বিশ্বে পরিবেশগত বিপর্যয়ে দক্ষিণ এশিয়ার সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত দেশ হচ্ছে বাংলাদেশ। ভৌগোলিক অবস্থানগত কারণে ও সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধির কারণে ২০৫০ সালের মধ্যে বাংলাদেশের একটি অংশ তলিয়ে যাওয়ার আশঙ্কা দিন দিন বাড়ছে। এরই মধ্যে দেশের নানা স্থানে জলবায়ুগত পরিবর্তনের জন্য ভয়ংকর ক্ষতিকর প্লাস্টিকের অনিয়ন্ত্রিত ব্যবহারকে দায়ী করা হচ্ছে। প্লাস্টিকের অনিয়ন্ত্রিত ব্যবহারের কারণে নাব্য হারাচ্ছে নদী ও খাল। একই কারণে উর্বরতা হারাচ্ছে ফসল, গাছগাছালি লাগানোর জন্য মাটি (টপ সয়েল)। এমনকি মানুষের জন্য তৈরি বিভিন্ন ধরনের খাবারের মধ্যেও প্লাস্টিকের উপস্থিতি পাওয়া যাচ্ছে। এ ছাড়া পানিতে লবণাক্ততা বৃদ্ধি, বায়ুদূষণ, শব্দদূষণ তো আছেই। এ সবকিছুর পেছনে মানুষের সচেতনতার অভাবকে বড় করে দেখা হচ্ছে।
এই প্রেক্ষাপটে আজ পালিত হচ্ছে বিশ্ব পরিবেশ দিবস ২০২৫। বেসরকারি পরিবেশবাদী কয়েকটি সংগঠন দিবসটি উপলক্ষে কর্মসূচি পালন করলেও সরকারিভাবে আগামী ২৫ জুন বাংলাদেশে আনুষ্ঠানিকভাবে দিবসটি পালন করা হবে। কারণ, আজ থেকে ঈদুল আজহার সরকারি ছুটি। পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রণালয় থেকে পাঠানো এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে এ তথ্য জানানো হয়েছে। এবারের বিশ্ব পরিবেশ দিবসের প্রতিপাদ্য হচ্ছে ‘প্লাস্টিক দূষণ আর নয়, বন্ধ করার এখনই সময়।’
বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়েছে, পরিবেশ দিবসের অনুষ্ঠানটি রাজধানীর শেরেবাংলা নগরের বাংলাদেশ চীন মৈত্রী আন্তর্জাতিক সম্মেলন কেন্দ্রে অনুষ্ঠিত হবে। প্রধান উপদেষ্টা অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত থাকবেন। তিনি ওইদিন বৃক্ষরোপণের মাধ্যমে জাতীয় বৃক্ষরোপণ অভিযান এবং মাসব্যাপী বৃক্ষমেলা ও পরিবেশ মেলার উদ্বোধন করবেন। এ ছাড়া তিনি অনুষ্ঠানে জাতীয় পরিবেশ পদক, বৃক্ষরোপণ ও বন্যপ্রাণী সংরক্ষণে জাতীয় পদক বিতরণ করবেন। ১৯৭২ সালে জাতিসংঘের মানবিক পরিবেশ সংক্রান্ত আন্তর্জাতিক সম্মেলনের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী জাতিসংঘের পরিবেশ কর্মসূচির উদ্যোগে প্রতি বছর সারাবিশ্বের একশটির বেশি দেশে ৫ জুন বিশ্ব পরিবেশ দিবস হিসেবে পালিত হয়ে আসছে। দিবসটির আয়োজক হিসেবে কাজ করছে দক্ষিণ কোরিয়া।
জাতিসংঘের এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বিশ্বে প্রতি মিনিটে প্রায় ৫ লাখ প্লাস্টিক বোতল বিক্রি হচ্ছে, যার মধ্যে বছরে ৮০ লাখ টন প্লাস্টিক বর্জ্য সাগরে গিয়ে পড়ে। ২০৫০ সাল নাগাদ বছরে এর পরিমাণ হবে ১ লাখ ৩০ হাজার টন। ২০২২ সালের মার্চে এক ডাচ গবেষণায় ২২ জন সুস্থ প্রাপ্তবয়স্ক ব্যক্তির রক্তের নমুনা থেকে ৮০ শতাংশের মধ্যে মাইক্রোপ্লাস্টিকের উপস্থিতি পাওয়া গেছে।
বাংলাদেশ প্রায় ১ বিলিয়ন ডলারের প্লাস্টিক দ্রব্যের বাজার। উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠান প্রায় ৪ হাজার। টুওয়ার্ডন এ মাল্টিসেক্টরাল অ্যাকশন প্ল্যান ফর সাসটেইনেবল প্লাস্টিক ম্যানেজমেন্ট ইন বাংলাদেশ শীর্ষক প্রতিবেদন অনুসারে, বাংলাদেশের শহরাঞ্চলে বার্ষিক মাথাপিছু প্লাস্টিক ব্যবহার ২০০৪ সালে ছিল ৩ কেজি, যা গত ১৫ বছরে (২০২০ সালে) বেড়ে ৯ কেজিতে দাঁড়িয়েছে! ঢাকার অবস্থা তো আরও খারাপ, যেখানে প্লাস্টিকের ব্যবহার মাথাপিছু ২৪ কেজি। শুধু ঢাকা শহরেই প্রতিদিন ১ কোটি ২০ লাখ প্লাস্টিক বর্জ্য পরিত্যক্ত হয়ে নালা, ড্রেন, পুকুর বা ডোবায় গিয়ে জমা হচ্ছে।
আর এই প্লাস্টিকগুলোর শেষ গন্তব্য বুড়িগঙ্গা, কর্ণফুলী, কৃষিজমি আর সাগর। প্লাস্টিকের ধরন এবং পরিবেশগত অবস্থার ওপর নির্ভর করে এটি পচতে ৫০০ বছরেরও বেশি সময় লাগতে পারে। কিছু প্লাস্টিকের ক্ষেত্রে তো ১ হাজার বছর পর্যন্তও লেগে যেতে পারে। পরিবেশ বিশেষজ্ঞরা বলছেন, প্লাস্টিক কণা, বিশেষ করে মাইক্রোপ্লাস্টিক (৫ মিমির কম আকারের প্লাস্টিক), মাটির ভৌত গঠন পরিবর্তন করে। এটি মাটির কণিকাগুলোর মধ্যে ফাঁকা স্থান পূরণ করে দেয়, যা মাটির বায়ুসঞ্চালন এবং পানি নিষ্কাশন ব্যবস্থাকে ক্ষতিগ্রস্ত করে। প্লাস্টিক যখন ক্ষয় হয়, তখন ক্যাডমিয়াম, ক্রোমিয়াম, আর্সেনিক, সিসা ইত্যাদি ক্ষতিকর রাসায়নিক পদার্থ মাটিতে ও পানিতে ছড়িয়ে পড়ে। এ বিষাক্ত পদার্থগুলো মাটি ও ফসলের মাধ্যমে খাদ্য শৃঙ্খলে প্রবেশ করে, যা শেষ পর্যন্ত মানবস্বাস্থ্যের জন্য মারাত্মক হুমকি সৃষ্টি করে। বাংলাদেশ সরকারের ন্যাশনাল অ্যাকশন প্ল্যান ফর সাসটেইনেবল প্লাস্টিক ম্যানেজমেন্টের লক্ষ্যমাত্রা অনুযায়ী, সরকার ২০২৫ সালের মধ্যে ৫০ শতাংশ প্লাস্টিক পুনর্ব্যবহার এবং ২০২৬ সালের মধ্যে ৯০ শতাংশ একবার ব্যবহারযোগ্য প্লাস্টিক পর্যায়ক্রমে বাদ দেওয়ার লক্ষ্য নিয়েছে।
অন্তর্বর্তী সরকার ক্ষমতায় আসার পর দেশে শপিংমল, হাটবাজারে প্লাস্টিক ব্যবহার বন্ধে নির্দেশনা জারি করে। এতে ব্যবহার কিছুটা কমে এলেও পুরোপুরি থামেনি। এ অবস্থায় প্রায় প্রতিদিনই পরিবেশ অধিদপ্তর প্লাস্টিকের বিরুদ্ধে অভিযান পরিচালনা করছে। অন্যদিকে, প্লাস্টিকের ব্যবহার কমাতে এবং পরিবেশবান্ধব পাটজাত পণ্যের ব্যবহার বাড়াতে সরকারের পক্ষ থেকে নেওয়া হয়েছে নানা উদ্যোগ।
জাতীয় পরিবেশ পদক পাচ্ছেন ৩ ব্যক্তি এবং ৩ প্রতিষ্ঠান: পরিবেশ সংরক্ষণ ও দূষণ নিয়ন্ত্রণ, শিক্ষা ও প্রচার এবং এবং পরিবেশবিষয়ক গবেষণা ও প্রযুক্তি উদ্ভাবনে উল্লেখযোগ্য অবদানের স্বীকৃতিস্বরূপ ‘জাতীয় পরিবেশ পদক ২০২৪’ প্রদানের জন্য তিনজন ব্যক্তি ও তিনটি প্রতিষ্ঠানকে চূড়ান্তভাবে মনোনীত করেছে সরকার। সম্প্রতি পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রণালয়ে অনুষ্ঠিত জাতীয় পরিবেশ পদক, ২০২৪ প্রদানের লক্ষ্যে গঠিত জাতীয় কমিটির সভায় এ মনোনয়ন চূড়ান্ত করা হয়েছে।
পরিবেশ সংরক্ষণ ও দূষণ নিয়ন্ত্রণ বিভাগে অবদানের জন্য ব্যক্তি পর্যায়ে পঞ্চগড়ের তেঁতুলিয়া উপজেলার আজিজনগর গ্রামের বাসিন্দা মো. মাহমুদুল ইসলামকে এবং প্রাতিষ্ঠানিক পর্যায়ে ঢাকার ধামরাইয়ের ‘স্নোটেক্স আউটারওয়্যার লিমিটেড’ পদকের জন্য মনোনীত করা হয়েছে।
পরিবেশবিষয়ক শিক্ষা ও প্রচার ক্যাটাগরিতে ব্যক্তি পর্যায়ে মনোনয়ন পেয়েছেন চট্টগ্রামের সিডিএ আবাসিক এলাকার মোহাম্মদ মুনীর চৌধুরী। একই ক্যাটাগরিতে প্রাতিষ্ঠানিক পর্যায়ে মনোনীত হয়েছে পরিবেশবিষয়ক সংগঠন ‘ওয়ার্ক ফর এ বেটার বাংলাদেশ (ডব্লিউবিবি) ট্রাস্ট।’
এ ছাড়া পরিবেশবিষয়ক গবেষণা ও প্রযুক্তি উদ্ভাবনে অবদানের জন্য ব্যক্তিপর্যায়ে পদকের জন্য মনোনীত হয়েছেন প্রফেসর ড. এম ফিরোজ আহমেদ। এ ক্যাটাগরিতে প্রাতিষ্ঠানিক পর্যায়ে মনোনীত হয়েছে বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউট (বারি)।
প্রত্যেক বিজয়ীকে জাতীয় পরিবেশ দিবসের অনুষ্ঠানে আনুষ্ঠানিকভাবে সম্মাননা দেওয়া হবে। এ সময় তাদের হাতে তুলে দেওয়া হবে ২২ ক্যারেট মানের দুই তোলা ওজনের স্বর্ণের বাজার মূল্য এবং ৫০ হাজার টাকার চেক, ক্রেস্ট ও সম্মাননাপত্র।
মন্তব্য করুন