দিনভর ছয় লাশ দেখতে ছুটে আসছে আশপাশের মানুষ। সকাল ১০টা পর্যন্ত পাঁচ লাশের খণ্ডবিখণ্ড টুকরো পড়ে ছিল রেললাইন ও তার আশপাশে। এ লাশ দেখতে এসে উপস্থিত অনেককেই বলতে শোনা যায়, আর লাশ চাই না আমরা। অপরাধের শহর হিসেবে পরিচিত নরসিংদীর রায়পুরা মেথিকান্দা রেলস্টেশনের অদূরে এবার রেললাইন থেকে অজ্ঞাত পাঁচজনের খণ্ডবিখণ্ড লাশ উদ্ধার করেছে পুলিশ। গতকাল সোমবার পৃথক দুটি ঘটনায় রায়পুরা রেললাইন থেকে অজ্ঞাত পাঁচ যুবকসহ ছয়জনের লাশ উদ্ধার করা হয়। যদিও ছয়জনের লাশ নিয়ে পুলিশের তিন বিভাগের সদস্যরা একেক রকম মন্তব্য করছেন। পুলিশের এমন অনুমাননির্ভর মন্তব্যের পর জনমনে বাড়ছে নানা উদ্বেগ ও উৎকণ্ঠা।
ট্রেনে কাটা পড়ে ছয়জনের মৃত্যু হয়েছে—নাকি তাদের মেরে ফেলেছে এ প্রশ্নই তাড়া করে বেড়াচ্ছে জেলাবাসীর মনে। সাধারণ মানুষ মনে করছে, এটি একটি পরিকল্পিত হত্যাকাণ্ড। তবে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কিছু সদস্যসহ স্থানীয়দের ধারণা, তাদের দূরে কোথাও হত্যা করে রেললাইনের ওপরে ফেলে রেখে যেতে পারে হত্যাকারীরা। পরে পরপর তিনটি ট্রেন যায় তাদের ওপর দিয়ে। এতে করে তাদের দেহ টুকরো টুকরো হয়ে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে পড়ে থাকে রেললাইন ও এর আশপাশে। গতকাল রাত সাড়ে ৮টায় এ রিপোর্ট লেখা পর্যন্ত নিহতদের নাম-পচিরয় জানাতে পারেনি পুলিশ।
এলাকাবাসী জানায়, সকাল সাড়ে ৬টার দিকে উপজেলার পলাশতলী ইউনিয়নের আশরাফপুর এলাকায় পাঁচটি ছিন্নবিচ্ছিন্ন লাশ দেখতে পায় স্থানীয়রা। এরপর দুপুরে উপজেলার শ্রীরামপুরে রেললাইনের ওপর আরও একজনের লাশ উদ্ধার করে পুলিশ।
রেলওয়ে পুলিশের উপপরিদর্শক (এসআই) ও নরসিংদী রেল পুলিশ ফাঁড়ির ইনচার্জ শহিদুল ইসলাম বলেন, ‘চট্টগ্রাম থেকে ছেড়ে আসা ঢাকাগামী চট্টগ্রাম মেইল ট্রেনের ছাদে ১২ থেকে ২০ বয়সী পাঁচজন অবস্থান করছিল। তারা ট্রেনের ছাদে হাঁটতে হাঁটতে একদম সামনে চলে আসে। কোনো কারণে সেখান থেকে তারা পড়ে যায়। পরে এ দুর্ঘটনা ঘটে।’ তিনি এ ঘটনা দেখেছেন বা কোনো প্রত্যক্ষদর্শীর কাছ থেকে শুনে বলছেন কি না, এমন প্রশ্নের জবাবে এসআই বলেন, এটি তার ধারণা।
এদিকে নরসিংদীর অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (রায়পুরা সার্কেল) আফসান আলম বলেন, তদন্ত ছাড়া ধারণার ওপর নির্ভর করে কিছু বলা ঠিক হবে না। খবর পেয়েই আমরা ঘটনাস্থলে এসে রেললাইনের পাশে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা পাঁচজনের মরদেহ দেখতে পাই। পরে স্থানীয়দের সঙ্গে কথা বলি। তবে কেউ তাদের নাম-পরিচয় জানাতে পারেনি। পুলিশের এই কর্মকর্তা বলেন, লাশ উদ্ধারের আগে ঢাকামুখী তিনটি ট্রেন চলাচল করেছে। এরই মধ্যে আমরা পিবিআইকে খবর দিয়েছি। আশা করি দ্রুত তারা এসে নিহতদের নাম-পরিচয় শনাক্ত করবে।
পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন (পিবিআই) নরসিংদীর পুলিশ পরিদর্শক রেজাউল করিম জানান, লাশগুলোর ফিঙ্গারপ্রিন্ট নেওয়া হয়েছে। তবে তাদের কারও জাতীয় পরিচয়পত্র না থাকায় ফিঙ্গারপ্রিন্ট ম্যাচ করছে না। সুতরাং পরিচয় পেতে আরও সময় লাগতে পারে। ঠিক কীভাবে মারা গেছে এ বিষয়ে কিছু জানা গেছে কি না—জানতে চাইলে পুলিশের এই কর্মকর্তা বলেন, ‘ট্রেনে কাটা পড়ে মারা গেছে বলে মনে হচ্ছে না।’
নরসিংদী জেলা পুলিশের এক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা কালবেলাকে বলেন, ধারণা করা হচ্ছে এটি পরিকল্পিত হত্যাকাণ্ড। হত্যাকারীরা অন্য কোথাও তাদের খুন করেছে। পরে রেললাইনের ওপর ফেলে রেখে রেলে কাটা পড়া বলে চালিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করছে।
নরসিংদীর জেলা প্রশাসক ড. বদিউল আলম বলেন, যাদের লাশ পাওয়া গেছে তারা টোকাই শ্রেণির। ট্রেনের চালকের বরাদ দিয়ে তিনি বলেন, ভৈরবের পরে কোনো এক যাত্রী রেলের চেইন ধরে টানে। পরে ট্রেনটি প্রায় ২৩ মিনিট সেখানে থেমে থাকে। এ সময় জিআরপি পুলিশ ট্রেনের ছাদে তিনজন টোকাই শ্রেণির ছেলেকে দেখতে পায়। ধারণা করা হচ্ছে, মারামারি করে অথবা কোনো কারণে তারা ট্রেন থেকে পড়ে গিয়ে এ দুর্ঘটনার শিকার হয়েছে। তবে পুরো বিষয়টি তদন্ত না করে নিশ্চিত হয়ে কিছু বলা যাচ্ছে না।
এদিকে রোববার সকাল ১১টায় শিবপুর সদর রোড পুলিশের কাছে সহায়তা না পেয়ে আসামিকে কুপিয়ে খুন করে বাদী ও তার স্বজনরা। নিহত মারুফ মিয়া একটি মারামারি মামলার ২ নম্বর পলাতক আসামি ছিল। মামলার পর থেকে পুলিশের ভয়ে পালিয়ে বেড়াচ্ছিল সে। শনিবার রাতে সদর রোড এলাকায় ধিরা ঘোষের বাড়ির দোতলায় অবস্থান নেয়। বাদীপক্ষের লোকজন খবর পেয়ে রোববার সকালে বাড়িটি ঘিরে রেখে পুলিশকে খবর দেয়। খবর পেয়ে যথারীতি ঘটনাস্থলে পুলিশও আসে; বাসা তল্লাশি করে। পরে পুলিশ নিচে এসে বাদীকে বলে এখানে আসামি নেই। তখন বাদীপক্ষের ১৫ থেকে ২০ যুবক এখানে উপস্থিত ছিল। পুলিশ তাদের তাড়িয়ে না দিয়ে দ্রুত ঘটনাস্থল ত্যাগ করে। এরপর দুই থেকে তিন মিনিটের মধ্যেই ফ্ল্যাট বাসার দরজা ভেঙে ভেতরে ঢুকে মারুফকে দেখতে পেয়ে দেশীয় অস্ত্র দিয়ে এলোপাতাড়ি কুপিয়ে রক্তাক্ত জখম করে পালিয়ে যায়। পরে নরসিংদী জেলা হাসপাতালে নিয়ে গেলে চিকিৎসক মারুফকে মৃত ঘোষণা করেন। স্থানীয়দের ধারণা, পুলিশ যথাযথ ভূমিকা পালন করলে হয়তো এ হত্যাকাণ্ডটিও এড়ানো যেত।
এ বিষয়ে শিবপুর মডেল থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মো. ফরিদ উদ্দিন বলেন, বিষয়টি জানার পর আমরা তদন্ত করছি। পুলিশের কোনো সদস্যের অবহেলার প্রমাণ পেলে তার বিরুদ্ধে বিভাগীয় ব্যবস্থাও নেওয়া হবে।