

সমাজ প্রতিনিয়ত পরিবর্তনশীল। পরিবর্তনশীলতা সভ্যতার অন্যতম বৈশিষ্ট্য। বিশ্বায়ন, সামাজিক বিবর্তন ও প্রগতির মধ্যেই বর্তমান সমাজের অবস্থান। বিবর্তিত সমাজে সাধারণ মানুষ বিবিধ কারণে শঙ্কিত ও বিব্রত। বিশেষত নারী ও কিশোরীরা নৈতিক অবক্ষয়জনিত সমস্যায় পতিত। বর্তমানে অনেকেই চলমান সমাজে ইতিবাচকভাবে খাপ খাওয়াতে পারে না। তারা সামাজিক প্রথা, রীতিনীতি, মূল্যবোধ, সংস্কৃতি ও সামাজিক কাঠামো লঙ্ঘন করছে। সমাজের সদস্যদের এরূপ প্রতিক্রিয়া সামাজিক অবমাননা, সভ্যতার বিনাশ ও অবক্ষয়ের চিত্র। বিশেষত নারী, কিশোর-কিশোরী ও কন্যাশিশুরা মর্যাদাহানিকর অবস্থা এবং অপব্যবহারের শিকার হচ্ছে। সংবাদমাধ্যমে প্রায় নারী ধর্ষণ, শিশু ধর্ষণ, নারী অপহরণ, বাল্যবিবাহ বিরোধ, পতিতাবৃত্তি, যৌতুক দাবি ও নারী সহিংসতামূলক প্রতিবেদন প্রকাশিত হচ্ছে। এতে কলুষিত হচ্ছে সমাজ। ক্ষয়প্রাপ্ত হচ্ছে সামাজিক মূল্যবোধগুলো। সমাজ থেকে বিলুপ্ত হচ্ছে—নৈতিকতা, সততা, ধৈর্য, শিষ্টাচার, সৌজন্যবোধ, নিয়মানুবর্তিতা, পারস্পরিক শ্রদ্ধা ও কল্যাণবোধসহ মানবিক গুণাবলিগুলো। ফলে সামাজিক সংহতি ও সামাজিক নিয়ন্ত্রণ বিঘ্নিত হচ্ছে। তাই সরকার অবক্ষয়গ্রস্ত নারী ও শিশু-কিশোরীর নিরাপত্তা, সুরক্ষা এবং সামাজিক মর্যাদা পুনঃপ্রতিষ্ঠার জন্য প্রাতিষ্ঠানিক হেফাজত হিসেবে সেফহোম কর্মসূচি পরিচালনা করছে।
রাষ্ট্র একটি বৃহৎ সামাজিক সংগঠন। ব্যক্তি পর্যায়ে সমস্যা সমাধানের পন্থা নিয়ে রাষ্ট্র ব্যবস্থার উদ্ভব। যার অন্যতম উদ্দেশ্য রাষ্ট্রের সব নাগরিকের কল্যাণ, সুরক্ষা ও উন্নয়ন নিশ্চিত করা। এ লক্ষ্যে সরকার গড়ে তোলে বিভিন্ন দপ্তর, বিভাগ ও মন্ত্রণালয়। সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয়াধীন সমাজসেবা অধিদপ্তর একটি বহুমুখী কর্মসূচি সমৃদ্ধ দপ্তর। এ দপ্তরই আমার কর্মক্ষেত্র। এ দপ্তরের অন্যতম কার্যাবলি হচ্ছে, আইনের সংস্পর্শে আসা শিশু বা আইনের সঙ্গে সংঘাতে জড়িত শিশুর হেফাজত করা। একসঙ্গে অপরাধপ্রবণ ব্যক্তিদের উন্নয়ন, আবেক্ষণ ও আফটার কেয়ার সার্ভিস বাস্তবায়ন করা। এ পরিপ্রেক্ষিতে সমাজসেবা অধিদপ্তর সামাজিক অবক্ষয়গ্রস্ত নারী ও শিশু-কিশোরীদের রাষ্ট্রীয় উদ্যোগে নিরাপদ আবাসন প্রদান করছে। সমাজসেবা অধিদপ্তর পরিচালিত ‘সেফহোম’ নামক প্রাতিষ্ঠানিক কার্যক্রম একটি সামাজিক অবক্ষয় প্রতিরোধমূলক উদ্যোগ হিসেবে বিবেচিত।
গত ২৬ নভেম্বর মাসিক পরিদর্শনসূচি অনুযায়ী চট্টগ্রাম বিভাগাধীন পরিচালিত সেফহোম পরিদর্শন করি। চলমান কর্মসূচিগুলোর প্রভাব মূল্যায়নে এরূপ পরিদর্শন একটি আবশ্যিক দায়িত্ব। যার উদ্দেশ্য কর্মসূচির বাস্তবায়ন, পরিকল্পনা প্রণয়ন ও পন্থা নির্ধারণে কর্তৃপক্ষের কাছে মতামত পেশ করা। পরিদর্শনকালে দেখা যায় এ প্রতিষ্ঠানে মোট ৮৩ জন নারী ও শিশু-কিশোরী নিরাপদ হেফাজতি হিসেবে অবস্থান করছে। যারা নারী ও শিশু নির্যাতন আইন, মানব পাচার প্রতিরোধ আইন ও থানায় দায়েরকৃত ডায়েরি মূলে হেফাজতি হিসেবে অবস্থান করছেন। সেফহোমে অবস্থানরত বিভিন্ন ক্যাটাগরির হেফাজতির সঙ্গে সাক্ষাৎ গ্রহণ করি। কেসভিত্তিক বিশ্লেষণ ও বর্ণনা থেকে বোঝা যায় দেশে চলমান সামাজিক নিষ্ঠুরতা ও অবক্ষয়ের চিত্র। আমাদের নারী ও শিশু-কিশোরীরা প্রলোভন, দারিদ্র্য ও কর্মসংস্থানের সন্ধান করতে গিয়ে ধর্ষণের শিকার হচ্ছে। তা ছাড়া কিশোর-কিশোরীদের অপরিণত প্রেম, অকাল গর্ভধারণ ও অভিভাবকের অস্বীকৃতিতে সৃষ্টি হয় পারিবারিক বিরোধ। এ ক্ষেত্রে কন্যাশিশু ও কিশোরীরা আদালতের আদেশ বা থানার ডায়েরি মূলে তাৎক্ষণিক নিরাপত্তার জন্য রাষ্ট্রীয় হেফাজত অত্যাবশ্যক। তা ছাড়া অনেকে নারী-কিশোরী অভিজাত হোটেল বা পর্যটন কেন্দ্রে পতিতাবৃত্তিতে লিপ্ত হয়। যৌনবৃত্তি বা পতিতালয় নিয়ন্ত্রণে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা নিয়মিত অভিযান চালায়। কুরুচিপূর্ণ পেশা পরিহার, মলিনতা নিয়ন্ত্রণ ও নৈতিক অবক্ষয়গ্রস্ত কিশোরীর মর্যাদা রক্ষায় সাময়িক নিরাপদ আশ্রয়ের প্রয়োজন হয়। এরূপ সমস্যাগ্রস্ত নারী ও কিশোরীদের প্রাতিষ্ঠানিক সুরক্ষার কেন্দ্র হিসেবে সমাজসেবা অধিদপ্তর পরিচালিত সেফহেম অনন্য ভূমিকা পালন করছে।
‘সেফহোম’ কী এবং কেন? এ বিষয়ে আমাদের ধারণা সুস্পষ্ট নয়। ‘সেফহোম’ হচ্ছে আদালত নির্দেশিত আশ্রয়কেন্দ্র, যা মূলত অসহায়, নির্যাতিত, পাচারকৃত ও বিপদাপন্ন নারী-শিশু-কিশোরীর নিরাপদ আবাসন। ব্রিটিশ শাসিত বাংলাদেশে সেফহোম ধারণার উদ্ভব ঘটে ১৯৪৩ সালে ভবঘুরে নিরাশ্রয় আইন প্রবর্তনের মাধ্যমে। এ আইনের আওতায় রাস্তায় ভবঘুরে, আশ্রয়হীন বা ঘোরাফেরা করা মানুষকে আটক রাখার জন্য সরকার Vagrants Home বা ভবঘুরে আশ্রয়কেন্দ্র তৈরি করে। পরবর্তী সময়ে ১৯৪৪ সালে বিধবা ও শিশু সদন আইন প্রবর্তিত হয়। এ আইনের মাধ্যমে এতিম, বিধবা ও অসহায় নারীদের সুরক্ষার লক্ষ্যে সরকারিভাবে আশ্রয়কেন্দ্র তৈরির আইনি কাঠামো তৈরি হয়। স্বাধীন বাংলাদেশে প্রথম শিশু আইন প্রবর্তিত হয় ১৯৭৪ সালে। এ আইনে শিশুদের প্রাপ্তবয়স্ক অপরাধী থেকে আলাদা রাখার বিধান আসে। এ ধারাবাহিকতায় ১৯৭৮ সালে গাজীপুরে (টঙ্গী) কিশোর উন্নয়ন কেন্দ্র প্রতিষ্ঠা হয়। যার মাধ্যমে দেশের অপরাধপ্রবণ শিশুদের নিরাপদ পরিবেশে (সেফহোম) রাখার কার্যক্রম শুরু হয়, যা হচ্ছে দেশের সেফহোম ধারণার প্রারম্ভিক রূপ।
বাংলাদেশে সেফহোম ধারণার বিবর্তন হয় গত (১৯৯০-২০০০) শতাব্দীতে। নির্যাতিত ও ভুক্তভোগী নারী-শিশুদের আদালতের নির্দেশে (Safe custody) তে রাখা হতো। কিন্তু পর্যাপ্ত কেন্দ্র না থাকায় এ ধরনের নারী ও শিশু-কিশোরীদের অপরাধী না হয়েও জেলের ভেতরে আলাদা ওয়ার্ডে রাখা হতো, যা আন্তর্জাতিক মানবাধিকার মানদণ্ডের পরিপন্থি। মানবাধিকার আন্দোলন ও হাইকোর্ট প্রদত্ত যুগান্তকারী রায়ের মাধ্যমে বাংলাদেশে প্রকৃত সেফহোম ধারণার সূচনা। অপরাধ না করেও নারী-শিশুকে জেলে রাখা মানবাধিকার লঙ্ঘন। তাদের জন্য কারাগারের বাইরে নিরাপদ আশ্রয়কেন্দ্র প্রয়োজন। এ দাবি তুলে BNWLA, BLAST প্রভৃতি সংগঠন হাইকোর্টে রিট দায়ের করা। এ পরিপ্রেক্ষিতে হাইকোর্টে ঐতিহাসিক রায় কোনো নারী বা শিশুকে কারাগারের Safe custody-তে রাখা যাবে না। তাদের জন্য সম্পূর্ণ পৃথক ও মানবিক পরিবেশের নিরাপদ আবাসন কেন্দ্র Safe Home তৈরি করতে হবে। তা ছাড়া গত শতকে (১৯৬০-৭০) যুক্তরাজ্য, যুক্তরাষ্ট্র, কানাডাসহ প্রভৃতি দেশে Women Shelter Movement বা সেফহোম ধারণা জোরদার হয়। বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংগঠন UNICEF, UNFPA, Save the Children দক্ষিণ এশিয়ায় নারীর নিরাপত্তা ও শিশু সুরক্ষা প্রকল্পে অর্থায়ন ও নীতি সহায়তা প্রদান করে। এ প্রেক্ষাপটে দেশে রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতায় প্রাতিষ্ঠানিক উদ্যোগ হিসেবে সেফহোম কার্যক্রমের প্রচলন হয়।
দেশের প্রচলিত সামাজিক অবস্থায় অনেক নারী ও শিশু-কিশোরী আইন সংস্পর্শে আসছে, কিন্তু অপরাধী নয়। বাংলাদেশ সরকার ওইসব মহিলা ও শিশু-কিশোরীর নিরাপদ হেফাজতখানা হিসেবে পৃথক সেফহোম ব্যবস্থা প্রবর্তন করে চলতি শতাব্দীর শুরুতে। ২০০২ সালের ২৪ এপ্রিল তৎকালীন প্রধানমন্ত্রীর মুখ্য সচিবের সভাপতিত্বে এক আন্তঃমন্ত্রণালয়ের সভা অনুষ্ঠিত হয়। সভায় গৃহীত সিদ্ধান্তক্রমে সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয়াধীন সমাজসেবা অধিদপ্তর কর্তৃক ‘মহিলা ও শিশু-কিশোরী হেফাজতিদের নিরাপদ আবাসন (সেফহোম)’ চালু করা হয়। সমাজসেবা অধিদপ্তর ১৪ জুলাই ২০০২ সালে পরিপত্র জারির মাধ্যমে প্রাথমিক পর্যায়ে বরিশাল ও সিলেট জেলায় দুটি সেফহোম চালু করে। পরবর্তী সময়ে ঢাকায় দুটি এবং চট্টগ্রাম, রাজশাহী ও খুলনায় একটি করে সেফহোম চালু করা। বর্তমানে দেশে পরিচালিত মোট সেফহোম সংখ্যা সাতটি। এ প্রতিষ্ঠানগুলো সামাজিক অবক্ষয় প্রতিরোধকল্পে পরিচালিত হচ্ছে।
প্রত্যেক মানুষ মর্যাদা নিয়ে বাঁচতে চায়। সামাজিক অবক্ষয়ের কারণে দেশের নারী ও কিশোরীরা চরম মর্যাদাহানিকর অবস্থায় পতিত হচ্ছে। সমস্যাগ্রস্ত ও সামাজিক অপরাধপ্রবণ মানুষের সম্ভ্রম রক্ষার জন্য প্রাতিষ্ঠানিক উদ্যোগ থাকা চাই। দেশের সমাজ ব্যবস্থায় নারীরা বিবিধ কারণে অপদসর শিকার হন। তবে এটি নারীর জীবনে দীর্ঘমেয়াদি প্রভাব বিস্তার করে। এ ক্ষেত্রে অবক্ষয়গ্রস্ত নারী বা শিশু-কিশোরীদের সামাজিক কুৎসা, অপবাদ, অবজ্ঞা ও বৈষম্যে পতিত করে। এক্ষেত্রে নারী হিসেবে ব্যক্তিগত সম্মান সংকটাপন্ন হয়। এ ক্ষেত্রে সে সমাজ থেকে বিতাড়িত হয় এবং নিশ্চিহ্ন হয় ব্যক্তি ইমেজ। এসব বিপদাপন্ন ও বিপদগ্রস্ত নারীর সুরক্ষার প্রাতিষ্ঠানিক উদ্যোগ অত্যাবশ্যক। এ ক্ষেত্রে সেফহোম তাদের শারীরিক ও মানসিক অবস্থার উন্নয়ন, মর্যাদা প্রতিষ্ঠা ও সামাজিক পুনর্বাসনে অনন্য ভূমিকা পালন করতে পারে। তাই সমাজসেবা অধিদপ্তর পরিচালিত সেফহোম ব্যবস্থাপনার আধুনিকায়ন একান্ত জরুরি।
লেখক: অধ্যক্ষ, জাতীয় সমাজসেবা একাডেমি, ঢাকা
মন্তব্য করুন