্রয়োজন। উপকূলের এসব সংকট মোকাবিলায় উপকূলীয় বোর্ড গঠন করলে অনেক সমস্যার সমাধান হবে বলে আশা করা যায়।
বর্ষা মৌসুম এলেই এ অঞ্চলের মানুষের হাহাকার শুরু হয়। ঘূর্ণিঝড়ের প্রভাব একটু পড়তেই ঘরবাড়ি ছেড়ে তাদের আশ্রয় নিতে হয় সাইক্লোন সেন্টারে। সেখানেও খাবার কিংবা স্বাস্থ্যসম্মত টয়লেটের সংকট লেগেই থাকে। এদিকে সারা বছর নিরাপদ খাবার পানি থেকে বঞ্চিত হয় তারা। সাধারণত উপকূলবর্তী বেশিরভাগ মানুষ পুকুরের পানি খেয়ে বেঁচে থাকে। কিন্তু ঘূর্ণিঝড় বা নদীর লোনাপানি বৃদ্ধি পাওয়ায় যখন পুকুর ডুবে যায় তখন তাদের খাবার পানির তীব্র সংকট দেখা দেয়। সরকার প্রতি বছর এ সংকট মোকাবিলায় নানা উদ্যোগ গ্রহণ করে। কিন্তু তা কোনোভাবেই ফলপ্রসূ হচ্ছে না। ফলে সরকারের কোটি কোটি টাকার প্রকল্প ভেস্তে যাচ্ছে। নানা সংকটের কথা বলে বছরের পর বছর পানি উন্নয়ন বোর্ড দিন পার করে দেয়। ভাঙন দিয়ে পানি ঢোকার পর তারা জিও বস্তা আর কয় কোদাল মাটি দিয়ে বেড়িবাঁধ সংস্কার করতে তোড়জোড় শুরু করে দেয়। কিন্তু বছর না পার হতেই সেই ভাঙা জায়গার আশপাশ দিয়ে আবার বাঁধে ভাঙন দেখা দেয়। এভাবে দায়সারা ফাটল সংস্কারের কাজ করে কোনোভাবেই উপকূলীয় জনপদ বাঁচিয়ে রাখা যাবে না। এজন্য জরুরি ভিত্তিতে উপকূলে টেকসই বেড়িবাঁধ নির্মাণ করতে হবে। পাশাপাশি উপকূলের মানুষের জীবনমানের উন্নয়ন ঘটাতে সরকারকে আরও গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে।
বিগত দুই দশকে প্রাকৃতিক দুর্যোগে সবচেয়ে বেশি বিধ্বস্ত হয়েছে দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের উপকূলীয় জনপদ। নদীর পানি বৃদ্ধি, ঘূর্ণিঝড় ও জলোচ্ছ্বাসে বারবার ভেঙেছে উপকূল রক্ষায় নির্মিত বেড়িবাঁধ। এসব জনপদে আঘাতহানা আইলা, সিডর, আম্পানে ক্ষতিগ্রস্ত মানুষ আজও ঘুরে দাঁড়াতে পারেনি। তার ওপর প্রতি বছর বর্ষা মৌসুমে নদীর পানি বৃদ্ধি পেয়ে কোথাও না কোথাও ভেঙে যায় এই বাঁধ। ফলে সংকট যেন তাদের পিছে লেগেই থাকে। তা ছাড়া দেখা যায়, উপকূলের অনেক বেড়িবাঁধ মূল সড়কের পাশে রয়েছে। সেখানে যদি ভাঙন দেখা দেয় তাহলে সেই ভাঙন সংস্কারে সমস্যা আরও ঘনীভূত হয়। কারণ পানি উন্নয়ন বোর্ড (পাউবো) এবং স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদপ্তর (এলজিইডি) তারা একে অন্যকে দোষারোপ করতে থাকে। এজন্য সরকারের এসব দায়িত্বপ্রাপ্ত দপ্তরগুলোর সমন্বয় করা জরুরি। অনেক সময় কর্তৃপক্ষের স্বজনপ্রীতির জন্য টেকসই বাঁধ নির্মাণের ক্ষেত্রে ঠিকাদাররা অনিয়ম-দুর্নীতি করে থাকে। তাদের বিরুদ্ধেও কঠোর অবস্থান গ্রহণ করতে হবে। বেড়িবাঁধ ভেঙে যাওয়ার পর না গিয়ে ফাটল দেখা দেওয়ার সঙ্গে সঙ্গে বাঁধ সংস্কার করার বিষয়ে পানি উন্নয়ন বোর্ডের আরও বেশি দায়িত্বশীল ভূমিকা রাখতে হবে। পাশাপাশি টেকসই বেড়িবাঁধ নির্মাণে এরই মধ্যে যেসব প্রকল্প পাস হয়েছে, সেগুলো পরিকল্পিতভাবে এবং স্বচ্ছতার মধ্য দিয়ে স্থানীয়দের সঙ্গে নিয়ে দ্রুত বাস্তবায়ন করতে পারলে উপকূলের সংকট অনেকটা কেটে যাবে বলে প্রত্যাশা আমাদের সবার।
রিয়াদ হোসেন, অর্থনীতি বিভাগ
সরকারি বিএল কলেজ, খুলনা
মন্তব্য করুন