

বিশ্বের দূষিত শহরের তালিকায় রাজধানী ঢাকার নাম মাঝেমধ্যেই শীর্ষস্থানে দেখা যায়। বলাই বাহুল্য, শীর্ষস্থান শব্দটি শুনতে ইতিবাচক কিংবা গৌরবের কোনো স্থান অর্জন মনে হলেও এক্ষেত্রে শব্দটি ঢাকাবাসীর জন্য কোনো দিক দিয়েই মঙ্গলজনক নয়। দীর্ঘদিনের এ সমস্যা নিয়ে বছরের পর বছর ধরে নানা আলোচনা, গবেষণা, উদ্যোগ, পদক্ষেপ, কাঁড়ি কাঁড়ি টাকা খরচসহ বহু মহাযজ্ঞের কথা শোনা গেলেও পরিস্থিতির যে ইতিবাচক কোনো বদল হয়েছে, তা বলার উপায় নেই।
শনিবার দৈনিক কালবেলার প্রথম পাতায় বায়ুদূষণ নিয়ে একটি ছবি প্রকাশিত হয়েছে। ছবিটি দেখে সত্যিকার অর্থে বোঝার উপায় নেই কিংবা ভ্রম হওয়া স্বাভাবিক যে, সময়টা বুঝি তীব্র শীতের, যখন ভোরবেলায় কুয়াশার চাদরে ঢাকা থাকে সবকিছু। নিকট দূরত্বের কিছু দৃষ্টিগোচর হয় না। আবার মনে হতে পারে, ধূলিঝড় হয়েছে, যার কারণে সবকিছু ঢেকে গেছে। বাস্তবে এ দুইয়ের কোনোটিই নয়। মূল কারণ হলো, রাজধানীর ডেমরার বাঁশেরপুল এলাকায় অবস্থিত একটি শিল্প কারখানা থেকে নির্গত ধোঁয়ায় এ পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে। দেখা যাচ্ছে, মিলটির চুল্লি দিয়ে ধোঁয়া বেরিয়ে পুরো এলাকা ছেয়ে গেছে। সড়কে নিকট দূরত্বের যানবাহন প্রায় অস্পষ্ট। বলার অপেক্ষা রাখে না যে, ওই ধোঁয়ার পুরোটাই রাসায়নিকযুক্ত বিষাক্ত ধোঁয়া, যা মানবদেহের জন্য বহুমাত্রিক ক্ষতির জন্য দায়ী। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার তথ্য অনুসারে, বায়ুদূষণের ফলে স্ট্রোক, হৃদরোগ, ক্রনিক অবস্ট্রাকটিভ পালমোনারি ডিজিজ, ফুসফুসের ক্যানসার এবং তীব্র শ্বাসযন্ত্রের সংক্রমণের কারণে বিশ্বব্যাপী মৃত্যুহার বৃদ্ধি পেয়েছে। ফলে প্রতি বছর আনুমানিক ৭০ লাখ মানুষ মারা যায় শুধু বায়ুদূষণে। ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ আমাদের দেশেও নেহাত কম নয়। বায়ুদূষণের কারণে ঢাকার বার্ষিক ক্ষতির নানামাত্রিক নেতিবাচক চিত্র রয়েছে। এটি শুধু স্বাস্থ্য ও অর্থনীতির ওপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলে না, বরং জীবনযাত্রার মানও কমিয়ে দেয়। দেখা যায়, অর্থনৈতিক ক্ষতির পাশাপাশি কমিয়ে দেয় গড় আয়ু। ঘটে অকাল মৃত্যু। ঝুঁকি বাড়ায় স্বাস্থ্যের। হৃদরোগ, স্ট্রোক, ফুসফুসের ক্যানসার, ডায়াবেটিস এবং শ্বাসকষ্টের মতো দীর্ঘস্থায়ী রোগ বৃদ্ধি পায়। এ ছাড়া এটা দৃশ্যমানতা হ্রাস করে, অ্যাসিড বৃষ্টিপাতসহ অন্যান্য ক্ষতিসাধন করে।
প্রশ্ন হচ্ছে, এসব কলকারখানা কোথায় স্থাপিত হতে পারবে এবং কোথায় পারবে না—এ ব্যাপারে পরিবেশ-সংক্রান্ত যেসব বিধিবিধান রয়েছে, তা ঠিকঠাক অনুসরণ করা হয়েছে কি না, সরকারের পরিবেশ সংশ্লিষ্ট ব্যক্তি ও সংস্থাই ভালো বলতে পারবে?
তবে ঢাকা শহরের নানামাত্রিক দূষণের ব্যাপারে সরকার ও সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানগুলোর অবহেলা, উদাসীনতা কিংবা অপরিকল্পিত নগরায়ণের ভূমিকা সর্বজনবিদিত। এর আগে খোদ পরিবেশ অধিদপ্তর ও বিশ্বব্যাংকের একটি প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়, ঢাকার বায়ুদূষণের তিনটি প্রধান উৎস হলো—ইটভাটা, যানবাহনের ধোঁয়া ও নির্মাণ সাইটের ধুলো। বায়ুদূষণের ৫৮ শতাংশের জন্য দায়ী শহরের আশপাশের ইটভাটাগুলো। অবৈধ ইটভাটার বিরুদ্ধে পরিবেশ অধিদপ্তরের অভিযান অব্যাহত থাকলেও এখনো অনেক ইটভাটা অনুমোদনবিহীনভাবে চলছে। তা ছাড়া ফিটনেসবিহীন যানবাহন নিয়ন্ত্রণেও তেমন দৃশ্যমান অগ্রগতি নেই। সেইসঙ্গে উন্নয়নকাজেও সর্বদাই দেখা যায় বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের মধ্যে সমন্বয়হীনতা।
আমরা মনে করি, রাজধানীবাসীর দূষণের মরণফাঁদ থেকে বাঁচতে হলে উল্লিখিত কারণগুলোর বিরুদ্ধে কঠোর অবস্থান নিতে হবে। নগরে উন্নয়নকর্মে সমন্বয় প্রতিষ্ঠার পাশাপাশি উন্নতি সাধন করতে হবে গণপরিবহনের। এটাও মনে রাখতে হবে যে, রাতারাতি এ সংকট পুরোপুরি সমাধান সম্ভব নয়। তবে পরিকল্পিত ও সমন্বিত উদ্যোগে দূষণ কমানো সম্ভব। যেহেতু এখানে শীতকালে বাতাসের গুণমান বেশি অস্বাস্থ্যকর হয়ে যায়, ফলে আসন্ন শীত সামনে রেখে কিছু কার্যকর উদ্যোগ জরুরি।
মন্তব্য করুন