নির্বাচন কমিশন (ইসি) গত ১৩ ডিসেম্বর সভা-সমাবেশ বন্ধের জন্য স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়কে চিঠি দিয়ে দেশব্যাপী নতুন আলোচনার জন্ম দিয়েছে। যেহেতু প্রার্থীরা ১৮ ডিসেম্বর থেকে নির্বাচনী প্রচার শুরু করবেন, তাই নির্বাচনী পরিবেশ বিঘ্নিত হতে পারে বা ভোটারদের ভোটদানে নিরুৎসাহিত করতে পারে—এমন সভা-সমাবেশ বা কোনো ধরনের রাজনৈতিক কর্মসূচি পালন করা থেকে বিরত থাকার জন্য ইসির চাহিদা পূরণের জন্য স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় সবাইকে নির্দেশ দিয়েছে।
এখন প্রশ্ন উঠেছে, অত্যন্ত কঠোর জামিন অযোগ্য, কম সময়ে বিচার এবং মৃত্যুদণ্ড বা যাবজ্জীবনের বিধান রেখে প্রণয়ন করা সন্ত্রাসবিরোধী আইন-২০০৯ থাকা সত্ত্বেও সংবিধানে প্রদত্ত নাগরিক অধিকার খর্ব করে কেন ইসি বাক-ব্যক্তিস্বাধীনতা, সভা-সমাবেশ ও শোভাযাত্রা বন্ধ করতে চায়। গুঞ্জন আছে, বিরোধী দল সংগঠিত হয়ে নতুন করে কঠোর আন্দোলনের কর্মসূচি নিয়ে মাঠে নামতে পারে, তা নিয়ন্ত্রণ করতেই এ পদক্ষেপ নিয়েছে ইসি।
অনেকে বলছেন, সভা-সমাবেশ ও শোভাযাত্রা বন্ধ করলে চোরাগোপ্তা হামলায় ধ্বংসাত্মক ঘটনা ঘটার ও সংঘাত-সহিংসতার পরিস্থিতি সৃষ্টি হতে পারে। সেইসঙ্গে ভোটারদের ভোট দিতে নিরুৎসাহিত করে সংকট আরও ঘনীভূত করতে পারে। আগেও অহেতুক দায়িত্বের বাইরে গিয়ে ইসির পক্ষ থেকে অতিকথন ও বেশ কয়েকটি ইস্যু তৈরি করে বিতর্কের জন্ম দিয়েছিল। ফলে বিরোধী দলগুলোর ইসির ওপর এক ধরনের নেতিবাচক মনোভাব তৈরি হয়।
যেমন—অপ্রয়োজনে সিইসি বিরোধী দলকে নির্বাচনে জেলেনস্কির মতো লড়তে বলেছিলেন, একজন কমিশনার বলেছিলেন, ‘এক পার্সেন্ট ভোট পড়লেও নির্বাচন বৈধ্য হবে’, আরেকজন কমিশনার বলেছিলেন, ‘কোনো দল নির্বাচনে না এলে তাকে আনার দায়িত্ব ইসির নয়’, আবার আরেকজন কমিশনার বলেছিলেন, ‘কেউ নির্বাচনে না এলেও নির্বাচন যথাসময়ে হবে’ ইত্যাদি।
মাঠে ক্রিয়াশীল থাকা গণঅধিকার পরিষদ, এবি পার্টি, গণসংহতি আন্দোলন ও বাংলাদেশের বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টির মতো রাজনৈতিক দলগুলো থাকা সত্ত্বেও বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী আন্দোলন (বিএনএম) ও বাংলাদেশ সুপ্রিম পার্টি (বিএনএম)সহ কয়েকটি নতুন রাজনৈতিক দল নিবন্ধন পেয়ে আলোচনার ঝড় তোলে। জনমনে প্রশ্ন, ইসি কি আদিষ্ট হয়ে এ দলগুলোকে নিবন্ধন দিয়েছিল বিএনপিকে ভাঙার জন্য।
ইসি গণপ্রতিনিধিত্ব (সংশোধন) আইন-২০২৩ ও সংবিধানের বিধান অনুযায়ী ও সংবিধানে প্রদত্ত জনগণের মৌলিক মানবাধিকার রক্ষা করে বাক-ব্যক্তিস্বাধীনতা ও সভা-সমাবেশের অধিকার সমুন্নত রেখে নির্বাচন পরিচালনা করবে।
সংবিধানের ১১৮ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী নির্বাচন কমিশন গঠন হয়। এই অনুচ্ছেদে বলা আছে, নির্বাচন কমিশন দায়িত্ব পালনের ক্ষেত্রে স্বাধীন থাকিবে এবং কেবল এই সংবিধান ও আইনের অধীন হইবে। সংসদ কর্তৃক প্রণীত যে কোনো আইনের বিধানাবলি সাপেক্ষে নির্বাচন কমিশনারদের কর্মের শর্তাবলি রাষ্ট্রপতি আদেশের দ্বারা যেরূপ নির্ধারণ করিবেন।
এ ছাড়া সংবিধানের ৩৭ অনুচ্ছেদে সমাবেশের স্বাধীনতার নিশ্চয়তা দিয়ে বলা হয়েছে, ‘জনশৃঙ্খলা বা জনস্বাস্থ্যের স্বার্থে আইনের দ্বারা আরোপিত যুক্তিসংগত বাধানিষেধ-সাপেক্ষে শান্তিপূর্ণভাবে ও নিরস্ত্র অবস্থায় সমবেত হইবার এবং জনসভা ও শোভাযাত্রায় যোগদান করিবার অধিকার প্রত্যেক নাগরিকের থাকিবে।’
মৌলিক মানবাধিকার সংরক্ষণে সংবিধানের ৩২ অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, ‘আইনানুযায়ী ব্যতীত জীবন ও ব্যক্তি-স্বাধীনতা হইতে কোনো ব্যক্তিকে বঞ্চিত করা যাইবে না।’ এই অধিকার জাতিসংঘের মানবাধিকার-ঘোষণাপত্রে রয়েছে যাতে বাংলাদেশ স্বাক্ষরদাতা দেশ এবং এই অধিকারের ভিত্তিতে বিশ্বের বহু দেশে মৃত্যুদণ্ড নিষিদ্ধ করা হয়েছে।
সংবিধানের তৃতীয় ভাগ ‘মৌলিক অধিকার’-এর ২৬ অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, জনগণের মৌলিক অধিকারের সঙ্গে অসামঞ্জস্যপূর্ণ কোনো আইন করা যাবে না। আর যদি করা হয়, তবে তা স্বতঃসিদ্ধভাবে বাতিল হয়ে যাবে এবং মৌলিক অধিকারের পরিপন্থি পূর্বেকার সব আইন সাংবিধানিকভাবে অবৈধ। মৌলিক অধিকার শারীরিক ও মানসিক সীমানা সংকোচনকারী কৃত্রিম বাধা অতিক্রম করে মুক্তি ও ন্যায়বিচারের পরিবেশ নিশ্চিত করে নাগরিকদের জীবন মর্যাদাপূর্ণ করে।
সুতরাং ইসির সভা-সমাবেশ বন্ধ ও মানবাধিকার খর্ব করার প্রচেষ্টা তার এখতিয়ারবহির্ভূত। ইসির এ পদক্ষেপ তার ওপর জনমনে নতুন করে আরেক দফা আস্থার সংকট তৈরি করল।
লেখক: জ্যেষ্ঠ সাংবাদিক ও কলামিস্ট