আজ ৯ জুন, আন্তর্জাতিক আর্কাইভস দিবস। এবার বিশ্বব্যাপী দিবস হিসেবে ১৭তম এবং সপ্তাহ হিসেবে ষষ্ঠবারের মতো উদযাপিত হচ্ছে। আর্কাইভস বিষয়ের আন্তর্জাতিক সংগঠন International Council on Archives (ICA) এবারে প্রতিপাদ্য ঘোষণা করেছে ‘Cyber Archives’ যার মাধ্যমে উদীয়মান প্রযুক্তিকে ব্যবহার করে স্মার্ট আর্কাইভস প্রতিষ্ঠায় ভূমিকা রাখা এবং ডিজিটাল নিরাপত্তা ব্যবস্থা জোরদার করার বিষয়ে গুরুত্বারোপ করা হয়েছে।
স্মার্ট আর্কাইভস বিনির্মাণে উদীয়মান প্রযুক্তির ভূমিকা অত্যন্ত প্রাসঙ্গিক। আর্কাইভসে উদীয়মান প্রযুক্তি ব্যবহারের ক্ষেত্রগুলো চিহ্নিত করে সময়োপযোগী পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে। Association of Canadian Archivist-এর অনলাইন পাবলিকেশন লিঙ্কে গত ১৬ মে ২০২৪ তারিখে একটি লেখা প্রকাশিত হয়। অনলাইনে প্রকাশিত Jill K. Sadler লিখিত আর্টিকেলটির শিরোনাম হলো ‘Analyzing Artificial Intelligence Methods in Digital Preservation Workflow’। আর্কাইভস ব্যবস্থাপনায় উদীয়মান প্রযুক্তির ব্যবহার বিষয়ে এখানে বিস্তারিতভাবে আলোকপাত করা হয়েছে। বলা হয়েছে গত ৫ বছর যাবৎ Artificial Intelligence-AI কীভাবে আর্কাইভস ব্যবস্থাপনায় সহযোগিতা করতে পারে, তা নিয়ে গবেষণা চলছে। সুতরাং এ ধরনের উদীয়মান প্রযুক্তি নিয়ে ভাবার সময় আসছে। এ প্রযুক্তিগুলো আর্কাইভস ব্যবস্থাপনায় কাজে লাগানো গেলে স্মার্ট আর্কাইভস গড়ে তোলা সময়ের ব্যাপার।
উদীয়মান প্রযুক্তির মধ্যে উল্লেখযোগ্য কয়েকটি প্রযুক্তি; যথা: কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা (artificial intelligence-AI), ব্লকচেইন (blockchain), মেশিন লার্নিং (machine learning), বিগ ডাটা অ্যানালিটিক্স (Big Data Analytics) এবং সংরক্ষণ প্রযুক্তিগুলোর (Preservation Technologies) মতো উদীয়মান প্রযুক্তিগুলো প্রাধান্য পাচ্ছে। এসব প্রযুক্তি আর্কাইভস সামগ্রী চিহ্নিত করতে, আর্কাইভস ব্যবস্থাপনার প্রক্রিয়াগুলো স্বয়ংক্রিয় করতে, অতি দ্রুত সংরক্ষণাগারের অ্যাক্সেসযোগ্যতা বৃদ্ধি করতে, আর্কাইভাল সামগ্রী থেকে তথ্যানুসন্ধান করতে, সেবা সহজীকরণ করতে এবং আর্কাইভাল সামগ্রী পুনরুদ্ধার করতে ব্যবহার করা যেতে পারে। এসব প্রযুক্তি ডাটাগুলোর অখণ্ডতা নিশ্চিত করে। ডাটাকে সুরক্ষিত করে। সর্বোপরি সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য এবং ঐতিহাসিক নিদর্শনগুলো কীভাবে আর্কাইভস প্রতিষ্ঠানে সংরক্ষণ করতে হয়, সেক্ষেত্রে বিপ্লবী ভূমিকা পালন করতে পারে। স্মার্ট আর্কাইভস বিনির্মাণে এসব প্রযুক্তি গ্রহণে কার্যকরী পদক্ষেপ গ্রহণ করা যেতে পারে।
একটু পেছনে ফিরে আর্কাইভস দিবস উদযাপনের ইতিহাস পর্যালোচনায় দেখা যায় যে, ২০০৪ সালে আন্তর্জাতিক আর্কাইভস দিবস উদযাপনের প্রথম প্রস্তাব করা হয়। ২০০৭ সালের ICA-এর বার্ষিক সাধারণ সভায় এর প্রতিষ্ঠাকালীন তারিখ অর্থাৎ ১৯৪৮ সালের ৯ জুন তারিখকে স্মরণীয় করে রাখতে ‘আন্তর্জাতিক আর্কাইভস দিবস’ উদযাপনের সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। ২০০৮ সালে ICA-এর ৬০তম জন্মবার্ষিকী পালন উপলক্ষে বিশ্বব্যাপী ‘প্রথম আন্তর্জাতিক আর্কাইভস দিবস’ উদযাপন করা হয়। এর পর থেকে প্রতি বছর ৯ জুন তারিখকে আন্তর্জাতিক আর্কাইভস দিবস হিসেবে উদযাপন করা হচ্ছে। বাংলাদেশ ২০১৩ সাল থেকে আড়ম্বরপূর্ণ এই দিবস বা সপ্তাহ উদযাপন করছে। প্রতি বছর সংস্কৃতিবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের আওতাধীন আর্কাইভস ও গ্রন্থাগার অধিদপ্তর কর্তৃক এ দিবসটি যথাযোগ্য মর্যাদা ও আনুষ্ঠানিকতার মাধ্যমে উদযাপন করা হয়। তবে সামাজিক অংশগ্রহণের বিষয়ে জোরদার ভূমিকা পালন করা দরকার। এক্ষেত্রে আন্তর্জাতিক আর্কাইভস দিবসটি সরকারের জাতীয় ও আন্তর্জাতিক দিবসেগুলোর তালিকাভুক্ত করা একান্ত প্রয়োজন। একই সঙ্গে সরকার কর্তৃক দিবসটি ‘জাতীয় আর্কাইভস দিবস’ হিসেবে ঘোষণা করা প্রয়োজন। তবেই সামাজিক অংশগ্রহণ নিশ্চিত হবে।
মূলত আর্কাইভস ও রেকর্ডসের গুরুত্ব সম্পর্কে জনসচেতনতা বৃদ্ধি করা; সুশাসন ও উন্নয়নের জন্য রেকর্ড ব্যবস্থাপনার সুবিধা সম্পর্কে সরকারি নীতিনির্ধারক পর্যায়ে সচেতনতা বৃদ্ধি করা; আর্কাইভাল সামগ্রীর দীর্ঘমেয়াদি সংরক্ষণ এবং অ্যাক্সেসের প্রয়োজনীয়তা সম্পর্কে সাধারণ জনগণ, সরকারি ও বেসরকারি সেক্টরকে সচেতন করা; আর্কাইভস প্রতিষ্ঠানে সংরক্ষিত দুষ্প্রাপ্য, দুর্লভ, অনন্য ও অসাধারণ নথিপত্র প্রদর্শন করা; আর্কাইভস ও রেকর্ডসের ভূমিকাকে বিশ্বব্যাপী তুলে ধরা প্রভৃতি উদ্দেশ্যাবলিকে সামনে রেখে আন্তর্জাতিক আর্কাইভস দিবস বা সপ্তাহ উদযাপনের বিষয়টি অধিক তাৎপর্য বহন করে।
বিশ্বব্যাপী আর্কাইভস ও আরকিভিস্টদের গুরুত্ব ও মূল্য প্রচারের জন্য আর্কাইভস দিবস উদযাপনের প্রয়োজনীয়তা রয়েছে। আর্কাইভস সামগ্রী সংরক্ষণের মাধ্যমে রাষ্ট্র ও সমাজ ব্যবস্থায় জবাবদিহি, স্বচ্ছতা, গণতন্ত্র, ঐতিহ্য, স্মৃতি (মেমোরি) এবং সমাজের গুরুত্বপূর্ণ কর্মকাণ্ডের প্রতিচ্ছবি ফুটে ওঠে। আর্কাইভস অনন্য। আর্কাইভস সিদ্ধান্ত, কাজ ও স্মৃতিকে ধারণ করে। আর্কাইভস নাগরিক অধিকার অধিকার সুরক্ষা করে এবং জীবনযাত্রার মান বৃদ্ধি করে। আর্কাইভস একটি অপরিহার্য বিষয়, যা পেশার উৎকর্ষ, জবাবদিহি ও স্বচ্ছতা, নাগরিকের অধিকার সুরক্ষা, ব্যক্তিগত ও সমষ্টিগত স্মৃতি নিরূপণ, অতীতকে উপলব্ধি এবং ভবিষ্যৎ কর্মকাণ্ড পরিচালনার জন্য বর্তমানকে লিপিবদ্ধ করে। তাই গোটা সমাজ ব্যবস্থার নিকট আর্কাইভসের প্রচার জরুরি। এজন্য দিবসটি পালনে সামাজিক অংশগ্রহণ নিশ্চিত করতে হবে, যা আর্কাইভস সচেতনতা বৃদ্ধিতে সহায়ক ভূমিকা পালন করবে।
আন্তর্জাতিক আর্কাইভস সপ্তাহ উদযাপনের ফলে আর্কাইভসের প্রচার ও প্রসার বৃদ্ধি পাবে। এর ফলে জনসচেতনতা সৃষ্টি হবে। রেকর্ডস ও আর্কাইভাল সামগ্রী সংরক্ষণে সবার সামাজিক অংশগ্রহণ নিশ্চিত হবে, যা একসময় সামাজিক আন্দোলনে পরিণত হবে বলে আশা করা যায়। আর্কাইভস বিষয়ে দেশব্যাপী এই সামাজিক আন্দোলনে সরকারের পাশাপাশি স্কুল, কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক-শিক্ষার্থীসহ সব জনগোষ্ঠীর অংশগ্রহণ নিশ্চিত করতে হবে। ব্যক্তিগত আর্কাইভস ও পারিবারিক আর্কাইভসে নিজের পারিবারিক ইতিহাস সংরক্ষণের চেতনা জাগ্রত হবে। আর্কাইভস নিয়ে তৃণমূল পর্যায়ের ব্যক্তি থেকে শুরু করে পরিবার, গোষ্ঠী, সমাজ ও সমাজের কার্যকলাপ এবং সবশেষে সরকার পর্যন্ত একটি সামাজিক বন্ধন তৈরি হবে। সামাজিক অংশগ্রহণ নিশ্চিত করতে গেলে দেশব্যাপী দিবসটি পালন করা উচিত। দিবসটি পালন শুধু একটি সরকারি প্রতিষ্ঠান কেন্দ্রিক না হয়ে সরকারি ও বেসরকারি সব প্রতিষ্ঠানসহ সব ধরনের মানুষের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করা দরকার। বেসরকারি সংগঠন এ বিষয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে। এক্ষেত্রে আর্কাইভস বিষয়ে দেশের প্রথম বেসরকারি সংগঠন বাংলাদেশ আর্কাইভস অ্যান্ড রেকর্ডস ম্যানেজমেন্ট সোসাইটি (বারমস) গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারে। তবে এই বারমসের মতো সামাজিক সংগঠন আরও বাড়াতে হবে। আর্কাইভাল সংগঠন বৃদ্ধি পেলে সামাজিক সচেতনতা বৃদ্ধি পাবে। দেশে আর্কাইভস মুভমেন্ট তৈরি হবে, যা আর্কাইভসের প্রচার ও প্রসারে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবে। এভাবে আর্কাইভস বিষয়ের সামাজিক সচেতনতাই আর্কাইভসকে সুউচ্চ আসনে সমাসীন করবে। সুতরাং আন্তর্জাতিক আর্কাইভস দিবসটি আর্কাইভস বিষয়ে জনসচেতনতা বৃদ্ধিতে বা এ বিষয়ে গণজাগরণ তৈরিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে। এজন্য প্রয়োজন সামাজিক অংশগ্রহণ। সামাজিক সচেতনতা।
পরিশেষে স্মার্ট বাংলাদেশ বিনির্মাণের চারটি মূল স্তম্ভের একটি হলো স্মার্ট সোসাইটি। আর আর্কাইভস দিবসটি পালনের মাধ্যমে সামাজিক অংশগ্রহণ নিশ্চিত করা গেলে স্মার্ট সোসাইটিও গড়ে তুলতে এটি ভূমিকা রাখবে, যা উন্নত ও সমৃদ্ধ দেশ গঠনে সহায়ক হবে।
লেখক: সহকারী পরিচালক (আর্কাইভস), আর্কাইভস ও গ্রন্থাগার অধিদপ্তর এবং পিএইচডি গবেষক, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়