সৈয়দ ইশতিয়াক রেজা
প্রকাশ : ২৫ জানুয়ারি ২০২৪, ০৩:১৯ এএম
আপডেট : ২৫ জানুয়ারি ২০২৪, ০৩:০২ পিএম
প্রিন্ট সংস্করণ

শিক্ষিত গোঁড়া

শিক্ষিত গোঁড়া

সমাজের ভেতর পচন ধরে গেছে। ঘটেছে অনেক দিন আগেই। রোগ দানা বেঁধেছে একেবারে গভীরে। মাঝেমধ্যেই তার প্রকাশ উগ্রভাবে ঘটছে। ধর্মান্ধতার যূপকাষ্ঠে বলি হচ্ছে সমাজ। মনে হয় যেন এক অজানার পথে এগিয়ে চলছে আমাদের বাংলাদেশ।

পাঠ্যবই ছিঁড়ে আলোচনায় আসা খণ্ডকালীন শিক্ষক আসিফ মাহতাব কিন্তু কাগজে-কলমে শিক্ষিত লোক। নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়েছেন, বড় ডিগ্রি নিয়েছেন বাইরের বিশ্ববিদ্যালয় থেকে। কিন্তু তার মনোজগৎ কুসংস্কার, সাম্প্রদায়িকতা ও উগ্রবাদে ভরা।

মাত্রই ডিসেম্বর মাস গেল। আমরা কত কথা বলেছি মুক্তিযুদ্ধের চেতনা নিয়ে। সবসময় আমাদের বিশ্বাস ছিল ধর্মে, কিন্তু আমাদের বড় চাওয়া ছিল মানবিকতা। মানুষকে ধর্ম দিয়ে বিচার করার যে হীন সংস্কৃতি পাকিস্তানিরা আমাদের শিখিয়েছিল, তা আমরা প্রত্যাখ্যান করেছিলাম ১৯৭১-এ। কিন্তু কেমন করে তা ফিরে এলো এ দেশে?

শিক্ষা যে শুধু সার্টিফিকেট থেকে আসে না, আসে উদার মূল্যবোধ থেকে, সেটা আরেকবার প্রমাণ করলেন আসিফ মাহতাব। তিনি উদার ও মানবিক দেশে শিক্ষা লাভ করেছেন, কিন্তু নিজে উদার হতে পারেননি। হলে ট্রান্সজেন্ডারদের মানুষের মর্যাদা দিতে শিখতেন।

গত শুক্রবার রাজধানীর কাকরাইলে ইনস্টিটিউট অব ডিপ্লোমা ইঞ্জিনিয়ার্সে ‘বর্তমান কারিকুলামে নতুন পাঠ্যপুস্তক: বাস্তবতা ও ভবিষ্যৎ’ শীর্ষক সেমিনারে নতুন কারিকুলামে যুক্ত হওয়া ট্রান্সজেন্ডার ইস্যু নিয়ে সমালোচনা করেন তিনি। জাতীয় শিক্ষক ফোরাম আয়োজিত সেমিনারে বক্তব্যের একপর্যায়ে সপ্তম শ্রেণির ইতিহাস ও সামাজিক বিজ্ঞান পাঠ্যবইয়ের ‘শরীফ থেকে শরীফা’র গল্পের পাতা ছিঁড়ে ফেলেন তিনি। তার কথা হলো, এ গল্পে সমকামিতাকে সমর্থন করা হয়েছে। গল্পটি যারা পড়েছেন তারা দেখেছেন যে মোটেও তা নয়। অর্থাৎ আসিফ অসত্য বয়ান দিচ্ছেন এবং মৌলবাদী শক্তিকে উসকে দিচ্ছেন। হিজড়া ও ট্রান্সজেন্ডারদের প্রতি মানুষ হিসেবে সহমর্মিতা দেখানো, ঘৃণা না করার কথা বলা হয়েছে। এমনকি যদি বলাও হতো, তবুও একজন শিক্ষক হিসেবে তিনি কি বই ছিঁড়তে পারেন? এটি তো রীতিমতো অপরাধের শামিল।

মজার ব্যাপার হলো, আসিফ মাহতাব গ্লাসগো বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়েছেন। এ বিশ্ববিদ্যালয় তাদের গে কমিউনিটিকে সাপোর্ট করার কারণে বিখ্যাত। আর সেই বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র কি না এমন গোঁড়া! এই মানসিকতার জন্য আসিফ পশ্চিমের কোনো বিশ্ববিদ্যালয়েই পড়াতে পারবেন না। এমনকি এশিয়ার কোনো ভালো বিশ্ববিদ্যালয়েও না। একজন শিক্ষিত মানুষ, অথচ একটা নির্দিষ্ট জেন্ডারের মানুষকে মানুষ বলেই মনে করছেন না তিনি! শুধু জেন্ডারের জন্য তাদের অন্যায়ভাবে ঘৃণা ছড়াচ্ছেন তিনি। যারা আসিফের সমর্থনে নেমে পড়েছেন তারা গল্পটি অনেকে পড়েননি। আবার পড়েও ভুল সুরে গাইছেন। পশ্চিমা সমাজে থেকে, সেখানকার খোলামেলা জীবনের সঙ্গে উদাম হওয়ার ছবি যারা ফেসবুকে দিচ্ছেন, তারাও ব্র্যাক বয়কটের ডাক দিচ্ছেন। ভিন্ন শারীরিক গঠন ও মনোজগতের মানুষের প্রতি ঘৃণা ছড়াচ্ছেন।

আসিফ বেশি বেশি ইসলাম ধর্মের কথা বলছেন। কিন্তু তার ফেসবুক ওয়াল ঘুরে মানুষ ছবি বের করে এনে দেখাচ্ছেন যে, তিনি মদ্যপান করেন। তার মেয়ে বান্ধবীদের সঙ্গে খোলামেলা ছবিও আছে। এগুলো সবই হচ্ছে প্রতিক্রিয়া হিসেবে। আমি নিজে এগুলোকে গুরুত্ব দিতে চাই না। আসিফ তার জীবন কীভাবে ভোগ করবেন সেই স্বাধীনতা তার আছে। কিন্তু সেই তিনিই যখন আবার শুধু নিজের মতের সঙ্গে মিলে না বলে বই ছিঁড়ে ফেলেন, তখন সেটা আর ব্যক্তিগত থাকে না। যারা তাকে সমর্থন দিচ্ছেন তারাও ভেবে দেখতে পারেন যে, তাদের পছন্দের কিতাব যদি কেউ ছিঁড়ে ফেলে সেটা কি তারা মানবেন?

সাধারণ মানুষের মধ্যে গোঁড়া ও সাম্প্রদায়িক মনোভাবাপন্ন মানুষ কম। বরং দেখা যায় শিক্ষিত সম্প্রদায়ের মধ্যেই এটি যেন বেশি। এ কারণেই এক আতঙ্ক ধীরে ধীরে গ্রাস করছে চারদিক থেকে। শিক্ষিত সমাজের এক অংশ যুক্তিকে হারিয়ে, বিকৃত আবেগের দ্বারা পরিচালিত হয়ে সহিংসতা আর উগ্রবাদ ছড়াচ্ছে। গোঁড়ামি আর অশিক্ষা আমাদের সমাজের অনেক গভীরে প্রবেশ করেছে।

শিক্ষিত গোঁড়ারা সমাজ এবং সংস্কৃতিকে ধর্মীয় মোড়কে সবসময় ব্যাখ্যা করতে চায়। এর ফলে সমস্যার গতিপ্রকৃতি সবসময় হয়ে ওঠে একমুখী। বিস্তার লাভ করে মতের বিভিন্নতা আর বিদ্বেষ। আমরা দাবি করি আধুনিক বাংলাদেশ, অথচ মানসিকতার বিচারে এখনো আমরা অন্ধকারবিলাসী।

মানবধর্মের মূল কথা ভালোবাসা। তাকে বাদ দিয়ে সভ্যতা বাঁচে না। আমাদের এমন শিক্ষিত সমাজ সভ্যতা-পরিপন্থি। বাংলাদেশের অর্থনৈতিক আর সামাজিক অগ্রগতি আজ বিশ্বদরবারে সমাদৃত। অর্থনীতির উন্নয়নেই সবার উন্নয়ন। উন্নয়ন মানে তো মন-মানসিকতার উন্নতিও। কিন্তু তা কি হয়েছে আজ? একশ্রেণির শিক্ষিত জনগোষ্ঠীও যেভাবে সংখ্যালঘুবিদ্বেষী মনোভাব নিয়ে থাকেন, যেভাবে নারী প্রগতিবিরোধী মনোভাব লালন করেন, যেভাবে হিজড়া ও ট্রান্সজেন্ডারদের প্রতি উগ্রতা দেখান, তাতে সব ভালো ভাবনা মুখ থুবড়ে পড়ে।

আসিফ ছিলেন ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের খণ্ডকালীন শিক্ষক। তার মতো এরকম মানসিকতার হাজার হাজার শিক্ষক আছেন বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে। এরা মধ্যযুগীয় চিন্তা-চেতনা লালন-পালন করেন, যদিও এদের পাশ্চাত্য বিশ্ববিদ্যালয়ের ডিগ্রি আছে। সারা দেশের মাদ্রাসায় বহু শিশু হুজুরদের হাতে বলাৎকারের শিকার হয়। ইসলামী বিধানে এটি কবিরাহ গুনাহ জেনেও কি এরা সেই নিকৃষ্ট কাজের প্রতিবাদ করছেন? যেই হুজুররা এই কাজ করেন তারা কত নসিহত করেন সাধারণ মানুষকে, নিজেরা নিবৃত্ত হন না পাপ থেকে। অথচ তারাই পাঠ্যবইয়ে তৃতীয় লিঙ্গের মানুষের স্বাভাবিক জীবনাচারের গল্প মেনে নিতে পারেন না। একটা জেহাদি জোশে নেমে পড়েছেন মাঠে।

এর জন্য কারা দায়ী? দায়ী হলো ক্ষমতাকেন্দ্রিক রাজনীতি। সব রাজনৈতিক নেতৃত্বকেই এ প্রশ্নটার উত্তর খুঁজতে হবে। একটা গোঁড়া ও পশ্চাৎপদ গোষ্ঠীর সঙ্গে আপস করে যে রাজনীতি চলছে তাতে এ অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে। ভোটের হিসাব-নিকাশ করতে গিয়ে কৌশলের নামে এ গোষ্ঠীর মানুষকে নিয়ে রাজনীতি চলছে। কিন্তু তার জন্য ভুগতে হচ্ছে সব মানুষকে, পুরো দেশকে। ভোটসর্বস্ব রাজনীতির শিকার আমাদের এ সম্প্রীতির চারণক্ষেত্র বাংলাদেশে এখন অশান্তি আছড়ে পড়ছে। সম্প্রীতির শান্ত, স্নিগ্ধ বার্তা আজ ঘৃণা আর ভয়ের কালো থাবায় দিশেহারা। যে পরিমাণ হিংস্রতার সমাজে উসকে ছড়িয়ে দেওয়া হচ্ছে, তাতে সভ্যতার অর্থটাই বদলে যাচ্ছে।

টিপ পরে নারী রাস্তায় নামলে কটাক্ষের শিকার হয়। বাসে তরুণী হিজাব না পরায় নিগৃহীত হয়। পূজার সময় মন্দির আক্রান্ত হয়। ধর্মের জিগির তোলে, কাউকে জ্বালিয়ে পুড়িয়ে মেরে ফেলতে গা কাঁপছে না একটি গোষ্ঠীর। চারদিকে শুধু ভয়ের দেয়াল ঘিরে ফেলছে মানুষকে।

শিক্ষিত, সাংস্কৃতিক ও সামাজিকভাবে অগ্রসর শ্রেণির নিশ্চুপ থাকাটাও বড় সমস্যা সৃষ্টি করছে। রাজনৈতিক সিদ্ধিলাভের আশায় এরা কিছুই বলছে না কোনো ইস্যুতে। বিদ্যাবোঝাই শিক্ষিত শ্রেণির একাংশ সুবিধাবাদী হয়ে দাঁড়িয়েছে। পদ-পদবি ছাড়া আর কিছুই বোঝে না এরা। আরেক অংশ অত্যন্ত নিম্নমানের এবং তাদের অন্তরে যে মতাদর্শ, তা অত্যন্ত পশ্চাৎমুখী। আমরা অবাক হয়ে দেখলাম একশ্রেণির তরুণ শিক্ষার্থী আবার ক্যাম্পাসে দাঁড়িয়েছে এমন এক শিক্ষকের পক্ষে। এরা হবে জাতির আগামীর নেতৃত্ব? ভাবতে বিস্ময় লাগে।

সত্যি বলতে কি, এই গোঁড়া, পশ্চাৎমুখী আবহটা এখন আর কথার কথা নয়। দেশেরই প্রতিচ্ছবি যেন। চারদিকে শুধু ভয়ের দেয়াল ঘিরে ফেলছে মানুষকে। বিজ্ঞানকে আগলে ধরে, উদারতাকে আশ্রয় করে নয়, যে শিক্ষিত বিবেক থাকা দরকার তার এখন বড়ই অভাব। যুক্তি দিয়ে সমস্যাকে বোঝা এবং তার সমাধানের চেষ্টা তাই এখন বিশেষভাবে জরুরি। আবার একটা নবজাগরণের খুব দরকার আমাদের।

উন্নয়নের কথা আমরা প্রচারমাধ্যমে ও নাগরিক অঙ্গনে যেভাবে আত্মতৃপ্তির প্রকাশ করি তা অর্থহীন। ধর্মীয় সংখ্যাগরিষ্ঠ তন্ত্রের ভয় দেখিয়ে যারা সমাজকে কবজা করতে চায়, তাদের নিবৃত্ত করবে কে?

লেখক: প্রধান সম্পাদক, গ্লোবাল টেলিভিশন

কালবেলা অনলাইন এর সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিডটি অনুসরণ করুন
  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

ট্রেবল থেকে এক ম্যাচ দূরে কিংস

ইউএস-বাংলা গ্রুপে নিয়োগ, সাপ্তাহিক ছুটি ২ দিন

৪২ জেলায় দাবদাহ, তাপমাত্রা বাড়বে

আমরা রোজা আছি বলায় তারা কিছু করেননি : এমভি আবদুল্লাহর ক্যাপ্টেন

নটর ডেম বিশ্ববিদ্যালয়ে অনুষ্ঠিত হলো ডিবেট ফেস্ট 

কোরবানির ঈদকে সামনে রেখে ভারত থেকে পেঁয়াজ আমদানি শুরু

গবেষণা / সিজারিয়ানে জন্ম নেওয়া শিশুর শরীরে হামের টিকা কম কার্যকর

নাবিকদের বুকে টেনে নিলেন চসিক মেয়র

প্রাথমিকে শিক্ষক নিয়োগের দ্বিতীয় ধাপের চূড়ান্ত ফল বুধবার

মোটরযান গতিসীমা প্রণয়নে সরকারকে অভিনন্দন জানাল রোড সেইফটি কোয়ালিশন

১০

হেরোইনসহ মাদককারবারি আটক

১১

কনডেম সেলে বন্দি রাখা অবৈধ ঘোষণায় হাইকোর্টকে আসক-এর সাধুবাদ 

১২

বিদেশে বসে সন্ত্রাস ও জঙ্গিবাদকে উসকে দেওয়া হয় : দীপু মনি

১৩

২৫ বছর অপেক্ষার পর বিএনপি থেকে জাপায় এসেছি : রুনা খান

১৪

মৃত বাড়ি গিয়ে খাবার খেয়ে অজ্ঞান, হাসপাতালে ৭

১৫

নিয়োগ দিচ্ছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, থাকছে না বয়সসীমা

১৬

জালালাবাদ গ্যাসের বিরুদ্ধে অভিযোগ, মুখ খুললেন ব্যারিস্টার সুমন

১৭

গোসল করতে গিয়ে লাশ হয়ে ফিরলেন যুবক

১৮

রাতে ঢাকাসহ ৮ জেলায় ঝড়ের শঙ্কা

১৯

বিএনপির পর্তুগাল শাখার নতুন কমিটির অভিষেক ও পরিচিতি সভা অনুষ্ঠিত

২০
X