দেশের ইস্পাত শিল্পের কাঁচামালের অন্যতম জোগানদাতা ‘জাহাজ ভাঙা শিল্প’। বর্তমানে বিলেট থেকে রড উৎপাদন হলেও দেশের ইস্পাত শিল্পের প্রায় ৫০ শতাংশ কাঁচামালের জোগান দেয় এই শিপ ব্রেকিং ইন্ডাস্ট্রি। এই খাত থেকে প্রতি বছর আয় হয় প্রায় ৭৭০ মিলিয়ন ডলার। যেখান থেকে সরকারের রাজস্ব আয় হয় প্রায় ১১০ মিলিয়ন ডলার বা দেড় হাজার কোটি টাকা। প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে এই খাতে জড়িত সাড়ে ১০ লাখ মানুষ।
খাতটি শিল্পের জন্য আশীর্বাদ হলেও এর উল্টো পাতায় রয়েছে বিভীষিকাময় গল্প। অনিরাপদ পরিবেশের কারণে ২০১৫ সাল থেকে ২০২৪ সালের জুন পর্যন্ত প্রাণ গেছে এই খাতের ১২৪ শ্রমিকের। শোভন কর্মপরিবেশ না থাকা, শ্রমিক মৃত্যুর হার বেড়ে যাওয়ায় দেশের শিপইয়ার্ডগুলোকে গ্রিনইয়ার্ডে রূপান্তরের নির্দেশনা দেয় হংকং কনভেনশন। আগামী বছর জুন মাসে জাহাজ ভাঙা শিল্পের জন্য কার্যকর হতে যাচ্ছে হংকং কনভেনশন নামে এই আইন। এটি বাস্তবায়ন শুরু হলে শধু গ্রিন শিপইয়ার্ডগুলোই ভাঙার জন্য আনতে পারবে জাহাজ। কিন্তু এ পর্যন্ত দেশের ৪৫টি শিপইয়ার্ডের মধ্যে গ্রিন তকমা পেয়েছে চারটি প্রতিষ্ঠান। বাকি ৪১টি শিপইয়ার্ডে এখন আতঙ্ক, আগামী বছর জুন মাসে শিপইয়ার্ডে ‘লালবাতি’ জ্বলে ওঠার ভয়। ফলে আগামী বছর বড় চ্যালেঞ্জের মুখে পড়তে যাচ্ছে বড় এ শিল্প। অন্যদিকে শিপইয়ার্ডগুলোকে দ্রুত গ্রিনইয়ার্ডে রূপান্তরিত না করা হলে বাংলাদেশে স্ক্র্যাপ জাহাজ পাঠানো বন্ধ করে দেওয়া হবে বলে জানিয়েছেন বিদেশি বিক্রেতারা।
বাংলাদেশ শিপ ব্রেকার্স অ্যান্ড রিসাইক্লার্স অ্যাসোসিয়েশন (বিএসবিআরএ) ও শিল্প মন্ত্রণালয়ের তথ্যমতে, বাংলাদেশে প্রায় ১৫৬টি শিপইয়ার্ড নিবন্ধিত আছে। মাত্র ৪৫টির মতো শিপইয়ার্ড তাদের নিয়মিত কার্যক্রম পরিচালনা করছে। এর মধ্যে দেশের যে চারটি শিপব্রেকিং ইয়ার্ড গ্রিন শিপইয়ার্ডে রূপান্তরিত হয়েছে, সেগুলো হলো কেআর শিপ রি-সাইকেলিং ইয়ার্ড, কবির স্টিল লিমিটেড, পিএইচপি শিপব্রেকিং অ্যান্ড রি-সাইকেলিং ইন্ডাস্ট্রিজ লিমিটেড ও এসএন করপোরেশন। দ্য শিপ ব্রেকিং অ্যান্ড রিসাইক্লিং রুলস ২০১১, আন্তর্জাতিক আইন এবং ২০০৯ সালের চীনে অনুষ্ঠিত হংকং কনভেনশন রুলস অনুযায়ী, ২০২৫ সালের জুন মাসে বাংলাদেশের সব শিপব্রেকিং ইয়ার্ড গ্রিন শিপইয়ার্ডে রূপান্তরিত করতে হবে।
জাহাজ ভাঙা শ্রমিক ট্রেড ইউনিয়ন ফোরামের সদস্য সচিব ফজলুল কবির মিন্টু কালবেলাকে বলেন, ২০১৫ থেকে ২০২৪ সালের জুন পর্যন্ত ১২৪ শ্রমিক নিহত হয় জাহাজ ভাঙা শিল্পের। ২০২৩ সাল পর্যন্ত প্রতি বছর গড়ে ১৩ দশমিক ৫৫ জন শ্রমিক নিহত হলেও এই বছর জুন পর্যন্ত শুধু একজন শ্রমিক নিহত হয়েছে। ২০২৩ সালে প্রথম ৬ মাসে দুর্ঘটনার সংখ্যা ১৯টি ছিল। একই সময়ে এই বছর দুর্ঘটনার সংখ্যা হচ্ছে ১২টি। বিএসবিআরএর সহকারী সচিব নাজিমুল ইসলাম কালবেলাকে বলেন, ১৫৬টি শিপইয়ার্ডের নিবন্ধন থাকলেও নিয়মিতভাবে কার্যক্রম পরিচালনা করছে মাত্র ৪৫টি প্রতিষ্ঠান। এর মধ্যে চারটি প্রতিষ্ঠান গ্রিন শিপইয়ার্ডের তালিকাভুক্ত। ২০১৮ সালে হংকং কনভেনশন নামে একটি আইন হয়, যা বাস্তবায়ন হবে আগামী বছর অর্থাৎ ২০২৫ সালের জুন মাসে। সে আইন অনুযায়ী ওই সময়ের পর গ্রিনইয়ার্ড না হলে কেউ ব্যবসা করতে পারবে না, অনুমোদন পাবে না জাহাজ আনার।
তিনি আরও বলেন, মূল কথা হচ্ছে, প্রতিটি ইয়ার্ডে জাহাজ ভাঙার জন্য পরিবেশবান্ধব হিসেবে পরিস্থিতি তৈরি করতে হবে। সেই পরিবেশ নিশ্চিত করা গেলেই আন্তর্জাতিক সংস্থা তাদের সার্টিফাইড করবে। তার পরই এসব প্রতিষ্ঠান অনুমোদিত হিসেবে গণ্য হবে। আর না হয় আগামী বছরের জুনের পরই বন্ধ হয়ে যাবে এসব ইয়ার্ড। বিএসবিআরএর সহসভাপতি মো. জহিরুল ইসলাম বলেন, যেসব ইয়ার্ড হংকং কনভেনশনের আদলে উন্নীত হবে শুধু তারাই জাহাজ আনতে পারবে। তাই আমাদের ৭০ থেকে ৮০টি ইয়ার্ড পিছিয়ে পড়ার শঙ্কা রয়েছে।
গ্রিন সনদ পেতে যে চ্যালেঞ্জ: ২০১৭ সালে পিএইচপি ফ্যামিলির প্রতিষ্ঠান পিএইচপি শিপব্রেকিং ইয়ার্ড গ্রিনইয়ার্ড হিসেবে স্বীকৃতি পায়। প্রতিষ্ঠানটিকে জাহাজ কাটার জন্য গ্রিন সনদ দেয় ইতালির আন্তর্জাতিক ক্ল্যাসিফিকেশন সোসাইটি (রিনা)। পিএইচপির ইয়ার্ডটি হলো হংকং কনভেনশন অনুযায়ী বাংলাদেশের প্রথম সুরক্ষামূলক শিপইয়ার্ড। তারা গ্রিনইয়ার্ড করার কর্মযজ্ঞ শুরু করে আরও পাঁচ বছর আগে।
প্রতিষ্ঠানটির ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) মো. জহিরুল ইসলাম বলেন, আমরা ২০১৫ সাল থেকে পরিবেশসম্মতভাবে জাহাজ কাটার কাজে মনোনিবেশ করি। এর জন্য অনেক টাকা খরচ করতে হয়েছে। ২০১৭ সালের ১০ অক্টোবর আমরা পরিবেশসম্মত সনদ গ্রিন সনদ পাই। এজন্য খরচ হয়েছে ৩৫ কোটি টাকা। গ্রিনইয়ার্ড করলে জাহাজ কেনায় কিছু ছাড় পাওয়া যায়। তবে এর আনুষঙ্গিক খরচ অনেক। তার পরও আমরা খুশি। কারণ, এখন স্বয়ংক্রিয় পদ্ধতিতে কাজ হচ্ছে। ফলে ঝুঁকি অনেক কমেছে। জানা যায়, বাংলাদেশে গ্রিন শিপইয়ার্ডে রূপান্তরের সবচেয়ে বড় বাধা মূলধন। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বাংলাদেশে চার মাস বৃষ্টিপাত থাকে। এ সময় ইয়ার্ড কর্দমাক্ত থাকে। তাই পুরো ইয়ার্ড কংক্রিট ঢালাই করতে হয়। এ ছাড়া জাহাজ একটু দূরে থাকলে সেখানে বার্থিং সিস্টেম এবং ভারি ক্রেনসহ অন্যান্য যন্ত্রপাতি প্রয়োজন পড়ে। এতে একেকটি শিপইয়ার্ডকে গ্রিন শিপইয়ার্ডে পরিণত করতে ৩০ থেকে ৪০ কোটি টাকার প্রয়োজন হয়। এ অবস্থায় স্বল্প সুদে দীর্ঘমেয়াদি ঋণ এবং বিদেশিদের এ খাতে বিনিয়োগের আহ্বান বিশেষজ্ঞদের।
সরকার ও আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলোর দিকে তাকিয়ে উদ্যোক্তারা: গ্রিন শিপইয়ার্ড রূপান্তর ব্যয়বহুল। এজন্য একেকটি ইয়ার্ডের খরচ হয় ৪০ থেকে ৫০ কোটি টাকা। এই বাড়তি খরচের জন্য সরকার, বাংলাদেশ ব্যাংক ও বিদেশি সংস্থাগুলোকে এগিয়ে আসার আহ্বান জানিয়েছেন এ খাতের উদ্যোক্তারা।
বর্তমানে বিশ্বে জাহাজ ভাঙায় প্রথম অবস্থানে বাংলাদেশ। সবশেষ ২০২৩ সালে দেশে জাহাজ ভাঙা হয়েছে ১৭০টি। দ্বিতীয় অবস্থানে থাকা ভারত জাহাজ ভেঙেছে ১৪০টি। তৃতীয় অবস্থানে থাকা তুরস্ক ৪৪টি এবং চতুর্থ অবস্থানে থাকা পাকিস্তান ১৫টি জাহাজ ভেঙেছে। এখনো বিশ্বে প্রায় ১৫ হাজার জাহাজ রিসাইক্লিংয়ের অপেক্ষায় আছে। কিন্তু গ্রিন শিপইয়ার্ড না হলে এ বিপুল জাহাজ আসবে না বাংলাদেশে। ২০২৩ সালে বাংলাদেশ ৩২ লাখ ৩২ হাজার টনের জাহাজ ভেঙেছে। একই সময়ে ভারত ভেঙেছে ২৬ লাখ ১০ হাজার টন। পাকিস্তান ভেঙেছে ৬ লাখ ৮০ হাজার টনের জাহাজ, যা ইস্পাত শিল্পের স্ক্র্যাপ হিসেবে ব্যবহৃত হয়।
আর্থিক বিষয়টি স্বীকার করে আরেফিন এন্টারপ্রাইজের স্বত্বাধিকারী হোসাইনুল আরেফিন গণমাধ্যমকে বলেন, আমাদের শিপইয়ার্ডটিকে গ্রিনইয়ার্ডে রূপান্তরিত করার জন্য প্ল্যানের অনুমোদন শিল্প মন্ত্রণালয় দিয়েছে। জার্মানির একটি প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে আমরা চুক্তিবদ্ধ হয়ে কাজ শুরু করেছি। কিন্তু আমার ইয়ার্ডটি ছোট হলেও গ্রিনইয়ার্ড সম্পূর্ণ করতে অন্তত ২০ কোটি টাকা প্রয়োজন। অন্যদিকে ব্যাংকের ইন্টারেস্ট হার বেশি থাকায় আমরা আর্থিক বিষয়টি নিয়ে চিন্তিত।