ড. মো. মিজানুর রহমান
প্রকাশ : ২৮ অক্টোবর ২০২৫, ১২:০০ এএম
আপডেট : ২৮ অক্টোবর ২০২৫, ০৮:০৬ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ

পার্বত্য শান্তিচুক্তির ছায়ায় সন্ত্রাস, নেপথ্যে কী

পার্বত্য শান্তিচুক্তির ছায়ায় সন্ত্রাস, নেপথ্যে কী

বাংলাদেশের পার্বত্য অঞ্চলে সন্ত্রাস ও হত্যার ইতিহাস দীর্ঘ ও বেদনাদায়ক; খাগড়াছড়িতে সাম্প্রতিক সন্ত্রাসী ঘটনা তারই অংশ। ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসনের সময় পার্বত্য চট্টগ্রাম ‘এক্সক্লুডেড এরিয়া’ হিসেবে পরিচালিত হওয়ার ফলে, এ অঞ্চল সরাসরি ব্রিটিশ প্রশাসনের নিয়ন্ত্রণের বাইরে ছিল। তখন স্থানীয় পাহাড়ি রাজা ও সম্প্রদায়কে আঞ্চলিক শাসনের অধিকার এবং জমির মালিকানা ও প্রশাসনিক ক্ষমতা মূলত উপজাতীয় সমাজের হাতে রাখা হয়। ফলে তাদের সামাজিক কাঠামো ও স্বায়ত্তশাসন মজবুত ছিল।

ব্রিটিশ শাসন শেষে পাকিস্তান আমলেও পার্বত্য অঞ্চলে প্রশাসনিক অবহেলা, বৈষম্য ও শোষণ চলতে থাকে; সেই সময় কেন্দ্রীয় শাসন স্থানীয় আদিবাসী ও বাঙালিদের মধ্যে বিভাজন তৈরি করে ‘বিভক্ত করো ও শাসন করো’ নীতির ধারাবাহিকতা বজায় রাখে। এর ফলে জমি দখল, প্রশাসনিক নিপীড়ন ও সাম্প্রদায়িক উত্তেজনা বেড়ে সামাজিক অস্থিরতার ভিত্তি গড়ে ওঠে এবং পর্যায়ক্রমে সশস্ত্র গোষ্ঠীর উত্থান ঘটে; কখনো তারা নিজস্ব জাতিগত স্বার্থরক্ষা করতে আবার কখনো বাইরের রাজনৈতিক প্রভাবে হত্যা, অপহরণ ও সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডে জড়ায়।

১৯৬০-এর দশকে কাপ্তাই বাঁধ নির্মাণের ফলে হাজার হাজার চাকমা ও অন্যান্য পাহাড়ি জনগণ বাস্তুচ্যুত হয়; অনেকেই ভারতে ও মিয়ানমারে আশ্রয় নেয়। এ বাস্তুচ্যুতি পার্বত্য অঞ্চলে সামাজিক-অর্থনৈতিক সংকট সৃষ্টি করে এবং বাস্তুচ্যুতদের মধ্যে গভীর অসন্তোষের বীজ বোনা হয়। স্বাধীনতার পরেও পরিস্থিতি পাল্টায়নি—১৯৭১ সালের পর বিভিন্ন সময়ে পাহাড়ে সেনা মোতায়েন ও সহিংসতা পরিচালনার ঘটনাগুলোকে স্থানীয় সমস্যা বলে সীমাবদ্ধ রেখে দেখা যায় না; এগুলোই ছিল কেন্দ্রীয় রাজনৈতিক নীতির প্রতিফলন। স্বাধীনতার পর প্রথম আওয়ামী সরকারের অধীনে পার্বত্য অঞ্চলে প্রশাসনিক নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠার প্রয়াসে করা সেনা মোতায়েনে স্থানীয় সশস্ত্র বিরোধী ও রাজনৈতিক প্রতিপক্ষকে দমন করা হয় এবং বসতি সম্প্রসারণের প্রক্রিয়ায় কিছু নিরীহ বাঙালি পরিবারও লক্ষ্যবস্তু হয়। তখনকার রাজনৈতিক সমর্থক ও চিহ্নিত বুদ্ধিজীবীরা এ পরিস্থিতিকে রাজনৈতিকভাবে সমর্থন দিতেন এবং অনেক ঘটনাই স্থানীয় প্রশাসন ও মিডিয়ায় বিকৃতভাবে উপস্থাপিত হতো; এতে পাহাড়ি জনগণের মধ্যে বিভাজন আরও গভীর হয়।

১৯৭২ সালে গঠিত পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতি (জেএসএস) আদিবাসী জনগোষ্ঠীর স্বায়ত্তশাসন, জমির অধিকার ও সরকারি উন্নয়ন কার্যক্রমে অংশগ্রহণ নিশ্চিতের দাবি তুলে ধরলেও সংঘাত থামেনি। ১৯৭৫ সালে শেখ মুজিবুর রহমান হত্যাকাণ্ড ও পরবর্তী সামরিক শাসনের সময় পাহাড়ে সহিংসতার মাত্রা বেড়ে যায়; রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা, সেনা অভিযান এবং স্থানীয় আওয়ামী নেতাদের প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ অংশগ্রহণে বহু বাঙালি ক্ষতিগ্রস্ত হন। এরপরও বিষয়টি বহুবার প্রান্তিককরণ, অস্বচ্ছতা ও বিভাজনমূলক প্রচারণার মধ্যে থেকে যায়—যেখানে দোষারোপের ধারাবাহিকতা শুধু স্থানীয় বাহিনী বা সেনাবাহিনীর ওপর সীমাবদ্ধ ছিল না, বরং শাসনকালের নীতিও হামলা-বৃদ্ধিতে ভূমিকা রাখে বলেই অভিযোগ উঠেছে।

পরবর্তী কয়েক দশকেও শান্তি অর্জিত হয়নি; ১৯৮০ থেকে ১৯৯২ সালের মধ্যে পার্বত্য জেলাগুলোতে শান্তিবাহিনী ও সশস্ত্র সন্ত্রাসীদের সংঘর্ষে প্রায় ৪০০ সেনা ও ৩০ হাজার বাঙালি নিহত হয়—শত শত পরিবার বাস্তুচ্যুত ও সম্পদ ধ্বংসের শিকার হয় এবং নিরাপত্তাহীনতা দীর্ঘস্থায়ী হয়। এ সময়ে তথাকথিত মানবাধিকারকর্মী, বামপন্থি ও ভারতপন্থি বুদ্ধিজীবীদের নীরবতা এবং কখনো কখনো উসকানিমূলক ভূমিকার অভিযোগও ওঠে; ফলে সংঘাত আরও জটিল ও দীর্ঘমেয়াদি রূপ নেয়। ১৯৯৬-৯৭ সালের রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটেও শান্তিচুক্তি স্বাক্ষরিত হলে সংঘাত কমার বদলে নতুন ধরনের সমস্যা দেখা দেয়—ঘটনাবলির পর্যালোচনায় দেখা যায়, ১৯৯৭ সালের পার্বত্য শান্তিচুক্তি বাস্তবে স্থায়ী সমাধান আনতে ব্যর্থ হয়েছে; বরং কিছু ক্ষেত্রে এটি প্রশাসনিক বিভাজন, ঘরবাড়ি ভাঙচুর, সম্পদ লুণ্ঠন ও হত্যাকাণ্ডকে থামাতে পারেনি এবং সশস্ত্র গোষ্ঠীগুলোর প্রভাব বজায় রাখতে সাহায্য করেছে বলে অভিযোজনা রয়েছে। চুক্তির প্রক্রিয়ায় ইউপিডিএফ ও জেএসএসকে আত্মনিয়ন্ত্রণের সুযোগ দেওয়া হয়েছে—কিছু বিশ্লেষক এটাকে বাংলাদেশের সার্বভৌমত্বের প্রতি হুমকি হিসেবে আখ্যা দিয়েছেন।

চুক্তির পর অনেক জায়গায় সশস্ত্র গোষ্ঠীগুলো স্থানীয় রাজনীতি ও প্রশাসনে প্রভাব বিস্তার করে; চাঁদাবাজি, সন্ত্রাস ও রাজনৈতিক দখলদারির ঘটনা নিত্যসংবাদে পরিণত হয়। একদিকে প্রশাসনিক উপস্থিতি দুর্বল হয়ে পড়ায় জনগণের নিরাপত্তা আংশিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে, অন্যদিকে নির্দিষ্ট রাজনৈতিক আদর্শ বা বাইরের প্রভাব চুক্তিকে ব্যবহার করে স্বার্থসিদ্ধিতে লিপ্ত রয়েছে—এগুলো সব মিলিয়ে জনমানসে আস্থা হ্রাস করেছে। ফলে পার্বত্য অঞ্চলে বাস্তব উন্নয়ন কাজেও বাধা এসেছে; যদিও সরকারি নীতিতে প্রায়ই ‘পাহাড়িদের উন্নয়ন’কে গুরুত্ব দেওয়া হয়, স্থানীয় বাঙালিদের দুরবস্থার বিষয়টি নানাবিধ কারণে উপেক্ষিত থেকে যায়।

এ অঞ্চলের জনসংখ্যাগত ছবিও বিবেচ্য যেমন, পার্বত্য তিন জেলায় প্রায় ১৪ লাখ মানুষের মধ্যে আনুমানিক ৫৯ শতাংশ বাঙালি ও ৪১ শতাংশ পাহাড়ি বলে প্রচলিত পরিমাপ রয়েছে; আবার অন্য সূত্রে কিছু ভিন্নতাও দেখা যায়—তবে পরিষ্কার যে, বাঙালি ও পাহাড়ি উভয়ের উপস্থিতি গঠনগতভাবে গুরুত্বপূর্ণ। হাজার হাজার নিরীহ মানুষের হত্যার বিচার না হওয়ায় অপরাধীরা আরও সাহসী হয়ে ওঠে এবং কিছু ক্ষেত্রে সন্ত্রাসী গোষ্ঠীগুলো রাষ্ট্রীয় আশ্রয়ও পাচ্ছে, যা স্বাধীন দেশের জন্য লজ্জাজনক। একই সঙ্গে শিক্ষাগত দিক থেকেও কিছু পার্থক্য রিপোর্ট করা হয়। উদাহরণস্বরূপ বলা হয়েছে, চাকমা জনগোষ্ঠীর মধ্যে শিক্ষিতের হার তুলনামূলকভাবে উন্নত এবং চাকমা নারীদের মধ্যে শিক্ষকতা পেশায় অংশগ্রহণও উল্লেখযোগ্য; অন্যদিকে কয়েকটি এলাকার বাঙালি জনগোষ্ঠীর শিক্ষাগত হার কমে আছে—এসব পার্থক্য প্রশাসনিক নীতিতে এবং উন্নয়ন উদ্যোগের বাস্তবায়নে প্রভাব ফেলে, যেখানে কখনো বাঙালির দুরবস্থা উপেক্ষিত থেকে যায়। পাশাপাশি কিছু পাহাড়ি এলাকায় জমি লিজে দেওয়া ও পরিচালনার প্রক্রিয়া নিয়েও প্রশ্ন উঠেছে, যা রাষ্ট্রীয় ন্যায়বিচার ও নাগরিক অধিকারের দিক থেকে বিতর্কিত।

ইতিহাস ও নিরাপত্তা বিশ্লেষণের আলোকে দেখা যায়, ইউপিডিএফসহ কিছু সংগঠনের কার্যক্রমে বাইরের প্রভাবের উপসর্গ রয়েছে—রিপোর্টগুলোতে বলা হয়েছে কোচিং, প্রশিক্ষণ ও লজিস্টিক সাপোর্ট সীমান্ত পার্শ্ববর্তী অঞ্চলে ঘটে থাকতে পারে। সাম্প্রতিক খাগড়াছড়ি সংঘাতের প্রেক্ষাপটে অভিযোগ উঠেছে যে, ধর্ষণের একটি নাটক সাজিয়ে সংঘাত উসকে দেওয়া হয়; যদিও মেডিকেল প্রতিবেদন ও প্রাথমিক তথ্যগুলোতে প্রমাণ মেলেনি, তবু এ ধরনের ঘটনা এলাকায় অস্থিরতা ও সামাজিক উত্তেজনা তৈরি করেছে। এ ধরনের কৌশলগত বিভ্রান্তি ও ভূরাজনৈতিক উদ্দেশ্য সামগ্রিকভাবে সমস্যা জটিল করে তোলে।

এর পরিপ্রেক্ষিতে নিরাপত্তা বিশ্লেষকরা ইউপিডিএফের সন্ত্রাস বন্ধে তৎক্ষণিক ও সমন্বিত ব্যবস্থা গ্রহণের পরামর্শ দেন। গোয়েন্দা ও মাঠপর্যায়ের তথ্য অনুযায়ী, সূত্রবিহীনভাবে ছড়ানো ঝুটো অভিযোগ, সীমান্তের বাইরের প্রশিক্ষণ ও সাহায্য ইত্যাদি প্রতিহত করতে হবে। তবে পুরোটাই শুধু শক্তি প্রদর্শন করে সমাধান না করে আইনশৃঙ্খলা বজায় রেখে প্রমাণভিত্তিক তদন্ত, জনসচেতনতা বৃদ্ধি, ক্ষতিগ্রস্তদের সুরক্ষা নিশ্চিত করা এবং স্থানীয় সম্প্রদায়ের মধ্যে সামাজিক ঐক্য রক্ষার কার্যকর ব্যবস্থাও প্রয়োজন। একই সঙ্গে সামরিক ও সিভিল প্রশাসনের মধ্যে সমন্বয় বাড়ানো জরুরি, যাতে নিরাপত্তা বজায় রেখে জনসাধারণের আস্থা পুনঃস্থাপন করা যায়।

বর্তমানে খাগড়াছড়িসহ পার্বত্য চট্টগ্রামের অস্থিতিশীলতা কমাতে সেনা ক্যাম্প ও ক্যান্টনমেন্ট বৃদ্ধির প্রস্তাব উঠেছে; বিশেষত কিছু সম্ভাব্য সুপারিশে খাগড়াছড়িতে ক্যাম্প সংখ্যা ২৫০-তে উন্নীত করার কথা বলা হচ্ছে। ১৯৯৭ সালের শান্তিচুক্তির পর সেনা ক্যাম্প কমানো হয়েছিল, যা নিরাপত্তাহীনতার প্রশস্তির ভাব প্রকাশ করেছে বলে মনে করা হয়; যদিও কিছু মানুষ মনে করেন, সেনা উপস্থিতি বাড়লেই নিরাপত্তা বৃদ্ধি পাবে; অন্যরা আশঙ্কা করেন, এতে সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক অধিকার ক্ষুণ্ন হতে পারে। তাই সেনা ক্যাম্প এবং সেনা উপস্থিতি বাড়ানোর বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়ার সময় স্থানীয় মতামত, নিরাপত্তা পরিস্থিতি, আন্তর্জাতিক অভিজ্ঞতা ও মানবাধিকার বিবেচনা করে আসন্ন নীতি গ্রহণ করা উচিত।

সমস্যার মূলে আছে বহুমুখী ও জটিল ভূরাজনৈতিক অনুষঙ্গ—নির্দিষ্টভাবে প্রতিবেশী দেশগুলোর দীর্ঘমেয়াদি হস্তক্ষেপ ও সীমান্তসংলগ্ন রাজনৈতিক অবস্থা। তবে এ সংকটকে শুধু জাতিগত বা ধর্মীয় দ্বন্দ্ব হিসেবে ব্যাখ্যা করা হলে বাস্তব সমাধান মিলবে না; এটি মূলত রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তা, সার্বভৌমত্ব ও অংশগ্রহণমূলক নীতিনির্ধারণের প্রশ্ন। বাংলাদেশের সংবিধানে পার্বত্য অঞ্চলকে ভিন্ন আইনি পরিচয়ে ভাগ করা হয়নি—সবাই বাংলাদেশের নাগরিক। তাই সমস্যার সমাধান হওয়া উচিত সমগ্র দেশের মানুষের সার্বিক অধিকার ও নিরাপত্তা নিশ্চিত করে।

কর্তৃপক্ষ ও সমাজের ওপর এখন দায়িত্ব যে, পার্বত্য অঞ্চলে সন্ত্রাসবিরোধী পদক্ষেপ গ্রহণের পাশাপাশি সামাজিক-বাতাবরণ পুনর্গঠন করা। এর মধ্যে রয়েছে তথ্যভিত্তিক, অংশগ্রহণমূলক ও ন্যায্যনীতি প্রণয়ন; কৃষি, বনজসম্পদ, ক্ষুদ্রশিল্প, শিক্ষা ও স্বাস্থ্য খাতে বিনিয়োগ বাড়িয়ে কর্মসংস্থান সৃষ্টির উদ্যোগ; নারী ও তরুণদের শিক্ষার মাধ্যমে ক্ষমতায়ন; সীমান্ত তত্ত্বাবধান উন্নতকরণ ও প্রতিবেশী রাষ্ট্রগুলোর সঙ্গে সমন্বিত কৌশল গ্রহণ। এ ছাড়া আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা করে সন্ত্রাসবাদ ও চাঁদাবাজির সঙ্গে জড়িত গোষ্ঠীগুলোর বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া জরুরি, তবে সেই ব্যবস্থা প্রমাণভিত্তিক তদন্ত ও মানবাধিকারের প্রতি সম্মান বজায় রেখে গ্রহণ করতে হবে। রাজনৈতিক সংলাপ ও স্থানীয় অংশগ্রহণশীল প্রক্রিয়ার মাধ্যমে শান্তি প্রক্রিয়াকে স্থায়ীভাবে রিপিয়ার করা সম্ভব কিন্তু শুধু বন্দুকবলে নয়, সমাজিক ন্যায্যতা, বিচারপ্রাপ্তি ও সমবায়িক উন্নয়ন ছাড়া স্থায়ী শান্তি আনাটা অসম্ভব। এ প্রেক্ষাপটে আমাদের পরামর্শ হওয়া উচিত, পার্বত্য শান্তি নামক দেশের সার্বভৌমত্ববিরোধী কালো চুক্তি বাতিল করা অথবা পার্বত্য সমস্যার পূর্ণাঙ্গ পর্যালোচনা করে চুক্তি বা নীতি-নবায়ন করা—যেখানে প্রয়োজন হলে ১৯৯৭ সালের চুক্তির দুর্বলতা শনাক্ত করে জনগণের অংশগ্রহণমূলক, বাস্তবভিত্তিক ও ন্যায্য কাঠামোর আওতায় নতুন সমঝোতা গঠন করা হবে। জনগণের আস্থাভিত্তিক নিরাপত্তা ও নাগরিক অধিকার রক্ষায় রাষ্ট্রকে শক্ত মনোভাব নিয়ে কাজ করতে হবে কিন্তু সেই শক্তি প্রয়োগ মানবাধিকার ও নাগরিক স্বাধীনতার সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে বাস্তবায়ন করতে হবে। পার্বত্য চট্টগ্রাম বাংলাদেশের অবিচ্ছেদ্য অংশ; এখানে বসবাসকারী চাকমা, মারমা, ত্রিপুরা ও বাঙালি—সবাই বাংলাদেশের নাগরিক এবং সবার অধিকার সমান। যে কোনো বিভাজনমূলক শব্দ বা ধারণা জাতীয় ঐক্য ও সার্বভৌমত্বের পরিপন্থি; তাই রাষ্ট্র ও সমাজকে মিলেই কাজ করতে হবে যাতে পাহাড়ে নিরাপত্তা, ন্যায্যতা ও উন্নয়ন একসঙ্গে প্রতিষ্ঠিত হয়।

সামরিক গোয়েন্দা সংস্থাগুলো বারবার সতর্ক করেছে যে, সীমান্তের উভয়পাশে সংঘর্ষ-প্রবণতা ও স্বাধীনতাবাদী আন্দোলনের প্রেক্ষাপট রয়েছে; তাই সীমান্ত তত্ত্বাবধান আরও জোরদার, গোপনীয় গোয়েন্দা তথ্য কার্যকরভাবে ব্যবহার এবং আন্তর্জাতিক সহযোগিতার মাধ্যমে সমস্যার উৎস নির্ণয় ও সমাধান করা দরকার। একই সঙ্গে গণমাধ্যম, বুদ্ধিজীবী সমাজ ও মানবাধিকারকর্মীদেরও দায়িত্ব থাকবে—সব পক্ষের নিরপেক্ষ ভূমিকা নিশ্চিতে কাজ করতে হবে যাতে আক্রান্ত নিরীহ মানুষের কষ্ট ও ক্ষতি নিরপেক্ষভাবে বিবেচিত হয়। যদি কিছু সংগঠন বা ব্যক্তিবর্গ সীমান্তের পেছনের শক্তির প্রকৃত স্বার্থে কাজ করে থাকে, তা তদন্ত করে আইনি পথে সঠিকভাবে মোকাবিলা করতে হবে; কিন্তু এ কাজটি করতে গিয়ে সাধারণ জনগণের মানবাধিকার লঙ্ঘন করা হলে তা সমাধান নয় বরং সমস্যা বাড়াবে।

অতএব, পার্বত্য অঞ্চলে স্থায়ী শান্তি ও উন্নয়নের একমাত্র পথ হচ্ছে তথ্যভিত্তিক, অংশগ্রহণমূলক এবং ন্যায্যনীতির বাস্তবায়ন; সন্ত্রাস দমনে আইন ও প্রশাসনের দৃঢ়তা বজায় রাখা এবং একই সঙ্গে ক্ষতিগ্রস্ত জনগোষ্ঠীর নিরাপত্তা ও জীবন-জীবিকার প্রতি খেয়াল রাখা। সেনাবাহিনী ও প্রশাসনের মধ্যে কার্যকর সমন্বয়ের মাধ্যমে নিরাপত্তা জোরদার করা যায়, পাশাপাশি স্থানীয় জনগণের আস্থা পুনঃস্থাপন করেই লক্ষ্য অর্জিত হবে। দেশের অভ্যন্তরীণ শৃঙ্খলা ও জাতীয় ঐক্য রক্ষায় উচিত কড়াভাবে সন্ত্রাস দমন করা। তবে সেই প্রক্রিয়ায় মানবাধিকারের প্রতি সম্মান বজায় রাখতে হবে। পার্বত্য চট্টগ্রামের মানুষ চাকমা, মারমা, ত্রিপুরা ও বাঙালি—সবাই বাংলাদেশের নাগরিক; তাদের জীবন, স্বার্থ ও অধিকার সুরক্ষিত রাখাই রাষ্ট্রের মূল লক্ষ্য হওয়া উচিত।

লেখক: অর্থনীতিবিদ, গবেষক ও কলামিস্ট

কালবেলা অনলাইন এর সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিডটি অনুসরণ করুন

মন্তব্য করুন

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

সকাল থেকে মেট্রোরেল চলাচল স্বাভাবিক

প্রতিষ্ঠার ১৯ বছর / বিদেশে সরাসরি মাস্টার্সে ভর্তি হতে পারছেন না কুবি শিক্ষার্থীরা

সুপারসনিক বিমানের সফল পরীক্ষা, কী আছে এতে

ঘরে মুরগির মাংস দেখে সেজদায় লুটিয়ে পড়ল শিশু

ব্রাজিলে মাদক কারবারিদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা, কী হচ্ছে সেখানে

রাজধানীতে আজ কোথায় কী

আজ ৩৬ ঘণ্টা গ্যাস থাকবে না যেসব এলাকায়

তিস্তা নদী রক্ষার দাবিতে শিক্ষার্থীদের ব্যতিক্রমী ফ্ল্যাশ মব

পুলিশকে মারধর করে হাতকড়াসহ পালানো সেই আ.লীগ নেতা গ্রেপ্তার

গাজায় হামলা থামেনি, শতাধিক নিহত

১০

ঢাকায় বৃষ্টি নিয়ে আবহাওয়া অফিসের বার্তা

১১

মাদ্রাসা থেকে পালিয়ে বাড়ি যাওয়ায় পায়ে শিকল বেঁধে শিশুর পাঠদান

১২

মধুপুরে নিষিদ্ধ ছাত্রলীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক বাবলু আটক

১৩

বৃহস্পতিবার রাজধানীর যেসব এলাকার মার্কেট বন্ধ

১৪

৩০ অক্টোবর : আজকের নামাজের সময়সূচি

১৫

চট্টগ্রামে বর্জ্য থেকেই তৈরি হবে গ্রিন ডিজেল ও অ্যাভিয়েশন ফুয়েল

১৬

রাজধানীতে আ.লীগ নেতা মানিক দর্জি গ্রেপ্তার

১৭

বিএনপি ক্ষমতায় গেলে চাঁদাবাজি-দুঃশাসনমুক্ত দেশ গড়বে : কফিল উদ্দিন

১৮

আফগানিস্তান নয়, বাংলাদেশের প্রতিপক্ষ নেপাল

১৯

এবার বার্সায় আরও বড় দুঃসংবাদ

২০
X