ভূমিকা ও ভাষান্তর : তুহিন দাস
প্রকাশ : ০১ ডিসেম্বর ২০২৩, ১২:০০ এএম
আপডেট : ০৪ ডিসেম্বর ২০২৩, ০৯:৩৮ পিএম
প্রিন্ট সংস্করণ

বাংলা কবিতার দিকে তাকানো

কবি বুদ্ধদেব বসুর একটি ইংরেজি সাক্ষাৎকারের অনুবাদ।
বাংলা কবিতার দিকে তাকানো

আমেরিকার ইলিনয় রাজ্যের শিকাগো বিশ্ববিদ্যালয়ের উর্দু বিভাগের শিক্ষক সি এম নাঈম ও ছাত্র কার্লো কপোলার সম্পাদনায় ১৯৬৩ সালে প্রথম প্রকাশিত হয় দক্ষিণ এশীয় সাহিত্যের ত্রৈমাসিক ‘মাহফিল’ পত্রিকা। এর তৃতীয় বর্ষের চতুর্থ সংখ্যাটি সম্পাদনা করেন অতিথি সম্পাদক ও রবীন্দ্রচর্চাকারী মেরি এম লাগো, সংখ্যাটির বিষয় ছিল ‘আধুনিক বাংলা কবিতা’। সে সংখ্যার ৪৩ থেকে ৪৮ পৃষ্ঠায় কবি বুদ্ধদেব বসুর একটি সাক্ষাৎকার প্রকাশিত হয়। সাক্ষাৎকারটি বুদ্ধদেব বসু দিয়েছিলেন ১৯৬৪ সালে, তিনি ১৯৬৪-৬৫ পুরো একটি বছর একই রাজ্য ইলিনয়ের ওয়েসলিয়ান বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগে পড়িয়েছেন। গতকাল ছিল বুদ্ধদেব বসুর জন্মদিন। এ উপলক্ষে এর আগে বাংলায় ভাষান্তর না হওয়া সাক্ষাৎকারটি পত্রস্থ হলো...

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ঠিক পরে বাংলা কবিতায় কী ঘটেছিল? তার প্রতি কি কোনো প্রতিক্রিয়া হয়েছিল? তা না হলে সেই সময়ের কবিরা কোন দিকে অগ্রসর হয়েছেন?

বুদ্ধদেব বসু: ঠাকুরের পরপরই, একটি দল ছিল যারা চেষ্টা করেছিল অনেকটা তার মতো করে লিখতে। কিন্তু ১৯২০ এর দশকের শুরুতে ঠাকুরের বিরুদ্ধে প্রতিক্রিয়া শুরু হয়। আমি একে বলি ‘কল্লোল গ্রুপের বিদ্রোহ’। এসব কবি, তারা আধুনিক বাংলা কবিতার প্রাথমিক প্রতিনিধি হিসেবে বিবেচিত। তারা, শুধু একজন বাদে, সবাই আবার রবীন্দ্রনাথ দ্বারা প্রচণ্ড প্রভাবিতও ছিলেন। একই সঙ্গে তারা রাবিন্দ্রীয় নৈতিকতা ও আধ্যাত্মিক আদর্শ, সার্বজনীন সম্প্রীতি, মানুষ ও প্রকৃতির সামঞ্জস্য প্রভৃতি ধারণা থেকে দূরে সরে যান, যা রবীন্দ্রনাথের কবিতা ও লেখায় ছড়িয়ে আছে। তখন যাকে ‘বাস্তবতাবাদ’ বলা হতো, সেদিকে একটি দিকনির্দেশনা ছিল। কিন্তু তখনকার সে নতুন বাস্তবতাবাদকেও রোমান্টিকতাবাদের সঙ্গে মিশ্রিত করা হয়েছে। রোমান্টিকতাবাদ, সাধারণভাবে বলতে গেলে অতীন্দ্রিয় উপাদানের সঙ্গে মিশে যায়, যা আমরা রবীন্দ্রনাথেও দেখতে পেয়েছি।

আপনি অন্যত্র উল্লেখ করেছেন যে, জীবনানন্দ দাশ (১৮৯৯-১৯৫৪) ঠাকুর দ্বারা প্রভাবিত ছিলেন না। আপনি কি কিছু বলবেন বাংলা সাহিত্যে তার তুলনাহীন অবদান সম্পর্কে?

বুদ্ধদেব বসু : জীবনানন্দ ব্যতীত অন্যান্য কবি যেমন সুধীন্দ্রনাথ দত্ত (১৯০১-১৯৬০), বিষ্ণু দে (১৯০৯-), অমিয় চক্রবর্তী (১৯০১-) এবং আমি (১৯০৮-)—আমরা সবাই এমন একটা পর্যায়ের মধ্য দিয়ে গিয়েছি, যাদের কাজের সঙ্গে ঠাকুরের সম্পৃক্ততা গুরুতরভাবে ছিল। এই সম্পৃক্ততা অনেক রকম রূপ নিয়েছে, যেমন প্যারোডি, অনুকরণ, সমর্পণ, প্রত্যাখ্যান কিংবা বিদ্রোহ। একমাত্র যিনি আপাতদৃষ্টিতে দূরে ছিলেন তিনি হলেন জীবনানন্দ, যাকে ‘খাঁটি কবি’র উদাহরণ হিসেবে গণ্য করা যেতে পারে। ঊনবিংশ শতাব্দীতে ফরাসি প্রতীকবাদী কবিরা বিশুদ্ধ কবিতার ধারণা গড়ে তুলেছিলেন, এটা এমন এক ধরনের কবিতা, যা নিজের মধ্যেই এর শেষ এবং অবশ্যই, কোনোভাবেই শিক্ষামূলক নয়। আমরা জীবনানন্দকে কিছু ক্ষেত্রে মানতে পারি এর নিরিখে, যদিও তার সব কবিতা এমন ধরনের কবিতার প্রতিনিধিত্ব করে না। তার পরবর্তী কবিতাগুলো, যেগুলো তিনি কলকাতায় বসে লিখেছিলেন দুর্ভিক্ষ ও যুদ্ধের সময়ে, সেগুলোতে বৈশ্বিক ঘটনাবলি প্রভাবিত ব্যথা ও যন্ত্রণার ভূতুড়ে অনুভূতি দেখা যায়।

আপনি অতীতে উল্লেখ করেছেন যে, ঠাকুরের পর থেকে নজরুল ইসলাম (১৮৯৯-) ব্যতীত বিংশ শতাব্দীতে কবিতার থিম হিসেবে দেশপ্রেম হ্রাস পেয়েছে। আপনি কি মনে করেন, এই ব্যাপক অনুসরণ প্রবণতার কারণ কী ছিল? কোনো আন্দোলন ছিল কি যাকে বলা যেতে পারে ‘প্রগতিশীল’ কিংবা মার্কসবাদী? দাঙ্গা, দুর্ভিক্ষ, দেশ ভাগ কি নতুন বাংলা কবিতাকে প্রভাবিত করেছিল?

বুদ্ধদেব বসু: থিম হিসেবে দেশপ্রেমের ব্যবহার কমে যাওয়া বিংশ শতাব্দীর বাংলা কবিতার বৈশিষ্ট্য। নজরুল ইসলাম—আমি আগেও উল্লেখ করেছিলাম, একমাত্র কবি যিনি এই থিমটির ওপর বিশেষভাবে লিখেছেন, যদিও অবশ্যই, কিছু গৌণ কবিরাও লিখেছেন। এটি কমে যাওয়ার পেছনে একাধিক কারণ ছিল। প্রথমত ‘কল্লোল’ দিয়ে শুরু হয়, এটি তখন বাংলা সাহিত্যে আধুনিকতার মুখপত্র। শিল্পকে নিজের মধ্যে একটি মূল্য হিসেবে ধারণা করা—এ ধারণাটি আমাদের উনিশ শতকের ঠাকুরের পূর্বসূরি সেরা লেখকদের মধ্যে ছিল না। ঠাকুরের ছিল, কিন্তু তার মধ্যে কবিত্ব ও পেশার কারণে দেশের প্রতি দায়িত্ব—এ দুইয়ের মধ্যে একটি দ্বন্দ্ব ছিল। আগেকার লেখকরা সবাই ভাবতেন যে, সাহিত্যের একটি নৈতিক ও জাতীয় উদ্দেশ্য আছে। ১৯২০ এর দশকে এ শিক্ষামূলক উদ্যম বাষ্পীভূত হয়েছিল। আমি মনে করি এ মনোভাবের একটি স্বাভাবিক সমাপ্তি হয়েছিল, এরই মধ্যে অনেক কিছু লেখা হয়ে গেছে; যেমন—রবীন্দ্রনাথ ও দ্বিজেন্দ্রলাল রায়ের (১৮৬৩-১৯১৩) অনেক দেশপ্রেম ও উত্থানমূলক গান-কবিতা। এ ছাড়া ভারতের মাটিতে ভারতীয় ও ইউরোপীয়দের মধ্যে জাতিগত দ্বন্দ্ব সম্পর্কে লেখা অনেক গল্প-উপন্যাসও ছিল। ১৯২০-এর দিকে এ থিমটি নিঃশেষ হয়ে গিয়েছিল। রোমান্টিক স্বদেশি আন্দোলন বাংলা কবিতায় সমৃদ্ধ ফসল উৎপাদন করেছিল, কিন্তু নজরুল ইসলাম ছিলেন পরবর্তী রাজনৈতিক উত্থানের একমাত্র বাঙালি পাখি।

ত্রিশের দশকে কাব্যিক বিষয়বস্তু হিসেবে দেশপ্রেমের পতন ঘটার সম্ভবত আরও একটি কারণ ছিল, যা হলো মাকর্সবাদের উত্থান ও বিস্তার, যা ‘প্রগতিবাদ’ নামে পরিচিত। সাহিত্যে এ মতবাদের নেতৃস্থানীয়রা নিজেদের ‘প্রগতিশীল’ বলে অভিহিত করেছেন। এই দলটি ভারতের সর্বত্রই ছিল, তারা স্পষ্টতই মার্কসবাদী এবং তাদের মূল্যবোধের বিচার ছিল ঐতিহাসিক বস্তুবাদী ব্যাখ্যার ওপর ভিত্তি করে। এটা আমার কাছে মনে হচ্ছে, এই দলটি একটি নতুন ধরনের উপদেশবাদ ও ধারণাতে একটি নির্দিষ্ট অনমনীয়তার প্রবর্তন করেছে। তবে তাদের মধ্যে, বাংলা কবিতার বিকাশের একপর্যায়ে প্রতিনিধিত্বকারী দু-একজন ভালো কবি ছিলেন। যেমন—সমর সেন (১৯১৬-), যিনি খুব সুন্দর কিছু গদ্য-কবিতা লিখেছিলেন যখন তিনি তরুণ ছিলেন। আরেকজন হলেন সুভাষ মুখোপাধ্যায় (১৯১৯-) যিনি উচ্চারণ এবং পদ্য-কৌশলের ওপর চমৎকার নিয়ন্ত্রণ দিয়ে শুরু করেছিলেন। এ দুজনের কাজ অবশ্যই মাকর্সবাদ দ্বারা প্রভাবিত। আমি সমর সেনকে একজন রোমান্টিক মানুষ হিসেবে দেখি যিনি যৌবনের প্রথম প্রবাহের পর লেখালেখি বন্ধ করে দিয়েছিলেন। পরে সুভাষ মুখোপাধ্যায়ের পদ্যে প্রোপাগান্ডা মুখ্য হয়ে উঠেছে।

‘কল্লোল’ গ্রুপের পৃষ্ঠপোষকতায় কথাসাহিত্যে বাস্তবতাবাদ চল্লিশের দশক থেকে আরেকটি মোড় নিয়েছে। সাম্প্রতিক অনেক উল্লেখযোগ্য উপন্যাস গ্রামের নিম্নবিত্তদের নিয়ে, যাদের জীবনযাপনের ধরন খুব কমই পরিচিত শহুরে মানুষদের কাছে, যেমন—নৌকার মাঝি, সাপুড়েদের জীবন সম্পর্কে, এবং অন্যান্য নানারকম মানুষ যারা অজানা পেশা জীবনে ধারণ করেছে। মনে হচ্ছে আরেকটি নতুন মূল্যবোধ আবিষ্কার করার জন্য অনুসন্ধান অব্যাহত রয়েছে, যাকে অস্পষ্টভাবে বলা হচ্ছে ‘মাটিলগ্নতা’। এ ছাড়া ঐতিহাসিক ও ছদ্ম-ঐতিহাসিক উপন্যাসের আরেকটি প্রচলন রয়েছে, ঊনবিংশ শতাব্দীতে এর উপাদান বাংলা, যা দাঙ্গা-দুর্ভিক্ষ-বঙ্গভঙ্গ ও দেশ ভাগের পরিণতি নিয়ে কবিতা ও কথাসাহিত্যে ব্যাপকভাবে এসেছে।

ভারতীয় ধ্রুপদী সাহিত্যে প্রকৃতি এবং প্রকৃতির সম্প্রীতি জনপ্রিয় বিষয়বস্তু এবং ঠাকুরেও। সমকালীন কবিতায় এ বিষয়ের ধারাবাহিকতা আছে? প্রকৃতির প্রতি সমকালীন কবিদের দৃষ্টিভঙ্গি কি সম্পূর্ণ পৃথক, যেমন ধরুন ঠাকুর থেকে?

বুদ্ধদেব বসু: পৃথিবী উত্তম, এ বিশ্বাস এবং একটি ঐশ্বরিক অভিপ্রায় আমাদের জীবনকে বাধ্যতামূলকভাবে পরিচালিত করে—এ আধুনিক সময়ে এসে এ ধারণা ক্ষয়ে যাচ্ছে। অসম্ভব না হলেও এ বিংশ শতাব্দীতে বাস করা একজন বুদ্ধিমান মানুষের পক্ষে বিশ্বাস করা খুব কঠিন হবে, যেভাবে ঠাকুর কিংবা কালিদাস করতেন। আমি একজন আধুনিক কবির কথা ভাবতে পারি যিনি দার্শনিকভাবে ঠাকুরের বেশ কাছাকাছি। তিনি অমিয় চক্রবর্তী, যিনি বেঁচে আছেন, গত দশ বছর ধরে যুক্তরাষ্ট্রে রয়েছেন, তিনি বোস্টন বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াতেন এবং এখন স্মিথ কলেজে পড়ান। তার শৈলী ও কৌশল অত্যন্ত আধুনিকতাবাদী; তিনি অত্যন্ত সফলভাবে গদ্য-কবিতার আঙ্গিকে লিখেছেন এবং এমনকি দক্ষতার সঙ্গে মুক্তছন্দেও লিখেছেন। কিন্তু তার বিষয়ভাবনা ঠাকুর থেকে আলাদা কিছু নয়। চক্রবর্তী তীব্রভাবে সমসাময়িক পরিস্থিতি সম্পর্কে সচেতন; তার কবিতায় সরাসরি বৈশ্বিক ঘটনাবলির উল্লেখ রয়েছে। তিনি সবকিছুর মধ্যে আশাবাদের একটি মন্তব্য প্রবেশ করান, মানুষের প্রচেষ্টার মাধ্যমে নির্মিত আশাবাদ, মানুষের অপরিহার্য শুভবুদ্ধি ও সম্প্রীতি শেষ পর্যন্ত জয়ী হবে। তার কাছে, এটি শুধু মানুষ ও প্রকৃতির মধ্যে সামঞ্জস্যের প্রশ্ন নয়, এটা আরও গভীরতর সমস্যা, যা হলো বিভিন্ন ব্যক্তি, বিভিন্ন জীবনধারা এবং বিভিন্ন জাতির মধ্যে সামঞ্জস্যপূর্ণতা।

আধুনিক বাংলা কবিতায় পশ্চিমা, প্রধানত ইংরেজি কবিতার প্রভাব অনেক বেশি। আপনি কীভাবে এ প্রভাব বর্ণনা করবেন? আপনার নিজের লেখা থেকে এ তথাকথিত পশ্চিমা প্রভাবের উদাহরণ কীভাবে দেবেন?

বুদ্ধদেব বসু: বাংলা সাহিত্যে পশ্চিমা প্রভাব এবং আমার বলা উচিত, সমগ্র আধুনিক ভারতীয় সাহিত্যে, যথেষ্ট স্পষ্ট। যেমন শেকসপিয়র এবং রানি এলিজাবেথ [প্রথম] সময়ের অন্যান্য লেখকের ওপর ইতালিয়ান রেনেসাঁর প্রভাব, অথবা জার্মানিতে গ্যেটে এবং তার সমসাময়িকদের ওপর ইংরেজি সাহিত্যের প্রভাব। এসব প্রভাব খুব স্পষ্ট, তারা আলোচকদের দ্বারা দৃঢ়ভাবে প্রতিষ্ঠিত হয়েছেন এবং কবিরাও কখনো কখনো তাদের ঋণ স্বীকারও করেছেন। একইরকমভাবে একটি উৎস, যা আধুনিক বাংলা সাহিত্যের সমৃদ্ধিতে বা ভারতীয় জীবনে সামগ্রিকভাবে আধুনিক মনোভাবের ক্ষেত্রে অবদান রেখেছে, সেটা হলো ইউরোপীয় প্রভাব এবং বিশেষ করে ইংরেজি সাহিত্যের প্রভাব, এভাবে এবং শ্রেষ্ঠত্বের নতুন উদাহরণের সঙ্গে ভারতীয় লেখকরা পরিচিত হয়েছিল। বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের প্রবন্ধে (১৮৩৮-১৮৯৪) আমরা ইউরোপীয় অনেক কবির উল্লেখ খুঁজে পাই। সংস্কৃত ধ্রুপদী সাহিত্য নিয়ে তার অনেক প্রবন্ধ আছে, তিনি সংস্কৃত কবিদের সৃষ্টি ও ইউরোপীয় প্রভু লেখকদের সৃষ্টির মধ্যে তুলনা করেছেন। উদাহরণস্বরূপ, বাংলা ভাষায় সমালোচনার একটি প্রিয় বিষয় কালিদাসের ‘শকুন্তলা’ ও শেকসপিয়রের ‘দ্য টেম্পেস্ট’-এর মিরান্ডার তুলনা। সর্বপ্রথম এ তুলনা করেছিলেন বঙ্কিমচন্দ্র, তিনি, যদিও ব্যাপকভাবে সংস্কৃত সাহিত্যের প্রতি নিবেদিতপ্রাণ ছিলেন, কিন্তু তিনি ঘোষণা করেছেন যে, বাস্তবে প্রকৃতির সন্তান শকুন্তলা নয়, মিরান্ডা। পরে, ঠাকুর বিপরীত দৃষ্টিভঙ্গি সামনে রেখেছিলেন। রবীন্দ্রনাথের কথা অনুযায়ী, মিরান্ডা নয়, শকুন্তলাই ছিলেন প্রকৃত অর্থে নিষ্পাপতা ও প্রকৃতির সন্তানের রূপ। বঙ্কিমচন্দ্র আরেকটি প্রবন্ধে অষ্টম শতাব্দীর কবি ভবভূতির ‘উত্তর রামচরিত’-এ রামের বিলাপকে শেকসপিয়রের ট্র্যাজেডির বিলাপের সঙ্গে তুলনা করে দেখেছেন এবং তার রায় সব মিলিয়ে সংস্কৃত কবিদের পক্ষে যায়নি।

এভাবে আমরা দেখতে পাই যে, একটি নতুন মূল্যবোধ ও একটি নতুন পদ্ধতির মূল্যায়ন বাংলা সমালোচনা এবং আমাদের নিজেদের কবিদের মর্যাদাদানের ক্ষেত্রে প্রবেশ করেছে। বিভিন্ন সাহিত্যিক রূপ যেমন সনেট, উপন্যাস ও আধুনিক মঞ্চনাটকও লেখা হয়ে গিয়েছিল। আমরা এসব কাজের মধ্যে পশ্চিমের প্রভাব লক্ষ্য করতে পারি। এ ‘প্রভাব’ শব্দটি একটি অবমাননাকর অর্থে ব্যবহার করা মোটেও ঠিক হবে না। এটা ঘটে সর্বক্ষেত্রে সব সাহিত্যে। পশ্চিমা দেশগুলোতে, বিশেষ করে আমেরিকা ও ইউরোপের কিছু মানুষ মনে করে যে, আধুনিক ভারতীয় সাহিত্য নিছক অনুকরণমূলক। এর কিছু সত্য থাকতে পারে। আমাদের অন্যান্য সংস্কৃতির অন্যান্য উদাহরণের দিকে তাকিয়ে দেখতে হবে যে, এটি বৈশ্বিক সাহিত্য ইতিহাসের একটি অনিবার্য অংশ এবং তা উপলব্ধি আমাদের করতে হবে। এটা বলাটা যতটা অর্থবহ, আবার ততটাই অর্থহীন হবে যে, বঙ্কিমচন্দ্র ওয়াল্টার স্কটকে অনুকরণ করেছিলেন, যেমনটা বলা যায় যে, শেকসপিয়র ওভিডকে অনুকরণ করেছিলেন। অবশ্যই একজন লেখক সর্বদা অন্যের কাছ থেকে অনেক কিছু নেন এবং যত বেশি বিদেশি সাহিত্যের সঙ্গে আমাদের পরিচিতি হচ্ছে, সৃজনশীল লেখকরা তাদের নিজস্ব জাতীয় সংস্কৃতির বাইরের উৎস থেকে ক্রমাগত উপাদান সংগ্রহ করছেন।

এ প্রেক্ষাপটে আপনার নিজের কাজ সম্পর্কে বলুন।

বুদ্ধদেব বসু: নিজের লেখা নিয়ে কথা বলা খুব কঠিন। আমি সবসময় পশ্চিমা সাহিত্যপ্রেমী। বিরোধী হিসেবে আমার কুখ্যাতি থাকলেও আমি বরাবরই ঠাকুরের সাহিত্য প্রেমিক। চলুন, আমি এবং আমার সমসাময়িকরা ঠাকুর থেকে দূরে সরে গিয়েছিলাম কীভাবে, তার ওপর একটি আলোকপাত করা যাক। আমরা সরাসরি ব্যক্তিগত প্রেমের কবিতা লিখেছিলাম। এমন নয় যে, ঠাকুর কখনো এটা করেননি। তিনি করেছিলেন, যখন তিনি বেশ তরুণ ছিলেন। কিন্তু তার সুপরিচিত কবিতাগুলোতে মানুষের প্রেম ও নারী-পুরুষের সম্পর্ক ধারাবাহিকভাবে অস্পষ্ট। ঠাকুরের অনেক কবিতা পড়ে এটা বের করা কঠিন যে, কবিতার ভালোবাসার প্রসঙ্গটি কি ঈশ্বর সম্পর্কে, নাকি শৈল্পিক অনুপ্রেরণা নিয়ে, নাকি নেপথ্যে একজন নারী রয়েছেন। কিন্তু আমাদের সময়ে, এমন অনেক কবিতা আছে যেগুলো অবিশ্বাস্যভাবে নারীদের উদ্দেশ্য করে পুরুষদের লিখিত এবং শব্দে প্রকাশিত নারীদের বাস্তবতা উপলব্ধিযোগ্য। আমি নিশ্চিত নই যে, এ ফলাফল কোনো পশ্চিমা প্রভাব কি না, তবে অবশ্যই আমরা ইংরেজি এবং জার্মান ভাষায় এ ধরনের কবিতার একটি বড় অংশ খুঁজে পাই। যদিও মধ্যযুগীয় পাশ্চাত্য সাহিত্যে এটি খুব বেশি নেই। সম্ভবত ঠাকুর ইউরোপীয় রোমান্টিসিজমের একটি দিক বেছে নিয়েছিলেন আর আমরা অন্য জেনারেশন অন্য একটি নিয়েছি।

স্বাভাবিকভাবেই, ঠাকুরের পর থেকে নতুন দিগন্ত উন্মোচিত হয়েছে। ১৯২০-এর দশকে আমরা সবাই রাশিয়ান এবং স্ক্যান্ডেনেভিয়ান দেশগুলোর সাহিত্য পড়েছিলাম। ইবসেন, দস্তয়েভস্কি ও চেখভের পাঠকপ্রিয়তা বাংলায় অব্যাহত রয়েছে এবং সমসাময়িক ফরাসি ও আমেরিকান সাহিত্য সম্ভবত ব্রিটিশদের তুলনায় বেশি পঠিত হয়েছে। বোদলেয়ার ও প্রতীকবাদীরা, পাউন্ড, এলিয়ট, ইয়েটস ব্যাপকভাবে প্রশংসিত। এ লেখকরা নতুন উদ্দীপনা সরবরাহ করেছেন, কিন্তু এ উদ্দীপনা ‘প্রভাব’-এর মতো নয়।

এবার বর্তমান সময়ে আসি, বাংলা সাহিত্যে দেশ ভাগের কি প্রভাব পড়েছে? পূর্ব বাংলায় কি বাংলাকে পারস্যকরণের চেষ্টা চলছে, পশ্চিম পাকিস্তানে যেমনভাবে উর্দুর? পূর্ব পাকিস্তানে কি পর্যাপ্ত লেখালেখি হচ্ছে এবং পশ্চিম বাংলার লেখালেখি থেকে সেগুলো কি খুব আলাদা?

বুদ্ধদেব বসু: পূর্ব পাকিস্তানের পরিস্থিতির সঙ্গে আমি খুব একটা পরিচিত নই। কিন্তু আমার কাছে মনে হচ্ছে পূর্ব পাকিস্তানের কবি ও সাহিত্যিকদের একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্নে সিদ্ধান্ত নিতে হবে যে, তারা কি বাঙালি কবি নাকি বাঙালি কবি নয়। যদি তারা নিজেদের বাঙালি কবি বলে মনে করেন তাহলে তাদের সুস্পষ্টভাবে পশ্চিম বাংলার সঙ্গে জোরালো সাংস্কৃতিক বন্ধন স্থাপন করা দরকার যেখানকার ভাষাও বাংলা। আদর্শগতভাবে, এমন অবস্থা হওয়া উচিত যেমন যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্য, কিংবা ফ্রান্স ও বেলজিয়ামের মতো। পৃথিবীতে রাজনৈতিকভাবে এবং স্পষ্টভাবে বিচ্ছিন্ন, কিন্তু সাংস্কৃতিক এবং ভাষাগতভাবে কাছাকাছি দেশগুলোর অনেক উদাহরণ রয়েছে। এখানে আরেকটি উদাহরণ হতে পারে জার্মানি ও অস্ট্রিয়া। কিন্তু বিভিন্ন কারণে পূর্ব পাকিস্তান এবং পশ্চিম বাংলার মধ্যে সাংস্কৃতিক বন্ধন এখনো দৃঢ় নয়। এমনকি খুব কম বিদ্যমান। পূর্ব পাকিস্তানের মানুষ বইয়ের জন্য ক্ষুধার্ত। আমাকে বলা হয়েছে, বিশিষ্ট বাঙালি লেখকদের রচনার পাইরেটেড সংস্করণ ঢাকায় প্রকাশিত হচ্ছে। আমি আমার ‘কবিতা’ পত্রিকায় ঢাকার বেশ কয়েকজন তরুণ কবির রচনা প্রকাশ করেছি। তাদের বক্তব্য পশ্চিম বাংলার কবিদের থেকে কোনোভাবেই আলাদা নয়। তাদের মধ্যে কেউ কেউ খুব বেশি সংস্কৃতমিশ্রিত ভাষায় লেখেন। কিন্তু আমি জানি যে সেখানে ভাষাকে ফার্সিকরণ করার একটি শক্তিশালী প্রবণতা রয়েছে, অন্তত একটি গোষ্ঠীর মধ্যে। তাদের প্রচেষ্টা আছে ঢাকার বাংলাকে উর্দু শব্দ ও ভাবের দ্বারা প্রভাবিত করার। কিন্তু আমরা মনে করি না বাংলা কবিতার কোনো ভবিষ্যৎ আছে সেখানে। গতকাল রাতে আমাদের একজন নারী বন্ধু বলছিলেন যে, ঢাকায় প্রকাশিত তরুণ পাকিস্তানিদের কিছু উপন্যাস তিনি পড়েছেন। এগুলোর মধ্যে বাংলা এতটাই আলাদা ছিল যে, তিনি তার নিজের ভাষাকে খুব কম চিনতে পেরেছেন। তিনি হিন্দি ও উর্দুও ভালো জানেন। তা সত্ত্বেও, আমি নিশ্চিত যে, এটি পাকিস্তানি লেখকদের একটি অংশকে প্রতিনিধিত্ব করে। সেখানে সাহিত্যিকদের আরেকটি অংশ আছে যারা বাংলার দুই অংশের মাঝখানে একটি দৃঢ় সাংস্কৃতিক বন্ধন চায়। এটা খুবই আনন্দের বিষয় হবে যদি এটা ঘটে।

সমসাময়িক কবিতার প্রধান বিষয়গুলো কী? আপনার মতে, সমসাময়িক শ্রেষ্ঠ কবিদের মধ্যে কারা আছেন?

বুদ্ধদেব বসু: বিশ্বাস হারানো ও যন্ত্রণার নির্দিষ্ট অনুভূতি আধুনিক বাংলা কবিতাকে ঠাকুরের থেকে আলাদা করেছিল। মূল কথা হলো, কবিরা আর নিরাপদ বোধ করেন না। এর সঙ্গে রাজনৈতিক পরিস্থিতির সম্পর্ক থাকতে পারে, কিন্তু এটি একটি ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা; মানুষ এবং মহাবিশ্বের মধ্যে একটি নতুন ধরনের সংঘর্ষ। আমার মনে হয়, এটিই বাংলা কবিতার প্রভাবশালী মাত্রা, যা আজ থেকেও পঞ্চাশ বা একশ বছর ধরে পঠিত হবে।

আমি মনে করি বাঙালির তরুণ প্রজন্মের কবিরা দুটি প্রধান ধারায় বিভক্ত। একটি ধারার কবিরা জীবন-বিশ্বাসী, যারা উচ্চ মানের আবেগকে এড়িয়ে গিয়ে ঘরসংসার-পরিবার ও প্রকৃতিকে গুরুত্ব দিয়ে লিখেছেন। অন্য দলটিকে কখনো কখনো আমেরিকান বিট জেনারেশনের সঙ্গে তুলনা করা হয়েছে, এ শিরোনাম তারা নিজেরাই দাবি করেছেন, তাদের একজন নিজেকে বিশেষভাবে ‘আলোকিত মানুষ’ বলে দাবি করেন। আমি বলতে পারি হয়তো তারা ইলুমিনাতিতে বিশ্বাস করতে পারেন, কিন্তু সামাজিক প্রতিষ্ঠানের প্রতি তাদের কোনো সম্মান নেই! তাদের শৈলী এবং ভাষণে একটি সমসাময়িক ঘ্রাণ আছে। এটা ঠিক, আমি এখানে হালকাভাবে আধুনিক বাংলা কবিতার শুধু কিছু বিষয় স্পর্শ করেছি এবং আরও অনেক কিছু স্পর্শ করতে পারিনি। আমি আশা করি যে, এ খণ্ডিত মন্তব্য আপনাকে সমসাময়িক বাংলা কবিতা সম্পর্কে আরও জানার জন্য উদগ্রীব করে তুলবে। আপনাকে ধন্যবাদ।

শিকাগো, ১৯৬৪

কালবেলা অনলাইন এর সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিডটি অনুসরণ করুন
  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

পুঁজিবাজারের পরিস্থিতি উন্নয়নে প্রধান উপদেষ্টার পাঁচ নির্দেশনা 

আ.লীগ নিষিদ্ধ একটি যুগান্তকারী পদক্ষেপ : কর্নেল অলি

‘আ.লীগ নিজেরাই নিজেদের রাজনীতির মৃত্যু ঘটিয়েছে’

বিএনপি যা চেয়েছে তাই হয়েছে : এ্যানি

আ.লীগের সাবেক এমপিসহ গ্রেপ্তার ৭

সন্ধ্যা ৬টার মধ্যে যেসব জেলায় হতে পারে বজ্রবৃষ্টি

সীমান্তে কঠোর অবস্থানে বিজিবি-পুলিশ

কমেছে সোনার দাম, কার্যকর আজ

রংপুরে আবহাওয়া পর্যবেক্ষণে নতুন দিগন্তের সূচনা

যশোরে দুগ্রুপের সংঘর্ষে বিএনপি কর্মী নিহত

১০

আ.লীগ নিষিদ্ধের খবরে জাবিতে মিষ্টি বিতরণ

১১

বিশ্লেষণ / যুদ্ধে ভারতের ক্ষতি ৮৩ বিলিয়ন, পাকিস্তানের কত? 

১২

আ.লীগের কার্যক্রম নিষিদ্ধ ঘোষণায় আখাউড়ায় মিষ্টি বিতরণ

১৩

বগুড়ায় মহিলা আ.লীগের ২ নেত্রী গ্রেপ্তার

১৪

আবদুল হামিদ ফ্যাসিবাদের প্রতিনিধি ছিলেন : রিজভী

১৫

চোখ রাঙাচ্ছে ঘূর্ণিঝড় ‘শক্তি’

১৬

ভারতে যাওয়ার সময় আ.লীগ নেতা গ্রেপ্তার

১৭

বান্দরবানে নানা আয়োজনে বুদ্ধপূর্ণিমা উদযাপন

১৮

নাটোরে ট্রেনে কাটা পড়ে বৃদ্ধের মৃত্যু

১৯

আ.লীগ পালিয়েছে বলায় বিএনপির ৪ কর্মীকে কুপিয়ে জখম

২০
X