

কমল মিত্র শক্তিমান বাঙালি অভিনেতা। প্রখ্যাত এই অভিনেতার কথা এলে মনের মধ্যে ভেসে ওঠে রাশভারী, অহঙ্কারী, গম্ভীর কণ্ঠস্বরের দীর্ঘদেহী এক মানুষের ছবি যেন বাঙালি পরিবারের এক আইকনিক কর্তা।
তার জন্ম ১৯১২ সালের ৯ ডিসেম্বর, ভারতের বর্ধমানে। কমল মিত্র চার দশকের বেশি সময় প্রায় সাড়ে তিনশ চলচ্চিত্রে অভিনয় করেন। প্রখ্যাত অভিনেতা ছবি বিশ্বাস এবং পাহাড়ী সান্যালসহ তিনি বাংলা সাদা-কালো পর্দায় পঞ্চাশ-ষাটের দশকে অধিকাংশ মধ্য বয়স্ক চরিত্রে আধিপত্য দেখিয়েছেন। প্রকৃতপক্ষে তার সফলতা সত্তর দশকেও একইভাবে অক্ষুণ্ন থাকে। কমল মিত্র পৌরাণিক ও সামাজিক কাহিনিতে বেশ কয়েকটি উল্লেখযোগ্য চরিত্রে অভিনয় করেন। মথুরা ও ভগবান শ্রীকৃষ্ণের মাতুলকে নিয়ে চলচ্চিত্র কংস সিনেমায় তার ‘কংস’ চরিত্রটি কিংবদন্তি নেতিবাচক চরিত্র হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়ে আছে। এ চলচ্চিত্রে তিনি মূল চরিত্রের অন্তরের বেদনা ও বাহ্যিক ক্রোধ এমনভাবে ফুটিয়ে তুলেছেন, যা বাংলা সিনেমার ইতিহাসে অতুলনীয়। মহিষাসুর বধ দৃশ্যে ‘মহিষাসুর’ চরিত্রে অভিনয় করেন তিনি।
চলচ্চিত্রের পাশাপাশি কর্মজীবনে সফল ছিলেন কমল মিত্র। অভিনয় করেন থিয়েটার, যাত্রায়ও। মঞ্চ ও পর্দায় তার শক্তিশালী অভিনয় গুণটি আসে তার নিয়ম-শৃঙ্খলাময় জীবন থেকে। এ গুণ পান স্নাতক হওয়ার পর প্রারম্ভিক বছরগুলোতে সামরিক বাহিনীতে কাজ করার সময়। ছিলেন ভালো একজন ফুটবলবলারও। চলচ্চিত্র জীবন শুরু করার আগে তিনি বর্ধমানের জেলা ম্যাজিস্ট্রেট ও কালেক্টর অফিসে কাজ করেন। নিবেদিত পাঠক হিসেবে সমাদৃত ছিলেন এবং বিরল বইয়ের একটি সমৃদ্ধ সংগ্রহ ছিল তার। কলকাতায় চলচ্চিত্র কেন্দ্র, চলচ্চিত্র অধ্যয়ন ও চলচ্চিত্র আর্কাইভ নন্দনে তার বিশাল সংগ্রহ দান করেন।
নীলাঙ্গুরীয় তার জীবনের প্রথম সিনেমা বলে ধরা হলেও মূলত ১৯৪৩ সালে দেবকী বসুর ‘শ্রীরামানুজ’ মুভি দিয়েই তার চলচ্চিত্র অভিনয়ের যাত্রা শুরু। ১৯৪৫ সালে দেবকী বসুর পরের হিন্দি মুভি ‘স্বর্গ সে সুন্দর মেরা দেশে’ তিনি অভিনয় করেন। ওই বছরই নীরেন লাহিড়ী পরিচালিত ‘বনফুল’ বের হয়। এটিও হিন্দি মুভি। দেবকীবাবুর সিনেমায় কমল মিত্রকে হিন্দি ভাষা শিখতে হয়।
কমল মিত্র রেডিও-নাটকে অভিনয় করেন। তার কণ্ঠস্বর ও উচ্চতা উভয়ই দুর্লভ, যা তার অভিনয়ে অতিরিক্ত চমক যোগ করে; পর্দায় চরিত্রনির্বিশেষে শ্রোতাদের ওপর যার প্রভাব ভীষণ। অভিনেতা হিসেবে তার শব্দচয়ন ও স্বরনিক্ষেপ তাকে সাফল্যের শীর্ষে নিয়ে যায়। তার আত্মজীবনী ‘ফ্লাশব্যাক’ তার অভিনয়ের দশকগুলোর বাংলা সিনেমার জগতের একটি অন্তর্দৃষ্টির সাক্ষ্য বহন করে। বইটিকে সমসাময়িক সমাজের ওপর প্রভাব ফেলার মাধ্যম হিসেবে বাংলা চলচ্চিত্রে ধীরে ধীরে আধুনিকীকরণ এবং ক্রমবিকাশের একটি ভাষ্য হিসেবে বিবেচনা করেন চলচ্চিত্রবোদ্ধারা। তার অভিনীত চলচিত্র— সংকল্প, বীর হাম্বীর, নীলাঙ্গুরীয়, মহিষাসুর বধ, সব্যসাচী, বিদ্যাসাগর, আনন্দ মঠ, জিজ্ঞাসা, অগ্নিপরীক্ষা, শিল্পী, শাপমোচন, কংস, পথের দাবী, লৌহ কপাট, সাগরিকা, সবার ওপরে, যমলায়ে জীবন্ত মানুষ, দেয়া নেয়া, দক্ষ যজ্ঞ, ফয়সালা অন্যতম। প্রযোজক, পরিচালক, সহকর্মী এবং অগণিত দর্শকদের কাছে তার বিশাল জনপ্রিয়তা থাকা সত্ত্বেও একসময় তিনি অভিনয় ছেড়ে দেন। কমল মিত্র ১৯৯৩ সালের ২ আগস্ট মারা যান।
মন্তব্য করুন