

জন্মহার দ্রুত কমে যাচ্ছে। অভিবাসন না হলে অনেক দেশ ধ্বংসের পথে যাচ্ছে। আমি জানি ‘সভ্যতা মুছে যাওয়া’ কাকে বলে। আমি গ্রাফ দেখেছি। ইউরোপীয় কমিশন মার্চ মাসে এ গ্রাফ প্রকাশ করেছে। এটি মোট প্রজনন হারের চিত্র। এর মানে হলো, প্রত্যেক নারী গড়ে কতটি শিশু জন্ম দিচ্ছেন। গত ২০ বছরে সামান্য বৃদ্ধি ছিল। এখন আবার হার কমছে। ইইউতে এই হার এখন ১ দশমিক ৩৮। যুক্তরাজ্যে হার ১ দশমিক ৪৪।
জনসংখ্যা স্থিতিশীল রাখতে দরকার ২ দশমিক ১। আপনি এটিকে বিপর্যয় ভাবতে পারেন। আপনি নাও ভাবতে পারেন। কিন্তু গণিত এসব মতামত মানে না। আমরা ধীরে ধীরে নিচের দিকে নামছি। ‘সভ্যতা মুছে যাওয়া’ শব্দটি ট্রাম্প প্রশাসন ব্যবহার করেছে। গত সপ্তাহে তারা নতুন জাতীয় নিরাপত্তা কৌশল প্রকাশ করেছে। তারা বলেছে, অভিবাসনের কারণে ইউরোপীয় সভ্যতা ধ্বংস হবে। বাস্তবতা ভিন্ন। অভিবাসন না থাকলে ইউরোপই থাকবে না। সভ্যতাও থাকবে না। তর্ক করার মতো মানুষও থাকবে না। আমরা আসলে ভিন্ন বিষয় নিয়ে কথা বলছি। ট্রাম্প প্রশাসন সভ্যতাকে দেখে শ্বেতাঙ্গ ও পশ্চিমা সম্পত্তি হিসেবে। তাদের চোখে কৃষ্ণ ও বাদামি মানুষ হুমকি। তারা এখানে জন্মালেও হুমকি। সাম্প্রতিক সময়ে এলেও হুমকি। এ সপ্তাহে ট্রাম্প দাবি করেন একটি কথা। তিনি বলেন, পোল্যান্ড ও হাঙ্গেরি ছাড়া ইউরোপের দেশগুলো টিকবে না। অভিবাসনের কারণেই এমন হবে। কিন্তু পোল্যান্ডের প্রজনন হার ১ দশমিক ২। এর মানে হলো, দ্রুত পতন। অভিবাসন না নিলে দেশটি টিকবে না। ট্রাম্পের চোখে ‘সভ্যতা’ একটি বর্ণবাদী ধারণা। এটি শ্বেতাঙ্গ আধিপত্যের ধারণা। তার সরকার যে মুছে যাওয়ার ভয় পাচ্ছে, তা হলো ‘শ্বেত’ সংস্কৃতি। আসলে এমন কিছু কখনো ছিল না। এখনো নেই। আমাদের ভাষা এসেছে অন্য জায়গা থেকে। আমাদের বিজ্ঞান এসেছে অন্য জায়গা থেকে। আমাদের গণিত, সংগীত, খাবার, সাহিত্য ও শিল্পও এসেছে অন্য জায়গা থেকে। উপনিবেশ ও পরবর্তী লুটপাটের কারণে আমাদের অনেক সম্পদও এসেছে বাইরে থেকে।
টমেটো ছাড়া ইতালীয় রান্না কল্পনা করা যায় না। কিন্তু টমেটোর উৎস দক্ষিণ আমেরিকা। এটি ১৯ শতকের আগে তেমন ব্যবহৃত হতো না। বালতি কারির দাবি থাকতে পারে যুক্তরাজ্যের জাতীয় খাবার হওয়ার। ফিশ অ্যান্ড চিপস পর্তুগিজদের কাছ থেকে এসেছে। বালতি এই দেশেই তৈরি হয়েছে। পুরোনো ইংল্যান্ডের রোস্ট বিফ এসেছে একটি প্রাণী থেকে। এই প্রাণী প্রথম গৃহপালিত হয় মধ্যপ্রাচ্যে। এটি ধনী শ্রেণি খেত। সাধারণ মানুষ প্রোটিন পেত ডাল থেকে। পিস পটেজ ও পিস পুডিং তখন প্রচলিত ছিল। এ অবস্থা বদলায় পরে। উপনিবেশ থেকে মাংস সংরক্ষণ ও আনার উপায় বের হয়। তখনই ব্রিটেনে ব্যাপকভাবে বিফ খাওয়া শুরু হয়। এর পেছনে ছিল ভয়াবহ ইতিহাস।
আমেরিকা, অস্ট্রেলিয়া ও নিউজিল্যান্ডের আদিবাসীরা ধ্বংস হয়। তাদের পরিবেশ ধ্বংস করা হয়। এ ধ্বংসের ওপর দাঁড়িয়েই গড়ে ওঠে সেই তথাকথিত সভ্যতা। একসময় কিছু শাসক বহুত্ববাদের শক্তি বুঝতেন।
হাঙ্গেরির রাজা স্টিফেন প্রথম তা বুঝেছিলেন। তিনি ১০০১ থেকে ১০৩৮ সাল পর্যন্ত শাসন করেন। তিনি বলেছিলেন, ‘বিদেশিদের সংস্কৃতি ও জ্ঞান রাজ্যকে সমৃদ্ধ করে। একটি দেশ যদি ভাষা ও রীতিতে একরকম হয়, তবে তা ভঙ্গুর ও দুর্বল।’
এক হাজার বছর পর ট্রাম্প এ সহজ সত্য ভুলে গেছেন। আমি এখানে অন্য ধরনের মুছে যাওয়ার কথা বলছি। এটি বাস্তব মুছে যাওয়া। এটি সমাজের সত্যিকারের অদৃশ্য হয়ে যাওয়া। যখন প্রজনন হার ২ দশমিক ১-এর নিচে নামে, তখন তা আরও কমতে থাকে। শূন্যের দিকে পতন থামানো যায় না। এর মানে এই নয় যে ,আমি জন্মহার বাড়ানোর পক্ষের মানুষ। আমি প্রোনাটালিস্ট নই। আমি অ্যান্টিনাটালিস্টও নই। এই দুই অবস্থানই ফলহীন।
ডেভিড রান্সিম্যান এ বিষয়ে লিখেছেন। তিনি লন্ডন রিভিউ অব বুকসে বিষয়টি ব্যাখ্যা করেছেন। তিনি বলেন, সমৃদ্ধি বাড়লে সন্তান নেওয়ার খরচও বাড়ে। এর ফলে জন্মহার কমে। এ প্রক্রিয়া কিছু অঞ্চলে ১৬ ও ১৭ শতকেই শুরু হয়। কোনো সরকার এ ধারা বদলাতে পারেনি। নিয়ন্ত্রণ বা প্রণোদনা তেমন কাজ করে না। অনেক বছর ধরে আমি কিছু মানুষের সঙ্গে তর্ক করেছি। তারা পরিবেশের জন্য মানুষের সংখ্যা কমাতে চায়। আমি তাদের একটি কথা বলেছি। আজকের জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার অনেক আগেই নির্ধারিত হয়েছে। জাতিসংঘের একটি প্রতিবেদন এ কথা বলে। ১৯৫০ ও ১৯৬০-এর দশকে জন্মহার বেশি ছিল। এর ফলে জনসংখ্যার ভিত্তি বড় হয়। পরে অনেক তরুণ প্রজনন বয়সে পৌঁছায়। এ কারণেই জনসংখ্যা বাড়তে থাকে। এর মানে হলো, বেশি মানুষের ভয় একটি গাণিতিক বিষয়। এ প্রবণতার সঙ্গে লড়াই করা যায় না। বিশ্ব জনসংখ্যা আরও কিছুদিন বাড়বে। এরপর তা দ্রুত কমবে। এটি জনমিতিক গতি বা ডেমোগ্রাফিক মোমেন্টামের ফল।
এ প্রবণতা বদলাতে একটাই উপায় আছে, তা হলো নজিরবিহীন গণহত্যা। এর মানে কোটি কোটি মানুষ হত্যা। এটাই একমাত্র উপায়। কারণ, সমস্যাটি জন্মহার বাড়া নয়। বিশ্বব্যাপী জন্মহার ১৯৬৩ সাল থেকেই কমছে। সে বছর আমার জন্ম। সমস্যা হলো শিশু মৃত্যুহার কমে যাওয়া। মানুষ এখন অনেক বেশি দিন বাঁচে। একটি বিদ্রুপের বিষয় আছে। সবচেয়ে বড় জনসংখ্যা হ্রাস ঘটাতে পারেন এমন একজন মানুষ আছেন। তিনি হলেন ইলন মাস্ক।
তিনি নিজেকে প্রোনাটালিস্ট বলেন। তার সিদ্ধান্তে ইউএসএইড ভেঙে দেওয়া হয়েছে। ল্যানসেটের এক হিসাবে এতে ১ কোটি ৪০ লাখ মানুষের মৃত্যু হতে পারে। তিনি বেশি শিশু জন্মাতে চান। কিন্তু তারা বাঁচবে কি না, সে বিষয়ে তার আগ্রহ কম। অন্যথায় ‘জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণ’-এর সমর্থকরা যদি কিছু প্রভাব ফেলেন, তবে তার ফল ভিন্ন হবে। দীর্ঘ সময়ের ব্যবধানের কারণে এ প্রভাব জমতে থাকে। এর ফলে পতন আরও দ্রুত হবে। বক্ররেখার অন্য পাশে ধস নামবে। অনেকে এ ভুল ধারণার পেছনে জীবন কাটিয়েছেন। প্রমাণ চলে যাওয়ার পরও তারা এ ধারণা আঁকড়ে ধরে কেন। এর একটি কারণ আছে। জনসংখ্যা বৃদ্ধি একটি সুবিধাজনক দোষারোপের লক্ষ্য। এটি ভোগবাদের ক্ষতি থেকে মনোযোগ সরিয়ে দেয়। বিশ্বের উত্তরের ধনী মানুষ এতে লাভবান হয়। তারা দক্ষিণের দরিদ্র কৃষ্ণ ও বাদামি মানুষকে দোষ দেয়। পরিবেশ সংকট আসলে তারাই তৈরি করেছে। গাছভিত্তিক খাদ্যে যাওয়া এখনই সম্ভব। জীবাশ্ম জ্বালানি ছেড়ে নবায়নযোগ্য জ্বালানিতে যাওয়াও সম্ভব। এসব কাজ মানবিক ও কার্যকর।
এসব কাজ এখনই করা যায়। কিন্তু মানুষের সংখ্যা বদলানো তাৎক্ষণিক নয়। অন্যকে দোষ দিলে নিজের কিছু বদলাতে হয় না। ক্ষমতার সঙ্গে মুখোমুখি হতে হয় না। অভিবাসন না থাকলে কয়েক প্রজন্মের মধ্যেই ইউরোপ থাকবে না। যুক্তরাজ্যও থাকবে না। আজকের বর্ণবাদী চিন্তা তখন অবোধ্য মনে হবে। তখন আমাদের বয়স্ক উত্তরসূরিরা তরুণ খুঁজবে। তারা দেখভাল করার মানুষ চাইবে। দেশ চালানোর মানুষ চাইবে। অল্প সময়ের মধ্যেই আমরা বিদেশি মানুষ টানতে লড়ব। কিন্তু রান্সিম্যান একটি কথা বলেন। তিনি বলেন, ‘শিগগিরই পর্যাপ্ত অভিবাসীও থাকবে না।’
হয়তো এ কারণেই ইয়ান ম্যাকইয়ানের নতুন উপন্যাসে একটি ছবি দেখা যায়। উপন্যাসটির নাম হোয়াট উই ক্যান নো। গল্পটি ভবিষ্যতের ১০০ বছর পরে। সেখানে বিশ্বের প্রধান শক্তি নাইজেরিয়া। নাইজেরিয়ার প্রজনন হার এখনো ২ দশমিক ১-এর ওপরে। তবে সেখানেও হার দ্রুত কমছে। ট্রাম্পের নিরাপত্তা কৌশল অদ্ভুত। এটি ভয়ংকরও। এটি সব কট্টর ডানপন্থি রাজনীতির মতোই। সবচেয়ে বড় কথা, এটি ভুল।
লেখক: দ্য গার্ডিয়ানের কলাম লেখক। গার্ডিয়ানে প্রকাশিত নিবন্ধটি ভাষান্তর করেছেন আবিদ আজাদ
মন্তব্য করুন