দীর্ঘ একযুগ আগে গঠন করা হয় বরিশাল জেলা ও মহানগর ছাত্রলীগের কমিটি। এরপর দুই দফা ভাঙাগড়া হলেও এক কমিটিতেই যুগ পার করেছে জেলা ছাত্রলীগ। এ কমিটিতে যারা নেতৃত্বে রয়েছেন, তাদের কারোরই নেই ছাত্রত্ব। হয়েছেন একাধিক সন্তানের বাবা। তাদের সন্তানরাও এখন বিভিন্ন স্কুলের ছাত্র। ছাত্রলীগের সভাপতি হেমায়েত উদ্দিন সেরনিয়াবাত সুমন দায়িত্ব পালন করছেন মহানগর আওয়ামী লীগের দপ্তর সম্পাদকের। সাধারণ সম্পাদক আব্দুর রাজ্জাকের লক্ষ্য এখন যুবলীগে। সহসভাপতি, যুগ্ম সম্পাদকরাও বিয়ে করে সংসার করছেন। দুজন সাংগঠনিক সম্পাদক
হয়েছেন বরিশাল সিটি করপোরেশনের কাউন্সিলর। ফলে নেতৃত্ব সংকটে পড়েছে জেলা ছাত্রলীগ। এর পরও জেলা ছাত্রলীগকে পুনর্গঠনের উদ্যোগ নেই।
অভিযোগ রয়েছে, বরিশাল আওয়ামী রাজনীতিতে পরিবারতন্ত্র আর আধিপত্য ধরে রাখতেই মেয়াদ উত্তীর্ণ জেলা ছাত্রলীগকে পুনর্গঠনের উদ্যোগ নেই। তবে কমিটি না হওয়ার জন্য বরিশাল জেলা ছাত্রলীগ নেতারা দায়ী করছেন কেন্দ্রীয় কমিটিকে। কেন্দ্রের নির্দেশনা না থাকায় একযুগেও নতুন কমিটি করা সম্ভব হয়নি বলে জানান জেলা ছাত্রলীগের সভাপতি হেমায়েত উদ্দিন সেরনিয়াবাত সুমন।
জানা গেছে, ২০১১ সালের ৯ জুলাই বরিশাল জেলা ও মহানগর ছাত্রলীগের তিন সদস্যবিশিষ্ট পৃথক কমিটি ঘোষণা করা হয়। এর মধ্যে জেলা ছাত্রলীগে হেমায়েত উদ্দিন সেরনিয়াবাত সুমনকে সভাপতি, আব্দুর রাজ্জাককে সাধারণ সম্পাদক এবং সৈয়দ শামসুদ্দোহা আবিদকে সাংগঠনিক সম্পাদক করে জেলা ছাত্রলীগ এবং মো. জসিম উদ্দিনকে সভাপতি, অসীম দেওয়ানকে সাধারণ সম্পাদক ও তৌছিক আহমেদ রাহাতকে সাংগঠনিক সম্পাদক করে মহানগর ছাত্রলীগের তিন সদস্যের কমিটি ঘোষণা করা হয়। তিন বছর মেয়াদি দুটি কমিটি গঠনের তিন বছর পর ১০৯ সদস্যবিশিষ্ট পূর্ণাঙ্গ কমিটি জেলা ছাত্রলীগের। কমিটিতে ১৮ জনকে সহসভাপতি ও সাতজনকে যুগ্ম সম্পাদক করা হয়। অন্যদিকে, নানা বিতর্কে জড়িয়ে মহানগর ছাত্রলীগের কমিটি থেকে বহিষ্কার হন সাধারণ সম্পাদক অসীম দেওয়ান। সাংগঠনিক সম্পাদক তৌছিক আহমেদ রাহাত বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়ে কর্মজীবন শুরু করায় ছাত্রলীগ থেকে নিজেকে গুটিয়ে নেন। শুধু সভাপতি একাই চালিয়েছেন মহানগর ছাত্রলীগ। তাও পুনর্গঠনের আগেই একটি ধর্ষণ মামলায় জড়িয়ে তিনিও বহিষ্কার হন।
পরে তৎকালীন বরিশাল সিটি মেয়র সেরনিয়াবাত সাদিক আবদুল্লাহর অনুসারী বর্তমান শ্রমিক লীগের সাধারণ সম্পাদক রইজ আহমেদ মান্নাকে আহ্বায়ক করে প্রথমে আংশিক এবং পরে ৩২ সদস্যবিশিষ্ট পূর্ণাঙ্গ আহ্বায়ক কমিটি অনুমোদন দেন ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় কমিটির সাবেক সভাপতি আল নাহিয়ান খান জয় ও সাধারণ সম্পাদক লেখক ভট্টাচার্য। শেষমেশ গত সিটি নির্বাচনে আওয়ামী লীগের প্রার্থীর কর্মীদের ওপর হামলার অভিযোগে মহানগর ছাত্রলীগের আহ্বায়ক কমিটি বিলুপ্ত ঘোষণা করে বর্তমান কেন্দ্রীয় কমিটি। বর্তমানে কমিটিবিহীন অবস্থায় চলছে মহানগর ছাত্রলীগের কার্যক্রম। আর ১২ বছর আগের কমিটি দিয়ে চলছে জেলা ছাত্রলীগের কার্যক্রম। ফলে বরিশাল ছাত্রলীগে যেমন নেতৃত্বের সংকট দেখা দিয়েছে, তেমনি ছাত্রলীগের পদ পেতে রাজপথে সক্রিয় নেতাদের মধ্যে বাড়ছে হতাশা। আদৌ নেতৃত্বের স্বপ্ন পূরণ হবে কি না, তা নিয়ে আছেন ধোঁয়াশার মধ্যে।
জেলা ছাত্রলীগের পদপ্রত্যাশী একাধিক নেতা বলেন, ‘বরিশালে আওয়ামী লীগের যে কোনো কর্মসূচি সফল এবং গণজমায়েত ঘটাতে মুখ্য ভূমিকায় থাকছে ছাত্রলীগ। পদপ্রত্যাশী নেতারা নিজেদের পকেটের অর্থ খরচ করে প্রতিটি কর্মসূচিতে ছাত্রদের অংশগ্রহণে গণজমায়েত করছেন। অথচ সুফল নিচ্ছেন কমিটির বর্তমান পদপদবির নেতারা।
এদিকে নেতৃত্ব সংকট দেখা দিলেও দলীয় কর্মসূচি পালনে কোনো ভাটা পড়েনি বলে দাবি জেলা ছাত্রলীগের বর্তমান পদপদবিধারী নেতাদের। দলের যে কোনো আন্দোলন সংগ্রাম এবং কর্মসূচিতে জেলা ছাত্রলীগ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে বলে দাবি করেন তারা।
ছাত্রলীগের বর্তমান কমিটির সভাপতি হেমায়েত উদ্দিন সুমন সেরনিয়াবাত বর্তমানে ছাত্রলীগ ছেড়ে মহানগর আওয়ামী লীগের দপ্তর সম্পাদকের পদে থেকে নেতৃত্ব দিচ্ছেন। এ ছাড়া সাধারণ সম্পাদক আব্দুর রাজ্জাক ছুটছেন যুবলীগের দিকে। আর সাংগঠনিক সম্পাদক সৈয়দ শামসুদ্দোহা আবির সদ্য অনুষ্ঠিত সিটি করপোরেশন নির্বাচনে ৪ নম্বর ওয়ার্ড কাউন্সিলর নির্বাচিত হয়েছেন। অন্যজন রাজিব হোসেন খান ১৬ নম্বর ওয়ার্ডে উপনির্বাচনে কাউন্সিলর নির্বাচিত হন। সভাপতি-সম্পাদকসহ তাদের কারোরই নেই ছাত্রত্ব। সবাই বিয়ে করে সন্তানের বাবা হয়েছেন।
ছাত্রলীগের নেতারা অভিযোগ করেছেন, জেলা ছাত্রলীগে বর্তমানে যারা নেতৃত্বে আছেন, তারা সবাই জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি আবুল হাসানাত আবদুল্লাহ এবং মহানগর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক সেরনিয়াবাত সাদিক আবদুল্লাহর অনুসারী। তাদের কারণেই জেলা ছাত্রলীগের নতুন কমিটি হচ্ছে নাম, যার বড় প্রমাণ মহানগর ছাত্রলীগ। তারা চেয়েছেন বিধায় মহানগর ছাত্রলীগের আগের কমিটি ভেঙে আহ্বায়ক কমিটি হয়েছে।
বরিশাল জেলা ছাত্রলীগের সভাপতি হেমায়েত উদ্দিন সেরনিয়াবাত সুমন বলেন, ‘আমরাও চাই ছাত্রলীগের নতুন কমিটি হোক এবং নতুন নেতৃত্ব আসুক। এতদিনেও কেন জেলা ছাত্রলীগের কমিটি হলো না—এমন প্রশ্নে তিনি বলেন, ‘বিভিন্ন আন্দোলন-সংগ্রামে সময় দিতে গিয়ে নতুন করে সম্মেলনের আয়োজন করা সম্ভব হয়নি। কেন্দ্র থেকেও কোনো নির্দেশনা পাইনি। কমিটি গঠনের ক্ষেত্রে কারোর সদিচ্ছার অভাব রয়েছে কি না—এমন প্রশ্নে তিনি বলেন, ‘তেমন কোনো বিষয় না। তবে আমাদের অভিভাবক আছেন (আবুল হাসানাত আবদুল্লাহ), তিনি যখন বলবেন এবং কেন্দ্র থেকে যখন নির্দেশ দেবে, তখন নতুন কমিটি করব। জাতীয় নির্বাচন আসন্ন হওয়ায় এই মুহূর্তে নতুন কমিটি গঠন সম্ভব নয়। নির্বাচনের পর সম্মেলন করে জেলা ছাত্রলীগের নতুন কমিটি দেওয়া হবে।
বরিশাল জেলা ছাত্রলীগের একযুগের মেয়াদ উত্তীর্ণ কমিটির বিষয়ে বক্তব্য জানতে ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় কমিটির সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদককে একাধিকবার ফোন করা হলেও তারা রিসিভ করেননি।
মন্তব্য করুন