মুফতি আরিফ খান সাদ
প্রকাশ : ২৬ জানুয়ারি ২০২৪, ০৩:৫৪ এএম
আপডেট : ২৬ জানুয়ারি ২০২৪, ০৮:২৭ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ

পরকালীন সম্পদ উপার্জনের ক্ষেত্র

পরকালীন সম্পদ উপার্জনের ক্ষেত্র

পৃথিবীতে মানুষের নাড়ি ও শিকড় জড়িয়ে থাকে পরিবারে। মানুষের জন্ম ও বিকাশ ঘটে পরিবারে। আবহমান কাল থেকেই মানুষের মূলকেন্দ্র পরিবার। পৃথিবীর প্রথম মানব আদম (আ.) ও প্রথম মানবী হাওয়া (আ.)-কে কেন্দ্র করে মানবজাতির প্রথম পরিবার গড়ে উঠেছিল জান্নাতে। এই প্রথম পরিবারের সদস্য স্বামী ও স্ত্রীকে উদ্দেশ্য করে মহান আল্লাহ বলেছিলেন, ‘হে আদম! তুমি ও তোমার স্ত্রী জান্নাতে অবস্থান করো এবং সেখান থেকে যা চাও খুশিমনে খাও। কিন্তু তোমরা দুজন এই গাছটির নিকটে যেও না। তাহলে তোমরা সীমালঙ্ঘনকারীদের অন্তর্ভুক্ত হয়ে যাবে।’ (সুরা বাকারাহ : ৩৫)। পরবর্তীকালে তারা পৃথিবীতে আগমন করেন এবং এই প্রথম পরিবার থেকে পৃথিবীতে ছড়িয়ে পড়ে মানবজাতি। প্রথম এ দম্পতি থেকে জন্ম নেওয়া সন্তানাদির মাধ্যমে পৃথিবীতে সূচিত হয় পরিবার ও পারিবারিক ব্যবস্থা। এ সম্পর্কে আল্লাহ বলেন, ‘হে মানবজাতি! তোমরা তোমাদের পালনকর্তাকে ভয় করো। যিনি তোমাদের একজন মানুষ থেকে সৃষ্টি করেছেন এবং তার থেকে তার জোড়া সৃষ্টি করেছেন। অতঃপর ওই দুজন থেকে অগণিত পুরুষ ও নারী ছড়িয়ে দিয়েছেন। আর তোমরা আল্লাহকে ভয় করো, যার নামে তোমরা একে অন্যের নিকট প্রত্যাশা করো এবং আত্মীয়তার বন্ধন সম্পর্কে সতর্ক হও। নিশ্চয়ই আল্লাহ তোমাদের ওপর সদা সতর্ক তত্ত্বাবধায়ক।’ (সুরা নিসা : ১)। একইভাবে সব নবী-রাসুলের ব্যক্তিগত জীবনে ও সময়কালে পরিবার বিদ্যমান ছিল। যেমন আল্লাহ বলেন, ‘তোমার পূর্বেও অনেক রাসুল প্রেরণ করেছি এবং তাদের স্ত্রী ও সন্তানাদি দিয়েছি।’ (সুরা রাদ : ৩৮)।

পরিবার বোঝাতে আরবিতে ‘আহল’ ও ‘বাইত’ শব্দগুলো ব্যবহৃত হয় এবং পবিত্র কোরআনে শব্দগুলো পরিবার অর্থে বহুবার ব্যবহৃত হয়েছে। কোরআনের এ আয়াতগুলো পর্যালোচনা করলে বোঝা যায়, মানবতার ধর্ম ইসলাম পরিবার ও পারিবারিক জীবনের ওপর যথেষ্ট তাগিদ দিয়েছে। পবিত্র কোরআনে পরিবারের অপরিহার্যতার দিকে সুস্পষ্ট ইঙ্গিত রয়েছে। পারিবারিক জীবন ছাড়া মানবসভ্যতা কল্পনা করা যায় না। মানুষের অস্তিত্বের জন্য পারিবারিক জীবন অপরিহার্য। সমাজের শান্তি-শৃঙ্খলা, স্থিতিশীলতা, উন্নতি-অগ্রগতি ইত্যাদি সুষ্ঠু পারিবারিক ব্যবস্থার ওপর নির্ভরশীল। পারিবারিক জীবন অশান্ত ও নড়বড়ে হলে, তাতে ভাঙন ও বিপর্যয় দেখা দিলে সমাজ জীবনে নানা অশান্তি ও বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি হয়। পরিবারেই মানুষ শান্তি ও নিরাপত্তা লাভ করে এবং তাদের মধ্যে ভালোবাসা তৈরি হয়। আল্লাহ বলেন, ‘তার নিদর্শনের একটি হচ্ছে, তিনি তোমাদের জন্য তোমাদের মধ্য থেকে জোড়া সৃষ্টি করেছেন যাতে তোমরা তার কাছে শান্তি লাভ করতে পারো। তিনি তোমাদের মধ্যে পারস্পরিক ভালোবাসা ও দয়া সৃষ্টি করেছেন। এতে চিন্তাশীলদের জন্য আছে চিন্তার অনেক উপাদান।’ (সুরা রুম : ২১)। পরিবারে মা-বাবা, ভাই-বোন, সন্তান-সন্ততি একত্রে বসবাস করে। একসঙ্গে থাকার ফলে একে অন্যের সুখে সুখী হয়, এক অন্যের দুঃখে সমব্যথী হয়। এভাবে পরিবারের সদস্যরা পরস্পরকে বিভিন্নভাবে সাহায্য করে।

পরিবারের অন্যতম কাজ হচ্ছে, পরিবারের সদস্যদের মানসিক প্রশান্তি নিশ্চিত করা। পরিবারের ক্ষুদ্র গণ্ডি ও নিরাপদ আলয়ে মানুষ তার আবেগ ও অনুভূতি প্রকাশ করতে পারে এবং তার সহজাত কামনা-বাসনা পূরণ করতে পারে। মহান স্রষ্টা এই প্রশান্তি ও নিরাপত্তার উৎস হিসেবে উল্লেখ করে বলেন, ‘আল্লাহ তোমাদের গৃহকে বানিয়েছেন অবস্থানের জায়গা।’ (সুরা নাহল : ৮০)। আরবি ‘সাকানা’ শব্দটির অর্থ হচ্ছে, যার মাধ্যমে মানুষ প্রশান্তি ও তৃপ্তি লাভ করে। ঘরে প্রবেশ করার সময় ঘরে অবস্থানকারীদের সালাম দেওয়া জরুরি। পবিত্র কোরআনে নির্দেশ দিয়ে আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘যখন তোমরা ঘরে প্রবেশ করো, তখন (ঘরে অবস্থানকারী) তোমাদের স্বজনদের প্রতি সালাম বলবে। এটা আল্লাহর কাছ থেকে কল্যাণময় ও পবিত্র দোয়া। এমনিভাবে আল্লাহ তোমাদের জন্য আয়াতগুলো বিশদভাবে বর্ণনা করেন, যাতে তোমরা বুঝে নাও।’ (সুরা নুর : ৬১)। এ আয়াতে ঘরে প্রবেশের আগে ঘরে অবস্থানকারীদের সালাম দেওয়াকে কল্যাণ লাভের মাধ্যম এবং দোয়া হিসেবে অভিহিত করা হয়েছে। সালামের বিনিময়ে মহান আল্লাহতায়ালা রহমত ও বিশেষ অনুগ্রহ দান করবেন।

একটি আদর্শ পরিবারের ভিত্তি গৃহের সদস্যদের মধ্যকার আন্তরিক ও নিবিড় সম্পর্কের ওপর নির্ভরশীল। পরস্পরের প্রতি দায়িত্ব-অনুভূতি পরিবারের বন্ধনকে দৃঢ় ও অটুট রাখে। পরিবারের সদস্যরা যদি স্বার্থপরতা ও আত্মকেন্দ্রিকতা পরিহার করে নিজেদের মধ্যকার বন্ধনকে ধরে রাখতে পারে, তবে মানবীয় উৎকর্ষতা ও পূর্ণতা অর্জন সহজতর হয়। ইসলামের দৃষ্টিতে মানুষের বাহ্যিক পরিশীলতার চেয়ে আত্মিক শুদ্ধতা ও পবিত্রতা অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ। আর পরিবারের সদস্যদের আন্তরিক ও নিবিড় পরিবেশে ভালোবাসা ও মমতার ছোঁয়ায় মানুষের আত্মগঠন এবং সংশোধন সহজতর হয়। পারিবারিক জীবন যে শুধু দুনিয়াতেই কল্যাণ বয়ে আনে এবং এ বন্ধন যে শুধু পৃথিবীতেই সীমাবদ্ধ থাকবে তা নয়, বরং সৎকর্মশীল ব্যক্তিদের জন্য এ বন্ধন জান্নাতেও বিদ্যমান থাকবে। মহান আল্লাহ বলেন, ‘তা হলো স্থায়ী বসবাসের জান্নাত। তাতে তারা প্রবেশ করবে এবং তাদের সৎকর্মশীল বাপ-দাদা, স্বামী-স্ত্রী ও সন্তান-সন্ততি। ফেরেশতারা তাদের কাছে আসবে প্রত্যেক দরজা দিয়ে।’ (সুরা রাদ : ২৩)।

পবিত্র কোরআনের আলোকে ‘পরিবার’ হচ্ছে এমন একটি সংগঠন যার অন্যতম লক্ষ্য হচ্ছে এর সদস্যদের; যেমন—স্বামী-স্ত্রী, পিতা-মাতা ও সন্তানদের আত্মিক ও মানসিক সুস্থতা নিশ্চিত করা এবং তাদের সামাজিক বিভিন্ন সমস্যা ও চ্যালেঞ্জ মোকাবিলার জন্য প্রস্তুত করা। পবিত্র কোরআনে এসেছে, ‘যারা বলে, হে আমাদের পালনকর্তা! আমাদের স্ত্রীদের পক্ষ থেকে ও আমাদের সন্তানের পক্ষ থেকে আমাদের জন্য চোখের শীতলতা দান করুন এবং আমাদের মুত্তাকিদের জন্য আদর্শস্বরূপ করুন।’ (সুরা ফুরকান ৭৪)। এ আয়াতে একটি আদর্শ সমাজ গঠনের জন্য পরিবারের গুরুত্ব তুলে ধরা হয়েছে। উল্লেখ্য, ব্যক্তি থেকে পরিবার, পরিবার থেকে সমাজ এবং সমাজ থেকে একটি দেশ বা রাষ্ট্র গঠিত হয়। তাই ব্যক্তি ভালো হলে পরিবার ভালো হবে, পরিবার ভালো হলে সমাজ ভালো হবে। আর সমাজ ভালো হলে দেশ ভালো চলবে। সমাজে এখনো বহু ভালো মানুষ আছেন, যারা প্রকৃতপক্ষেই চান যে, সমাজে ভালো মানুষই থাকুক, মানবরূপী কোনো দানব না থাকুক। ব্যক্তি সংশোধনের মাধ্যমে পরিবার ঠিক করে ওইসব মানবরূপী দানবদের সঠিক পথে ফিরিয়ে আনতে চেষ্টা করতে হবে। ফিরিয়ে আনতে হবে পারিবারিক শান্তি-শৃঙ্খলা এবং দৃঢ় করতে হবে পারস্পরিক সম্পর্কের সেতুবন্ধ। এ ক্ষেত্রে একে অন্যের প্রতি স্নেহ-ভালোবাসা ও শ্রদ্ধাবোধ বজায় রাখা এবং সৌহার্দ্যপূর্ণ আচরণের মাধ্যমে সুন্দর পরিবার গঠন ও পারিবারিক বন্ধন সুদৃঢ় করা আমাদের জন্য একান্ত কর্তব্য।

পরিবারের মূল চাবিকাঠি থাকে পিতা-মাতার হাতেই। আর সব পিতা-মাতাই চান তাদের সন্তান ভালো হোক, ভালোভাবে চলুক এবং নিজের সুন্দর ভবিষ্যৎ গড়ে তুলুক। তাই সুন্দর একটি পরিবার গড়ে তুলতে পিতা-মাতার গুরুত্ব অপরিসীম। কারণ পিতা-মাতার সঙ্গে সন্তানদের সম্পর্ক অত্যন্ত নিবিড় ও চিরন্তন। সন্তানকে সুপথে চালিত করতে তাদেরই ভূমিকা পালন করতে হবে। পরিবারের সদস্যরা যখন আল্লাহ প্রদত্ত দায়িত্ব সম্পর্কে সজাগ ও সচেতন থাকবে; স্ত্রী তার অধিকার পূর্ণভাবে লাভ করবে; স্বামী যখন স্ত্রীর নিকট তার অধিকার পাবে, সন্তান পিতা-মাতার ঘনিষ্ঠ সাহচর্য লাভ করবে ও তাদের অধিকার পাবে; আত্মীয়স্বজন যখন পরস্পরের যথাযথ সম্মান-মর্যাদা পাবে, তখন কোনো স্ত্রী অধিকারের দাবিতে প্রকাশ্য রাজপথে বের হবে না, কোনো স্বামী ভালোবাসা ও সুন্দর জীবনযাপনের প্রত্যাশায় অন্য নারীর প্রতি আসক্ত হবে না, কোনো সন্তানই পিতা-মাতার অবাধ্য হয়ে উচ্ছৃঙ্খল জীবনযাপন করবে না, বরং পরিবারে স্থাপিত সুসম্পর্কের কারণে আল্লাহর রহমত-বরকতের ফল্গুধারা বর্ষিত হবে।

পরিবারের পেছনে ঘাম ঝরিয়ে উপার্জন করা সম্পদ খরচ করাটাও ইসলামে সওয়াবের কাজ। এর মাধ্যমে মেলে সদকার সওয়াব। এটি গুরুত্বপূর্ণ একটি দায়িত্বও বটে। পরিবারের খরচ করা আমাদের কাছে শুধু একটি পার্থিব বিষয় মনে হলেও এটি একটি মহান দ্বীনি দায়িত্ব ও কর্তব্য। কোরআন-হাদিস অন্যান্য ইবাদত-বন্দেগির চেয়ে এ অধ্যায়টিকে কোনো দিক দিয়ে কম গুরুত্ব দেয়নি। নিজের ও পরিবারের জন্য বৈধ রিজিকের সন্ধান করাও একজন মুসলিমের ফরজ দায়িত্ব। হাদিস শরিফে এসেছে, ‘হালাল রিজিকের সন্ধান করা অন্যান্য ফরজ ইবাদতের পর অন্যতম একটি ফরজ।’ (আল মুজামুল কাবির, হাদিস : ৯৯৯৩)।

একজন দায়িত্বশীল মুসলমানের কর্তব্য, সাধ্যমতো সম্পদ উপার্জন করা এবং তা পরিবারের পেছনে খরচ করা। একই সঙ্গে এর মাধ্যমে উপার্জন হবে পরকালীন সম্পদ। আল্লাহ সবাইকে বোঝার ও আমল করার তাওফিক দিন।

লেখক: মুহাদ্দিস ও ইসলামী চিন্তাবিদ

কালবেলা অনলাইন এর সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিডটি অনুসরণ করুন
  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

ভাঙা প্রেমের কথা প্রকাশ করলেন মিঠুন

বিবেচনায় থাকার পরও কেন বাদ সাইফউদ্দিন?

এক মণ ধানেও মেলে না এক কেজি মাংস

স্বামী পাশে নেই, ফাইভ স্টারে অভিনেত্রীর জন্মদিন উদযাপন

খালেদা জিয়ার বিরুদ্ধে নাইকো মামলার সাক্ষ্যগ্রহণ ১১ জুন

সেলফি তোলাই তার পেশা, লাখের ওপরে উপার্জন

কাদের মির্জাকে হত্যার হুমকি

‘অভিবাসন কার্যক্রম সুষ্ঠুভাবে বাস্তবায়নে গঠিত হচ্ছে উপজেলা মাইগ্রেশন কো-অর্ডিনেশন কমিটি’

চট্টগ্রামে ফিরলেন ২৩ নাবিক, দীর্ঘ প্রতীক্ষার অবসান

প্রথমবারের মতো বিশ্বকাপ দলে যারা

১০

ব্র্যাঞ্চ ম্যানেজার নেবে ল্যাবএইড, আবেদনের শেষ সময় ২৫ মে

১১

হজযাত্রীদের কাছ থেকে কোরবানির টাকা নেওয়া যাবে না

১২

গ্লোবাল সোশ্যাল ইনফ্লুয়েন্সার অ্যাওয়ার্ড পাচ্ছেন বাংলাদেশের জুবায়ের

১৩

ভিসা প্রক্রিয়া সহজ করার আশ্বাস দিয়েছে ভারত : পাটমন্ত্রী

১৪

২৮ বছর পর যাবজ্জীবন সাজাপ্রাপ্ত আসামি গ্রেপ্তার

১৫

মোটরসাইকেল ও সিএনজিচালিত অটোরিকশার সংঘর্ষ, অতঃপর...

১৬

কুবি উপাচার্য ও কোষাধ্যক্ষের বিরুদ্ধে নতুন অভিযোগ

১৭

‘ময়না’ যাচ্ছে ইতালি

১৮

২৩ মাসেও হয়নি বুটেক্স ছাত্রলীগের পূর্ণাঙ্গ কমিটি

১৯

আইএফআইসি ব্যাংকের নতুন এএমডি মো. নুরুল হাসনাত

২০
X