

প্রযুক্তির দুর্বার গতি আমাদের নাগরিক জীবনকে করছে সহজ থেকে সহজতর। অসম্ভবকে করে তুলেছে সম্ভব। খুলে দিয়েছে এক অপার সম্ভাবনার দ্বার। ডিজিটাল যুগে আমরা এমন এক অবস্থায় এসে পৌঁছেছি যে, ‘দেখা’ আর ‘বিশ্বাস’ একই অর্থ বহন করে না। নিজের চোখে যা দেখি, নিজের কানে যা শুনি, তাও ভুল প্রমাণিত হবে বা নিজেকে মিথ্যা প্রমাণিত করবে। সব দেখায় যেন সত্য নয় এমন এক অবস্থা। এআই নতুন এক সম্ভাবনার দুয়ার ঠিকই খুলে দিয়েছে, তবে এর অপব্যবহার বিশ্বজুড়ে তথ্য প্রবাহকে হুমকির মুখে ফেলছে। বিশেষত এআইচালিত ফেক কনটেন্ট গণমাধ্যমের জন্য হয়ে উঠছে এক নতুন ও কঠিন চ্যালেঞ্জ।
কয়েক বছর আগেও যখন একটা ছবি বা ভিডিও বানানোর জন্য একজন দক্ষ মানুষের প্রয়োজন হতো, বর্তমান সময়ে এসে দাঁড়িয়ে সহজেই এআই টুল ব্যবহার করে চমৎকার সব ছবি এবং ভিডিও বানানো সম্ভব হচ্ছে মাত্র খুবই অল্প সময়ে। Generative AI মডেল, টেক্সট টু ইমেজ জেনারেটর, ভয়েস ক্লোনিং সফটওয়্যার এবং ডিপফেক টুল সবই এখন সাধারণ মানুষের হাতের লাগালে চলে এসেছে। সুবিধা এবং ঝুঁকি দুটি যেন পরিপূরক হয়ে দাঁড়িয়েছে।
ডিপফেক প্রযুক্তি হলো এমন একটি শক্তিশালী প্রযুক্তি যেটা মাত্র কয়েক সেকেন্ডের মধ্যে একজন মানুষের ফেস, কণ্ঠস্বর, অঙ্গভঙ্গি এমনকি তার অনুভূতিকেও হুবহু নকল করে ফেলতে পারে। ডিপফেক একজন বক্তার বক্তৃতা সম্পূর্ণ বিকৃত করে ভিন্ন বার্তা প্রচার করতে পারে, জনপ্রিয় কোনো ব্যক্তিকে আপত্তিকর অবস্থায় দেখানো, কারও কণ্ঠ নকল করে প্রতারণা করাসহ আরও অনেক কিছু অনেক বেশি সহজ করে দিয়েছে এ আধুনিক প্রযুক্তি। ডিপফেকের সবচেয়ে ভয়াবহ দিক হচ্ছে—এটা শুধু মিথ্যা তথ্যই ছড়ায় না বরং মানুষের মন-মানসিকতা, বিশ্বাস এবং সামাজিক স্থিতিশীলতা গভীরভাবে প্রভাবিত করে। আবার এআইচালিত ইমেজ জেনারেটর, যা একটি বাক্য বা কয়েকটি নির্দেশনা থেকেই বাস্তবসম্মত ছবি তৈরি করতে পারে। গণমাধ্যমে ছবি সবসময় একটি বিশ্বাসযোগ্য প্রতীক ছিল। কিন্তু এখন তথ্যপ্রযুক্তির এ যুগে এই প্রতীকই এখন প্রশ্নবিদ্ধ। এ ছাড়া রয়েছে ভয়েস ক্লোনিং, যার মাধ্যমে যে কোনো ব্যক্তির কণ্ঠস্বর নকল করে আর্থিক লেনদেন, গোপনীয় তথ্য আদানপ্রদান, এমনকি ব্যক্তিগত বিশৃঙ্খলা তৈরিতেও ব্যবহার করা হচ্ছে।
প্রযুক্তি যেমন সব তথ্য হাতের মুঠোয় এনে দিয়েছে, ঠিক তেমনি তথ্যের যাচাই-বাছাইও আগের থেকে কঠিন হয়ে গেছে। সংবাদমাধ্যমের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কাজ হলো তথ্যের সত্যতা যাচাই করা, যা মিডিয়াকর্মীদের জন্য এখন অনেক বেশি চ্যালেঞ্জিং।
সামাজিক মাধ্যমে খবর ছড়ানোর গতি এত দ্রুত যে, গণমাধ্যমগুলো প্রতিযোগিতায় টিকে থাকতে চেয়ে মাঝেমধ্যে কোনো যাচাই-বাছাই ছাড়াই অথবা কোনো কোনো সময় অনিচ্ছাকৃতভাবে ভুয়া তথ্য প্রচার করে ফেলে, যা গণমাধ্যমের ওপর আস্থা ধরে রাখার বিরাট চ্যালেঞ্জ তৈরি করে।
ভোটারদের বিভ্রান্ত করতে, নেতাদের বিরুদ্ধে মিথ্যা অভিযোগ আনতে ডিপফেক একটি ভয়াবহ অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করা হচ্ছে। ধর্মীয় বা জাতিগত উত্তেজনা ছড়িয়ে দিতে এবং সমাজে সহিংসতা বাড়াতে এসব প্রযুক্তি ব্যবহার করছে। ভয়েস ক্লোনিং ও ফেক ডকুমেন্ট ব্যবহার করে ব্যাংক প্রতারণা, ভুয়া বিনিয়োগ এবং করপোরেট গুপ্তচরবৃত্তিও বাড়ছে।
আধুনিক প্রযুক্তি জীবনকে অনেক বেশি সহজ করে দিয়েছে; তবু রয়েছে অনেক জীবন বিধ্বংসী ক্ষতিকর দিক। ক্ষতির হাত থেকে বাঁচতে দরকার সতর্কতা। গণমাধ্যমকে এখন নিজস্ব এআইভিত্তিক ডিপফেক ডিটেকশন সিস্টেম ব্যবহার করতে হবে। সাংবাদিকদের এসব বিষয়ে প্রশিক্ষণ দিতে হবে। ফ্যাক্ট চেকিং টিম শক্তিশালী করতে হবে যেমন বিশেষজ্ঞ, প্রযুক্তিবিদ ও সাংবাদিকদের সমন্বয়ে দল গঠন করতে হবে। জনসচেতনতা ছাড়া ফেক কনটেন্ট রোধ অসম্ভব। পাঠক বা দর্শকদের সচেতনতা বৃদ্ধি করতে হবে। সর্বশেষ নীতি ও আইন প্রণয়নের সঙ্গে প্রয়োগও করতে হবে। সরকার ও প্রযুক্তি প্রতিষ্ঠান একসঙ্গে কাজ করে দায়িত্ব নির্ধারণ, শাস্তি ও নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা নিশ্চিত করতে হবে। সর্বোপরি আমরা এখন বলতে পারি যে, সত্যের যুদ্ধ এখন প্রযুক্তির বিরুদ্ধে। তথ্যই আজ শক্তি; সেই শক্তিকে সঠিকভাবে ব্যবহার করতে হলে দরকার প্রযুক্তির পাশাপাশি সততা, দায়িত্ববোধ ও সচেতনতা।
তানিয়া আক্তার, শিক্ষার্থী
গণিত বিভাগ, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়
মন্তব্য করুন