১৯৬৫ সালের ১১ জুন আমেরিকায় শিকাগোর ডব্লিউএফএমটি রেডিওতে বাংলা ভাষার অন্যতম কবি অমিয় চক্রবর্তীর প্রায় এক ঘণ্টার একটি সাক্ষাৎকার প্রচারিত হয়। লেখক ও ইতিহাসবিদ স্টাডস টারকেলের নেওয়া সেই সাক্ষাৎকারটিতে গত শতাব্দীর ঘটনাবলি নিয়ে নানান কথা উঠে এলেও বর্তমানের যুদ্ধ-গণহত্যা ও মানবাধিকার লঙ্ঘনে বিপর্যস্ত পৃথিবীতে তার কথাগুলো এখনো প্রাসঙ্গিক। আমেরিকা থেকে এ রেডিও সাক্ষাৎকারটি সংগ্রহ করে কালান্তরের পাঠকদের জন্য অনুবাদ করে পাঠিয়েছেন কবি তুহিন দাস
পর্ব: ৩
স্টাডস টারকেল: শুনুন অমিয়, আপনি স্রেফ একজন সাধারণ ভ্রমণকারী পণ্ডিত হিসেবে কথা বলছেন, ক্ষমতাহীন, আপনি দূতাবাসের সর্বোচ্চ কর্মকর্তা থেকে অনেক বেশি মুক্ত। কারণ তার বন্ধন সেসব নিরানন্দ পৌরাণিক রীতিনীতির মতো, যা বিস্তৃত দৃষ্টিভঙ্গি ভুলে যায়। আপনার সামগ্রিক দৃষ্টিভঙ্গি আছে। আপনি তার চেয়েও স্বাধীন। এক অর্থে সে একজন দাস।
অমিয় চক্রবর্তী: [অমিয় তার নিজের কথার সূত্র ধরে বললেন] আর আপনি যদি সত্যিই কোনো বিশেষ ব্যক্তিবিরোধী না হন, তাহলে আমি জানি আমার কথাটা আপনি বুঝতে পারবেন। যদি একজন ব্যক্তি উত্তম চিন্তা ও সংস্কৃতির অধিকারী না হন, তাহলে তিনি দূতাবাসে অথবা এ ধরনের উচ্চ কৌশলগত চাকরিতে সীমাবদ্ধ হয়ে পড়তে পারেন। সে ক্ষেত্রে আপনি আসলে আপনার কাজের জন্য সঠিক লোক নিয়োগ দেননি। কথা প্রসঙ্গে আমরা বলতে পারি—আপনি একজন কৃষিবিদকে শহরের স্থাপত্যকৌশলের দায়িত্বে রাখবেন না, একজন কঠোর সামরিক লোককে সবচেয়ে সূক্ষ্ম রাষ্ট্রদূতের চাকরিতে রাখার কথা ভাবার মতো বোকামিও কেউ করবে না। আমরা এটাই করছি। তারা খারাপ নয়। তাদের নিজস্ব বিশেষত্ব আছে, যদিও আমি সেসব বিষয়ে কম জানি। তারা জ্ঞানের একটি ক্ষেত্র আয়ত্ত করার জন্য প্রচণ্ড পরিশ্রম করেছেন। কিন্তু মানুষের জীবনকে যেসব সুদূরপ্রসারী পদক্ষেপ দাঁড় করিয়ে দেয়—যেমন অর্থনীতি, কূটনৈতিক সম্পর্ক ও এর সূক্ষ্ম সমস্যাগুলো। এখন এসব কিছু অনেক উচ্চপদস্থ সামরিক ব্যক্তিদের ওপর নির্ভর করে। অনেক দেশ এ পদক্ষেপ নিচ্ছে, যার ফল সুদূরপ্রসারী। আমি একটি সাধারণ উদাহরণ হিসেবে ভিয়েতনামের কথা বলছি, যুদ্ধের তীব্রতা ছাড়া আপনি আর কী আশা করতে পারেন সেখানে? এসব সামরিক ব্যক্তিরা অন্য সব সূক্ষ্ম বিষয় বোঝেন না। তাহলে সেখানে আপনার আমেরিকান মনোবিজ্ঞানী, সমাজবিজ্ঞানী ও চিকিৎসাবিদদের প্রয়োজন হবে; অথবা যদি আপনি পরিসর বড় করেন, তাহলে আপনি জাতিসংঘের সাহায্য নিতে পারেন—তারা বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার কর্মীদের পাঠাতে পারে।
স্টাডস টারকেল: কবিদের—
অমিয় চক্রবর্তী: …হ্যাঁ, কবিরা এবং ইউনেসকোর লোকেরা বই লিখবে, প্রকাশ করবে। আমরা দেখেছি তারা কোনো প্রোপাগান্ডা ছড়ায় না। আমি জাতিসংঘের সঙ্গে একজন ফুলটাইম কর্মকর্তা হিসেবে কাজ করেছিলাম এবং আমি জানি তারা কীভাবে তাদের কাজ পরিচালনা করে। যদি আপনি তাদের সাইগনে [বর্তমান ভিয়েতনামের হো চি মিন শহরে] নিয়ে যান, তারা সেতু উড়িয়ে দেবে না, তারা কাউকে বোমা দিয়ে মেরে ফেলবে না, তারা কোনো পক্ষাবলম্বন করবে না। তারা গ্রামে শিশুদের উপযোগী ছোট ছোট শিক্ষণীয় বই, চিত্রিত পুস্তিকা বিলি করবে। আমি দেখেছি তারা এমনটি করে। কিন্তু তাদের সেখানে যেতে দেওয়া হচ্ছে না। কেউ কি জাতিসংঘকে সাইগনে যেতে অনুমতি দেবে? আপনি কি মনে করেন মি. উ থান্টকে [জাতিসংঘ মহাসচিব] পরামর্শক করার কারণেই যে কেউ সেখানে যেতে পারে? যাহোক, আমার এ বিষয়ে নাক গলানো উচিত নয়, কিন্তু আমি শুধু এ কারণেই এটা ব্যাখ্যা করছি না যে, দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার প্রতি আমার কোনো বিশেষ দায়িত্ব আছে। এর বাইরেও আমি একজন মানুষ, জীবন্ত এবং ঘুরে বেড়াচ্ছি শিকাগো বা বোস্টনে। আমি কলকাতার বাসিন্দা। আমি অক্সফোর্ডে শিক্ষাগ্রহণ করেছি। আমার মনে হয় না যে, আমাকে কোনো নির্দিষ্ট শ্রেণিতে ও ছাঁচে ফেলা যাবে। এখন আমি যদি ১৯৬৫ সালের একজন মানুষ হই, ঠিক কত তারিখ আজ—১১ জুন, এই মুহূর্তে মানবজাতির সঙ্গে কী ঘটছে, তা সম্পর্কে আমাকে সচেতন থাকতে হবে। তারা আমার ভাই ও বোন। যদি একজন আমেরিকানও মারা যায় এবং তাদের অনেকেই গত কয়েক দিনে মারা গেছে—বিশ্বাস করুন বা না করুন, আমরা সবাই একইরকম অনুভব করি, আমরা মনে করি এটি একটি ভয়াবহ ঘটনা।
স্টাডস টারকেল: অমিয়, খবরের কাগজে পড়ে, রেস্টুরেন্টে-রাস্তায় মানুষের সঙ্গে কথা বলে অসংখ্য আমেরিকান তরুণদের মৃত্যুর কথা শুনে [ভিয়েতনাম যুদ্ধে আটান্ন হাজারের বেশি আমেরিকান সৈন্য নিহত হয়] যে দুঃখ ও শোকের অনুভূতি সৃষ্টি হয়, তা সামলে তাদের একই দুঃখ ও শোক অনেক বেনামি কৃষকের জন্যও কি অনুভূত হয় না যারা ধানের ক্ষেতে নাপাম বোমার আঘাতে টুকরো টুকরো হয়ে মারা গিয়েছিল? কেননা, তারাও একই মানবজাতির সদস্য এবং এই যে আপনি বললেন, আমরা এই যন্ত্রণায় ভুগছি।
অমিয় চক্রবর্তী: হ্যাঁ, আমি তাই আশা করি। আজ আমি যা দেখছি বা শুনছি তার সবকিছু থেকে মনে হচ্ছে বিবেক ফিরে গেছে। এই শিক্ষা পদ্ধতিগুলো, বিক্ষোভ সমাবেশগুলো, বিশ্ববিদ্যালয়ের লোকেরা, সাংবাদিকতার শীর্ষ ব্যক্তিত্বরা যেমন ওয়াল্টার লিপম্যান, জর্জ ক্যানন, অবসরপ্রাপ্ত কূটনীতিকরা, আমি বিশপ ও কার্দিনালদের নামও উল্লেখ করতে পারি। আমি মানুষের বিবেক প্রকাশের এক বিশাল অংশকে দেখতে পাচ্ছি, কারণ তারা ধানক্ষেতের এই ছোট্ট মানুষের মৃতদেহের কথা জানে, যে কি না ভিয়েতনামি অথবা অন্য পক্ষের হাতে নিহত হয়েছে, তার ছবি সেনাবাহিনী বা অন্যান্য সংস্থা কর্তৃক রুচি ও সামান্যতম সংবেদনশীলতা ছাড়াই প্রদর্শিত হয়েছে, কাদের দ্বারা তা আমি জানি না। কিন্তু সেসব বড় বড় পত্রিকায় আছে, খবরের কাগজে আছে। কে সেসব ছেড়ে দেবে? এসব ছোট্ট ছোট্ট মানুষরা জানবে না যে, তাদের স্নান করানো হচ্ছে কি না অথবা কেউ তাদের খোঁজ আদৌ নেবে কি না। তারা এই ছোট্ট ধানক্ষেতগুলোতে ভয়াবহ মৃত্যুবরণ করছে। এখনই এটা বন্ধ করতে হবে। আমেরিকার বিবেক দংশিত হয়েছে, অবশ্য অনেকে তা মনে করে না। তারা বলে যে, আমেরিকানরা অন্যরকম প্রজাতি!
আমি রোডেশিয়ার লিভিংস্টনে [বর্তমানে জাম্বিয়ায় অবস্থিত] ছিলাম। দক্ষিণ আফ্রিকা যাওয়ার জন্য কোনো উপায়ে তিন দিনের ট্রানজিট ভিসা পাচ্ছিলাম না। আমি রাষ্ট্রদূতের সঙ্গে কথা বলেছিলাম। তিনি যা বললেন তা হলো—কেন আপনি সেখানে যেতে চান? আপনাকে ট্যাক্সিতে যেতে দেওয়া হবে না, কারণ কৃষ্ণাঙ্গদের জন্য আলাদা ট্যাক্সি, আলাদা রেস্টুরেন্ট। আপনি কেন সেখানে যেতে চান? কেউ আপনাকে চায় না। আমি প্রত্যেক ভারতীয়কে আমাদের কাঁধ থেকে নামানোর জন্য একশ পাউন্ড করে দেব, প্রতিজনকে একশ পাউন্ড, যাতে সে এ দেশ ছেড়ে চলে যায়। আমরা চাই না কোনো ভারতীয় এখানে আসুক। তো, এ ঘটনা আমার মনে দাগ কেটেছিল, আমি আবারও একজন নিছক ভ্রমণকারী, এ ছাড়া এর সঙ্গে আমার আর কোনো সম্পর্ক নেই। আমার মনে দাগ কাটে যখন অ্যালবার্ট শোয়েৎজারের মতো একজন ব্যক্তি মানুষদের ক্ষত সারাতে অর্ধশতাব্দী ব্যয় করেছেন। তিনি ঈশ্বরের থেকে কম কেউ নন। ওগোউ নদীর তীরে [আফ্রিকার দেশ গ্যাবনে অবস্থিত] গ্রামবাসীদের সঙ্গে কথা বলার জন্য একজন ছোট্ট মানুষ নুয়ে পড়েন এবং তিনি মনে করেন যে তার জীবনের অর্ধশতাব্দী এর পেছনে ব্যয় করা তার জন্য মূল্যবান। বড় শহরে এমন মানুষ আছে যারা তিন দিন এমনকি এক দিনও একজন মানুষের মুখ সহ্য করতে পারেন না। মানবতার মানদণ্ড এখন যদি এই হয়, তাহলে আমরা কোথায় আছি? যদি একজন ভিয়েত কং [ভিয়েতনামি সমাজতন্ত্রীর সংক্ষিপ্ত রূপ] সেনার মৃত্যু হয়, আপনি খুঁজে দেখেন, এই পক্ষের কাছে তার কোনো অর্থ নেই। ওহ! এরা তো স্রেফ প্রাণী! মরতে দাও! অথবা, যদি একজন ভিয়েত কংয়ের হাতে [দক্ষিণ] ভিয়েতনামিদের মৃত্যু হয়, তাহলে আমাকে এখন বাস্তববাদী হতে হয়, অন্যপক্ষের কাছেও তা অর্থহীন। এটা অমানবিক, অসংবেদনশীল, যান্ত্রিক, নৃশংস অবস্থা। আসুন, আক্ষরিক অর্থে না বললেও সে আমেরিকান হোক বা ভারতীয়, জাপানি হোক বা অন্য কেউ, যদি সে দেখতে পায় যে একটি শিশুকে নাপাম বোমায় হত্যা করা হচ্ছে, জীবন্ত পুড়িয়ে মারা হচ্ছে—এটা তার কাছে কি কোনো অর্থ বহন করে? করে না। তার কাছে এটি কোনো ব্যাপার না, ওহ, এটা ঘটতে দাও। আজ যদি আমরা কোনো শহরে কোনো ধরনের নগণ্য খেলনাসদৃশ পারমাণবিক অস্ত্র দিয়ে আঘাত করি—কেউ কেউ কমবিধ্বংসী অস্ত্রকে খেলনা বলে; ধরুন যদি বোস্টনে হাইড্রোজেন বোমা হামলা করা হয়, তাহলে প্রতিটি প্রসূতি ওয়ার্ডের প্রতিটি মা তার সদ্য প্রসূত বা পেটে থাকা সন্তান ও তার নিজের জীবন হারাবেন। এরকম সবচেয়ে অকথ্য আচরণ চীনের প্রসূতি ওয়ার্ডে থাকা চীনা নারীদের সঙ্গে বা যে কোনো নারী বা যে কোনো মানুষের সঙ্গে করার কে অধিকার দিয়েছে? এটাই হলো মাপকাঠি। আর আমি মনে করি সত্যিই আমরা এমন একপর্যায়ে এসে পৌঁছেছি যে, আমাদের সত্যের মুখোমুখি হতে হবে, তা যতই নিষ্ঠুর হোক না কেন এবং আমাদের তৈরি করা কোনো ফাঁদের বেড়াজালের বাইরে। আমরা কি আজ সমগ্র পৃথিবী যখন ক্ষোভে ফুঁসছে তখন মানবতার বিশ্বাসযোগ্য কণ্ঠস্বরকে চিনতে প্রস্তুত, যা অমর সংগীত বা অমর শিল্পের সৃষ্টি করে? যেমনটি গতকাল বিশ্বমেলায় [২২ এপ্রিল, ১৯৬৪ থেকে ১৭ অক্টোবর, ১৯৬৫ নিউইয়র্কে অনুষ্ঠিত] হয়েছিল। কিন্তু এটা একটা মেলা হতে পারে, এমনকি সেখানেও আপনি দেখতে পাবেন পঞ্চাশটি দেশ ও তাদের মানুষরা হাঁটাচলা করছে এবং খুব খুশি। এটাই একজন স্বাভাবিক আমেরিকানদের প্রতিক্রিয়া। যদি সে এই জাপানি তাঁবুতে যায়, তাহলে সে জাপানি মানুষ, থাই মানুষ, ভারতীয়, গিনি, আইভরি কোস্টের মানুষ, সবাইকে দেখে খুশি হবে। এর বিরুদ্ধে কিছু লোক আছে, যারা হয়তো আরও শক্তিশালী—আমি জানি না, কিন্তু তাদের ক্ষমতা বালির ওপর নির্মিত। যদি কেউ চিৎকার করে, অপমান করে বলে যে, আমাদের এটা করতে হবে। সে যদি মনে করে যে, তিন মাস, সাড়ে তিন মাস, দিন-রাত একটানা বোমাবর্ষণ করবে অঘোষিত যুদ্ধে, মনে করে এটাই ঠিক—আমার বলা উচিত যে, এই লোকদের মনোরোগ বিশেষজ্ঞের প্রয়োজন। আমি তাদের প্রত্যাখ্যান করি, তারা যেই হোক না কেন—ভারতীয়, বেলজিয়ান বা আমেরিকান।
মন্তব্য করুন