অজয় দাশগুপ্ত
প্রকাশ : ২৩ এপ্রিল ২০২৪, ০৩:৫১ এএম
আপডেট : ২৩ এপ্রিল ২০২৪, ০৮:৪৯ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ

অশান্ত পৃথিবী ও আমাদের বাস্তবতা

অশান্ত পৃথিবী ও আমাদের বাস্তবতা

জীবন এখন কোথাও নিরাপদ নয়। আমরা আমাদের দেশের কথা বলি, ভাবি। কিন্তু শুধু কি বাংলাদেশ? আজ যদি আপনি বিশ্বের দিকে চোখ রাখেন দেখবেন উন্নত নামে পরিচিত দেশগুলোর সমাজ ও সামাজিক পরিবেশ ভয়াবহ। আমেরিকা দুনিয়ার সেরা একটি দেশ বলেই আমরা জানি। কেন সেরা? সে বিচার এখন দূর অস্ত। চীন, রাশিয়া, ভারত যে যত এগোক বা পেছাতে থাক, পরিসংখ্যান মতে যুক্তরাষ্ট্রই শীর্ষে। এই শীর্ষে থাকা তার অধিকার হয়ে গেছে। নানা বিচারে এখনো তাদের সেরা জায়গাটা মানতে হবে। কিন্তু আপনি কি চীন, রাশিয়া বা ভারতের স্কুলে এমন কিলিং মিশন দেখেন? বাচ্চাদের শিশুদের এভাবে মারার রেকর্ডে আমেরিকা সবাইকে ছাড়িয়ে। কদিন পরপর একেকটা ঘটনায় বুকের রক্ত হিম হয়ে এলেও এ গুলি থামে না।

মিয়ানমারের রাখাইনে জান্তা বাহিনী এবং বিদ্রোহী আরাকান আর্মির মধ্যে সংঘাত চলছে গত কয়েক মাস ধরেই। এর আগে ফেব্রুয়ারির প্রথম সপ্তাহে তিন শতাধিক বিজিপি সদস্য আশ্রয় নিয়েছিলেন বাংলাদেশে। একাধিক সীমান্ত চৌকি আরাকান আর্মির দখলে যাওয়ায় সে সময় তাদের পালাতে হয়েছিল। পরে তাদের একটি বড় অংশকে ফেরত পাঠানো হলেও দেড়শর মতো মিয়ানমারের নাগরিক বাংলাদেশ সীমান্তরক্ষী বাহিনীর আশ্রয়ে ছিলেন।

গত কয়েক দিনে নতুন অনুপ্রবেশের ফলে সে সংখ্যা এখন দাঁড়িয়েছে ২৬০ জনে। প্রতিবেশী মিয়ানমারে কী হচ্ছে আসলে? রাখাইনদের রোহিঙ্গাদের নিধন ও বিতাড়নের পর এখন বিদ্রোহীদের সঙ্গে সেনাদের যুদ্ধ চলছে। একটা দেশের ভেতর কী পরিমাণ জুলুম আর যুদ্ধাবস্থা থাকলে সে দেশের সরকারি সৈন্য পালিয়ে আসে বা আসতে বাধ্য হয়। বাংলাদেশ তাদের আশ্রয় দেয়। আবার দেখলাম ফেরতও যাচ্ছে তারা। এসব বাস্তবতার পরও আমরা মনে করি আমাদের সমাজেই খালি অশান্তি।

জি না, এই যে আমাদের শান্তির শহর সিডনি, এতদিন আমরা এমন কোনো ঘটনার কথা চিন্তাও করিনি। অথচ নয়নাভিরাম বন্ডাই বিচের লাগোয়া শপিংমলে ঘটে গেল ন্যক্কারজনক হত্যাকাণ্ড। একটি শিশুও গুলিবিদ্ধ হয়েছে সে ঘটনায়। জানে বাঁচলেও শিশুর মা মারা গেছেন আততায়ীর ছুরির আঘাতে। পাকিস্তানি সিকিউরিটি গার্ড এ দেশে এসেছিল শরণার্থী হয়ে। কাজের প্রথম দিনেই জান হারিয়েছে এ যুবক। আহমদিয়া সম্প্রদায়ের এ যুবক এখন পাকিস্তানের হিরো।

দেখা যাচ্ছে কোথাও শান্তি নেই। গাজায় হাজার হাজার মানুষের জান গেছে। শিশু-নারী কেউ বাদ যায়নি। এখন ইরান-ইসরায়েল যুদ্ধের মুখোমুখি সারা দুনিয়া। এ লড়াই হবে কি না আর হলে কী হবে সেটা জানলেও চুপ আছে বিশ্ব মিডিয়া। এই যে চরম বাস্তবতা, এ বাস্তবতায় বাংলাদেশ আজ মোটামুটি একটি শান্তি পরিবেশে বসবাস করছে। কিন্তু আমাদের অশান্তি বা খারাপের উৎস অন্য জায়গায়।

বাংলাদেশ স্বাধীন হয়েছিল যে আদর্শে, যে মূল্যবোধে; তার অবনতি সমাজকে পলে পলে দগ্ধ করছে। আমি বাইরের দেশে দেখছি সমাজের অবনতি আর পাপই মূলত প্রধান সমস্যা। মানুষের হাতে টাকা থাকলেই যে তারা নিরাপদ, তা কিন্তু নয়। যে দেশ ও ঘটনাগুলোর কথা লিখেছি তাদের আর্থিক অবস্থা আমাদের চেয়ে ভালো। সমাজ ও সুসংহত। অথচ আজ কেন বারবার মানুষ অন্যের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ছে? এর মূল কারণ অশান্তি। সমাজ সৃষ্ট বিবেচনাহীন মূল্যবোধ আর নৈতিকতার অধঃপতন এখন দৃশ্যমান। একসময় যেটাকে আধুনিক মনে করা হতো সে আধুনিকতার নাগপাশ তাকে পেঁচিয়ে ধরেছে। এই অভিশাপের নাম একাকিত্ব। এই একা থাকার কারণে যে নৈরাজ্য আর অশান্তি বাসা বাঁধে তার কারণেই মন হয়ে যায় বিষাক্ত। সে বিষ পান করে যুবকরা আজ মারমুখো। তারা নিজেরা তো বাঁচেই না, অন্যদেরও বাঁচতে দেয় না।

একসময় আমাদের দেশে জঙ্গিবাদ আর সন্ত্রাস আতঙ্কের মূল কারণ ছিল। আপাতত সেগুলো মাথাচাড়া দিতে পারছে না। কিন্তু বিভিন্ন দেশীয় ও আন্তর্জাতিক ইস্যুতে আমাদের তারুণ্যকে যেভাবে প্রলুব্ধ ও উত্তেজক করা তোলা হয়, তা ভবিষ্যতের জন্য দুশ্চিন্তার বিষয়। খেয়াল করবেন সমাজে আধুনিকতা আর বিশ্বাস এখন পরস্পর সাংঘর্ষিক। প্রতিনিয়ত একদল মানুষ কোনো না কোনোভাবে উসকানি দিচ্ছে। চোখ-মুখ খিঁচিয়ে কথা বললেই কি বুদ্ধিজীবী হয়ে যায় কেউ? যা জানেন তা বলেন, যা জানেন না তা ডাবল বলেন। ভাবখানা এই তিনি বা তার বাইরে আর কিছু কেউ জানে না। এই মূর্খদের কবলে সমাজ পড়েছে। এর পরিণাম ভয়াবহ হতে বাধ্য। একদিন এই দানব কীভাবে আক্রমণ করবে সেটাই ভাবার বিষয়।

যে কারণে বাইরের দেশে এখন অশান্তি আর নৈরাজ্য তার মূল কিন্তু সমাজে। আমাদের সমাজে এখন আর শিক্ষা কোনো ব্যাপার না। শিক্ষা যদি ঠিক থাকত আর যাই হোক, মৌলবাদী চিন্তার প্রসার ঘটত না। মূলত রাজনীতিবিহীন দেশে উত্তেজনার কারণগুলো হয় সামাজিক। কারণ এ উত্তেজনা পাহারার কোনো অভিভাবক নেই। ভালো হোক মন্দ হোক একদল মানুষ এগুলো পাহারা দেবেন এটাই রীতি। সে রীতি এখন আর নেই। জুটেছে মিডিয়ার একক আধিপত্য। মিডিয়াকে দোষারোপ করার আগে ভাবতে হবে তাদের কাজ হচ্ছে খবর বিক্রি। বিক্রেতা সবসময় চান তার প্রোডাক্ট হট কেকের মতো চলুক। ফলে নেগেটিভ বিষয়ে আগ্রহ বেশি থাকবে এটাই স্বাভাবিক। আমার ধারণা এখানেও নজরদারির একটা ব্যাপার আছে, যা নিয়ন্ত্রণ নয় কিন্তু যার একতা নীতিমালা থাকে। সে নীতিমালা থাকলে বাক স্বাধীনতা হয় অর্থবহ। তখন কেউ চাইলেও মনগড়া কথা বলে আমাদের জাতীয় সংগীতের স্রষ্টা রবীন্দ্রনাথকে এভাবে অপমান করতে পারত না। পারত না বৈশাখ ও মঙ্গল শোভাযাত্রা নিয়ে বাজে কথা বলতে। জোর করে আমরা শোভাযাত্রা কতদিন করতে পারব? আর তা যদি স্বতঃস্ফূর্ত হয় তো তাকে কেউ বন্ধও করতে পারবে না। প্রয়োজন স্বচ্ছ আর স্বাভাবিক কর্মকাণ্ড। অথচ সে জায়গাটায় পদে পদে বাধা। দেখেশুনে মনে হয় আনুকূল্য আর পাহারা ছাড়া আমাদের বুদ্ধিবৃত্তি ও মঙ্গল বিষয়টাই আজ অসহায়।

এর ফলে যে শূন্যতা তৈরি হয়েছে সেটা কি মনে করিয়ে দিচ্ছে না যে দেশে প্রতিক্রিয়াশীলতার এক নীরব অভ্যুত্থান ঘটে গেছে? যদি তা হয় তাহলে বাদবাকি সমাজ যে আবারও বিপদে পড়বে বা পড়তে পারে সেটাই আমাদের আশঙ্কার বিষয়। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা একা সামাল দিয়ে চলেছেন। তিনি আছেন বলে অন্যায় সীমা পেরোতে ভয় পায়। আমাদের চাওয়া এই নেতার আমলেই আমরা যেমন বহু উন্নত দেশের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে এগিয়ে চলেছি, তেমনি আমাদের শান্তি-কল্যাণও থাকুক অম্লান। সভ্য নামের দেশ ও সমাজের দিকে তাকালে এখন ভয় করে। ভয় যুদ্ধের, ভয় জীবনের, ভয় সম্মানের। ভয়মুক্ত পৃথিবী কি তাহলে কথার কথা হয়েই থাকবে চিরকাল?

লেখক: ছড়াকার, প্রাবন্ধিক ও কলামিস্ট, সিডনি প্রবাসী

কালবেলা অনলাইন এর সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিডটি অনুসরণ করুন
  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

গুদামের চাবি নিয়ে লাপাত্তা খাদ্য কর্মকর্তা

যুক্তরাষ্ট্রের ভণ্ডামির মুখোশ উন্মোচন হয়ে গেছে : ইরান

দুপুরের মধ্যে ঝড়ের আভাস, ৭ অঞ্চলে সতর্ক সংকেত

ঢাকাসহ যে ৫ বিভাগে শিলাবৃষ্টির পূর্বাভাস

হাতের টানে ওঠে যাচ্ছে রাস্তার পিচ

দিনটি কেমন যাবে আপনার, জেনে নিন রাশিফলে

ব্রিটিশ অস্ত্রে সরাসরি রাশিয়ায় হামলার অনুমতি দিল যুক্তরাজ্য

ধর্ষণ মামলার মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত আসামি গ্রেপ্তার

জবি হলে আগুন, আতঙ্কে জ্ঞান হারালেন ছাত্রী

রোহিঙ্গা গণহত্যা মামলার দ্রুত নিষ্পত্তিতে আশাবাদী বাংলাদেশ-গাম্বিয়া

১০

কী ঘটেছিল ইতিহাসের এই দিনে

১১

সকালের মধ্যে তীব্র ঝড় হতে পারে যেসব অঞ্চলে

১২

আজ বন্ধ থাকবে যেসব জেলার শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান

১৩

শনিবার রাজধানীর যেসব এলাকায় যাবেন না

১৪

৪ মে : নামাজের সময়সূচি

১৫

বিরল প্রজাতির আশ্চর্যজনক ছাগল

১৬

২০ বছর পর ভাইকে বুকে জড়িয়ে ধরলেন সুজন

১৭

আচরণবিধি লঙ্ঘনের দায়ে চেয়ারম্যান প্রার্থীকে শোকজ

১৮

২ টাকার বেগুন এখন ৬০ টাকা

১৯

বাকৃবিতে বৃক্ষনিধনের প্রতিবাদ

২০
*/ ?>
X