ড. মোর্শেদ হাসান খান
প্রকাশ : ১৩ আগস্ট ২০২৫, ১২:০০ এএম
আপডেট : ১৩ আগস্ট ২০২৫, ০৯:০২ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ

এক নিভৃতচারী ক্রীড়া সংগঠক

এক নিভৃতচারী ক্রীড়া সংগঠক

আরাফাত রহমান কোকো। পৃথিবীর আলো দেখেছিলেন ১৯৬৯ সালে। বাবার কর্মস্থল কুমিল্লায়। জন্মের পরপরই আসে একাত্তর। মুক্তিযুদ্ধে চলে যান বাবা। চট্টগ্রাম থেকে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর বিরুদ্ধে বিদ্রোহের ডাক দেন। ঘোষণা দেন স্বাধীনতার। তারপর ৯ মাসের রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ। একটি স্বাধীন দেশ, একটি লাল-সবুজের পতাকা। যুদ্ধকালে মা ও বড় ভাই তারেক রহমানের সঙ্গে পাকিস্তানি সেনাদের হাতে বন্দি হওয়ার অভিজ্ঞতা তার শৈশবের আখ্যান। ঢাকা ক্যান্টনমেন্টের বন্দিদশার দিনগুলো তার জীবনের অন্যতম বড় ট্র্যাজেডি হলেও সেগুলো বিস্মৃতি হয়ে যায়। তিনি হয়তো বুঝতে পারেননি বন্দিত্ব কিংবা মুক্তির আনন্দ। কিন্তু বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে তিনি বুঝতে পেরেছিলেন এই দেশ ও দেশের মানুষ তার একান্তই আপন। একটি সদ্য জন্ম নেওয়া দেশের সবক্ষেত্রে ব্যাপক উন্নয়ন আর আধুনিকায়ন প্রয়োজন। তাইতো নিভৃতচারী কোকো বেছে নিয়েছিলেন ক্রীড়াজগৎকে। একজন রাজপুত্র, যিনি কি না চাইলেই ক্ষমতার ভেতর থেকে আরাম-আয়েশে জীবন কাটাতে পারতেন কিন্তু তিনি তা করেননি। তিনি বেছে নিয়েছিলেন রাষ্ট্রসংস্কারের পথ। দেশের ক্রীড়াঙ্গনকে তিনি ঢেলে সাজিয়েছিলেন একজন সুদক্ষ ক্রীড়াশিল্পীর মতো।

শহীদ রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান বীরউত্তম ও সাবেক প্রধানমন্ত্রী দেশনেত্রী খালেদা জিয়ার কনিষ্ঠ সন্তান আরাফাত রহমান কোকোর জীবনটা ছিল বৈচিত্র্যময়। তার মা ও ভাইয়ের সঙ্গে যখন মুক্তি পান, তখন তার বয়স মাত্র দুই বছর চার মাস চার দিন। ১৯৭৫ সালের নভেম্বর সিপাহি বিপ্লবের সময় তার বাবা জিয়াউর রহমান বন্দি হন এবং আবার রাষ্ট্রক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হন, তখনো তিনি মাত্র ছয় বছরের শিশু! এমনকি ১৯৮১ সালে বাবা জিয়াউর রহমান যখন শহীদ হন, তখন আরাফাত রহমান কোকো মাত্র ১১ বছরের কিশোর! এই অল্প সময়ের মধ্যে কোকোর জীবনে যতগুলো ঘটনা ঘটেছে, তার বেশিরভাগই বিয়োগান্তক। যা তার মনোজগতে বিরূপ প্রভাব ফেলে। যদিও তিনি এসবের কিছুই সেভাবে কখনোই প্রকাশ করেননি।

অবুঝ শৈশবেই ১৯৭১-এ পাকিস্তানি হানাদার বন্দিশালায় আটক হওয়ার পর দ্বিতীয়বার ২০০৭ সালে সেনাসমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময় বন্দি হন। ২০০৮ সালের ১৭ জুলাই মুক্তি পেয়ে চিকিৎসার জন্য বিদেশে যান। ২০১৫ সালের ২৪ জানুয়ারি মালয়েশিয়ায় মাত্র ৪৫ বছর বয়সেই তার জীবনাবসান ঘটে।

আরাফাত রহমান কোকো ব্যক্তিগত জীবনে খুবই সাধারণ ও অন্তর্মুখী স্বভাবের ছিলেন। ক্রীড়া সংগঠক হিসেবে দেশের ক্রীড়াঙ্গনে ঐতিহাসিক অবদান রাখলেও তিনি ছিলেন সর্বদা প্রচারবিমুখ। কোকো ২০০২ থেকে ২০০৫ সাল পর্যন্ত বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ডে থাকাকালে ক্রিকেট রাজনীতিমুক্তকরণ যেমন করেছেন, তেমনি বিরোধীদলীয় নেতা সাবের হোসেন চৌধুরীর সঙ্গে কাজ করে স্থাপন করেন অনন্য নজির।

বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ডে যারা দায়িত্ব পালন করেছেন তাদের অধিকাংশই সরাসরি ক্রিকেট খেলোয়াড় ছিলেন না। কিন্তু কোকো ডিওএইচএস ক্লাবের হয়ে দ্বিতীয় বিভাগে ক্রিকেট খেলেছেন। প্রধানমন্ত্রীর সন্তান হিসেবে দ্বিতীয় বিভাগে খেলাটা পারিবারিক শক্তি না দেখানোর মতো বিনয়! এ ধরনের বিনয় তার পুরো ক্রীড়া সংগঠক জীবনে লক্ষ করা যায়।

যেমন ক্রিকেট বোর্ডের নিয়ম অনুযায়ী সরকার যাকে ইচ্ছা তাকেই বোর্ড সভাপতি করতে পারত। কাজেই ক্ষমতার চূড়ান্ত ব্যবহার করলে বোর্ড সভাপতি হতে পারতেন তিনি। কিন্তু কোকো তা না হয়ে বোর্ডের অধীনে ডেভেলপমেন্ট কমিটির চেয়ারম্যান হিসেবে দায়িত্ব নিয়ে আমূল বদলে ফেলেছেন বয়সভিত্তিক ক্রিকেটকে। তিনি কখনো তার অধিকারের বাইরে বাড়তি কোনো হস্তক্ষেপ করেননি। ডেভেলপমেন্ট কমিটির চেয়ারম্যান হিসেবে হাই-পারফরম্যান্স ইউনিটের মাধ্যমে ভবিষ্যৎ ক্রিকেটার তৈরির পাইপলাইনের সূচনা হয় তার হাত দিয়ে। বাংলাদেশের ক্রিকেটে সবচেয়ে সফল সাকিব, তামিম, মুশফিক, শুভ, এনামুল জুনিয়র প্রমুখ ক্রিকেটার হাই-পারফরম্যান্স ইউনিটের মাধ্যমেই প্রতিভা বিকাশের সুযোগ পান। খেলোয়াড় তৈরির ধারাবাহিক পাইপলাইন তৈরি হয়েছিল এই ডেভেলপমেন্ট কমিটির মাধ্যমে। যার মূল কারিগর ছিলেন কোকো।

আবহাওয়াজনিত কারণে বাংলাদেশে বর্ষা মৌসুমে ক্রিকেট খেলা হতো না। ক্রিকেট খেলোয়াড়রা এ সময় অলস বসে থাকতেন। এ সমস্যা দূর করতে ২০০৪ সালে মিরপুর শেরেবাংলা স্টেডিয়ামকে জাতীয় ক্রীড়া পরিষদের কাছ থেকে ক্রিকেটের জন্য বরাদ্দ নেন কোকো। এটিকে পূর্ণাঙ্গ ক্রিকেট ভেন্যু হিসেবে রূপান্তর করতে ভূগর্ভস্থ ড্রেনেজ সিস্টেম তৈরির মাধ্যমে মিরপুর স্টেডিয়ামকে আধুনিকায়ন করেন কোকো। মিরপুর স্টেডিয়ামকে হোম অব ক্রিকেট দেখিয়েই ২০১১ সালে ক্রিকেট বিশ্বকাপ আয়োজনের স্বাগতিক দেশের মর্যাদা লাভ করে বাংলাদেশ।

শুধু তাই নয়, দেশের ক্রিকেটকে বিকেন্দ্রীকরণে ভূমিকা রাখেন কোকো। তিনি ক্রিকেটকে মিরপুর ও চট্টগ্রামে কেন্দ্রীভূত না করে সিলেট, খুলনা, বগুড়া ও রাজশাহীতে আন্তর্জাতিক মানের স্টেডিয়াম নির্মাণের পরিকল্পনা করেন। এ ছাড়া ক্ষমতা থাকার পরও বগুড়ার একমাত্র আন্তর্জাতিকমানের স্টেডিয়াম শহীদ রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের নামে না করে মুক্তিযোদ্ধা শহীদ চান্দু নামে নামকরণ করে অনন্য নজির স্থাপন করেন।

ক্রিকেট অস্ট্রেলিয়ার সঙ্গে তার ব্যক্তিগত সম্পর্ককে কাজে লাগিয়ে অস্ট্রেলিয়ান কোচ, ট্রেনার, ফিজিও আনার ট্রেন্ড চালু করেন কোকো। বোর্ডের প্রফেশনাল কাজেও ক্রিকেট অস্ট্রেলিয়ার সাপোর্ট পাওয়া যেত। ক্রিকেট বোর্ডকে করেছিলেন রাজনীতিমুক্ত। কাজটি করতে গিয়ে জনপ্রিয়তা বা বাহবা কুড়াতে যাননি কোকো। প্রেসকে ডেকে কভারেজের আয়োজন করেননি। প্রধানমন্ত্রীর ছেলে হওয়া সত্ত্বেও সব মতের সংগঠকরাই ছিলেন তৎকালীন ক্রিকেট বোর্ডে।

২০০৪ সালে প্রথম অনূর্ধ্ব-১৯ বিশ্বকাপের আয়োজনের দায়িত্ব পায় বাংলাদেশ কোকোর ক্যারিশমাতেই। সে সময় তৎকালীন বিরোধী দল আওয়ামী লীগ এত বড় আয়োজনের উৎসবে পানি ঢেলে দেওয়ার জন্য সারা দেশে হরতাল ডেকেছিল। সেই প্রতিকূল অবস্থাতেও এক দিনে ১৫টি প্র্যাকটিস ম্যাচ আয়োজন করে সারা বিশ্বকে তাক লাগিয়ে দেয় বাংলাদেশ। সফল এ আয়োজনের নেপথ্য কারিগর ছিলেন কোকো। তিনি ছিলেন নির্লোভ, নির্মোহ, অরাজনৈতিক ক্রীড়া সংগঠক।

এক-এগারোর পরবর্তী সরকারের আমলে দেশীয় ও আন্তর্জাতিক শক্তির রোষানলে পড়ে জিয়া পরিবার। তিনি ও তার ভাই তারেক রহমানের ওপর চালানো হয় নির্মম নির্যাতন। দেশ ছেড়ে মালয়েশিয়ায় পাড়ি জমাতে হয় তাকে। সেখানে ২০১৫ সালের ২৪ জানুয়ারি সেনাসমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের মামলাগুলো মাথায় নিয়ে তার মৃত্যু হয়। তার মৃত্যুর খবরে সারা দেশে শোকের ছায়া নেমে আসে। ২৭ জানুয়ারি সরকারবিরোধী কর্মসূচির সময় দেশে কর্তৃত্ববাদী সরকারের প্রায় কারফিউ অবস্থার মধ্যে বায়তুল মোকাররমে তার জানাজা হয়েছিল।

গণমাধ্যমের খবর অনুযায়ী, সেদিন বায়তুল মোকাররমের দক্ষিণ গেট থেকে মওলানা ভাসানী হকি স্টেডিয়াম, মহানগর নাট্যমঞ্চ, গোলাপ শাহর মাজার থেকে জিপিও মোড় পর্যন্ত সড়কে অবস্থান নেয় মানুষ। অন্যদিকে বায়তুল মোকাররমের উত্তর গেট থেকে পল্টন মোড়, দৈনিক বাংলা মোড় ও জাতীয় ক্রীড়া পরিষদ এলাকায় লাখো মানুষ সমবেত হয়। ঢাকা ছাড়াও নারায়ণগঞ্জ, মানিকগঞ্জ, গাজীপুর থেকে অসংখ্য মানুষ জানাজায় অংশ নেন। একজন প্রচারবিমুখ, সাদাসিধে কোকোর শেষ বিদায়ে লাখ লাখ মানুষ সেদিন ডুকরে কেঁদেছিল। পিতা শহীদ রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের মতো কোকোর জানাজাও বাংলাদেশের ইতিহাসে ছিল বিস্ময়কর। একটি ফ্যাসিবাদী রাষ্ট্রে সব ভয় আর প্রতিবন্ধকতা উপেক্ষা করে সেদিন সাধারণ মানুষ চোখের জলে বিদায় জানায় এ অমর ক্রীড়াশিল্পীকে।

লেখক: ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মার্কেটিং বিভাগের অধ্যাপক এবং আহ্বায়ক, সাদা দল

কালবেলা অনলাইন এর সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিডটি অনুসরণ করুন

মন্তব্য করুন

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

সন্তানকে তার ইচ্ছের বিরুদ্ধে বিয়ে দেওয়া কি জায়েজ

৩১ দফার আলোকে হবে রাষ্ট্র গঠন : অমিত

খালেদা জিয়াকে দেখতে ফিরোজায় যাবেন পাকিস্তানের উপপ্রধানমন্ত্রী

ঘুষকাণ্ডে এবার জামায়াতের সেই আইনজীবীর সনদ স্থগিত

ঢাকায় বিজিবি-বিএসএফ সীমান্ত সম্মেলন, আলোচনা হবে যেসব ইস্যুতে

চাঁদাবাজির অভিযোগে ২ যুবককে গণপিটুনি

সেই তন্বীর বিরুদ্ধে লড়বেন জান্নাতুন নাহার

দুই বাসের ধাক্কায় প্রাণ গেল হেলপারের

সাংবাদিক বিভুরঞ্জন সরকারের মৃত্যুতে সিইউজে’র শোক

রাজধানীর পান্থপথে দেয়াল ধসে নিহত ১

১০

কালকিনিতে আনিসুর রহমান খোকন / মায়েদের পাশে থাকবে বিএনপি

১১

দিনে কত কাপ চা খাওয়া উচিত, জানালেন বিশেষজ্ঞ

১২

২০২৬ সালের এইচএসসি পরীক্ষার সিলেবাস কেমন হবে, জানা গেল

১৩

শান্ত-সৌম্যর বাদ পড়ার কারণ জানালেন গাজী আশরাফ

১৪

বিএনপির সঙ্গে বৈঠকে পাকিস্তানের উপপ্রধানমন্ত্রী

১৫

‘এখন কাউকে ধরতে যৌক্তিক কারণ লাগে না, তবে সত্যের জয় হবে’

১৬

হাওরে নৌকা ডুবে নিখোঁজ ২

১৭

‘পৃথক সচিবালয় ছাড়া বিচার বিভাগের প্রাতিষ্ঠানিক স্বাধীনতা অর্জন সম্ভব নয়’

১৮

রাতের মধ্যে যেসব জেলায় হতে পারে বজ্রবৃষ্টি

১৯

বেসরকারি সংস্থায় চাকরি, বেতন ৩৮০০০ টাকা

২০
X