গত ৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার গণঅভ্যুত্থানের পর চাঁদাবাজি, দখলদারিত্ব ও নৈরাজ্যকর পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে কঠোর অবস্থান নেয় বিএনপি; কিন্তু খোদ বিএনপিতেই শুরু হয় ‘ব্লেম গেম’। যেন প্রতিপক্ষকে ঘায়েলের প্রতিযোগিতা। দলের একটি পক্ষ ভুয়া ও অন্যের নামে চিঠি লিখে তার প্রতিপক্ষকে ঘায়েলের চেষ্টা করছে বলে অভিযোগ মিলেছে। কেউ অন্যের নাম ব্যবহার করে লিখিতভাবে প্রতিপক্ষকে ফাঁসাতে অভিযোগ দিচ্ছেন। কেউ কেন্দ্রীয় নেতাদের কাছে মোবাইল ফোনে অভিযোগ দিচ্ছেন।
সংশ্লিষ্টরা জানান, গণঅভ্যুত্থানের পর বিএনপি ও এর অঙ্গসংগঠনের বেশকিছু নেতাকর্মীর বিরুদ্ধে ব্যাংক ও জমি দখল, দোকান ও মার্কেটে চাঁদাবাজি, প্রতিপক্ষের ওপর হামলাসহ নানা ধরনের অভিযোগ উঠেছে। এক্ষেত্রে দলেরই একটি গ্রুপ আরেকটি গ্রুপকে ঠেকাতে বিভিন্ন অভিযোগও দাঁড় করাচ্ছে। সার্বিকভাবে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ করতে দলের সিনিয়র নেতারা চিন্তিত এবং বিব্রত। বিশেষ করে ব্যাংক দখল করতে যাওয়ার বিষয়টিতে দলটির শীর্ষ নেতারা ক্ষুব্ধ।
এদিকে, বৈষম্যবিরোধী ছাত্র-জনতার আন্দোলন ঘিরে বিএনপি ও এর অঙ্গসংগঠনের অসংখ্য নেতাকর্মীর বাসাবাড়ি এবং ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে হামলা, ভাঙচুর ও লুটের ঘটনা ঘটেছে। তাদের মধ্যে চট্টগ্রামে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী, মহানগর বিএনপির সাবেক সভাপতি ডা. শাহাদাত এবং বতর্মান সভাপতি এরশাদ উল্লাহর বাড়িতে হামলা ও ভাঙচুর শেষে আগুন দেয় দুর্বৃত্তরা। ঝিনাইদহ শহরের কলাগাবানে জেলা বিএনপির সভাপতি এমএ মজিদের বাড়িতে স্থানীয় আওয়ামী লীগ, ছাত্রলীগ, যুবলীগের নেতাকর্মীরা হামলা ও
ভাঙচুর চালিয়ে আগুন ধরিয়ে দিলে কোটি টাকার ক্ষতি হয়। নেত্রকোনা জেলা বিএনপির আহ্বায়ক অধ্যাপক ডা. আনোয়ারুল হক জানান, তার জেলার বারহাট্টা উপজেলায় কয়েকটি দোকানে ভাঙচুর করা হয়েছে। আরও বেশ কয়েকটি জেলা-উপজেলায় এমন ভাঙচুরের ঘটনা ঘটেছে।
অন্যদিকে বিএনপির যেসব নেতাকর্মী ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন, তাদের খোঁজ-খবর নিচ্ছেন বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান। তিনি কথা বলে উদ্ভূত পরিস্থিতিতে দলের নেতাকর্মীদের শান্ত থাকার পরামর্শ এবং সহনশীলতার সঙ্গে পরিস্থিতি মোকাবিলার নির্দেশনা দিচ্ছেন। কোনোমতেই নৈরাজ্য, চাঁদাবাজি ও দখলদারিত্ব বরদাশত করা হবে না মর্মে হুঁশিয়ারি দিয়েছেন। এর পরও যারা দলীয় শৃঙ্খলা ভঙ্গ করবেন, তাদের বিরুদ্ধে সাংগঠনিক ব্যবস্থা নেওয়া হবে। এরই মধ্যে দলীয় নির্দেশনা লঙ্ঘন করায় সারা দেশে শতাধিক নেতাকর্মীকে দল থেকে বহিষ্কার করা হয়েছে বলে জানা গেছে।
বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেছেন, কিছু সংখ্যক ব্যক্তি ছাত্র-জনতার বিজয়কে নস্যাৎ করতে ষড়যন্ত্র ও চক্রান্ত করছে। তারা বিভিন্ন অঞ্চলে গোলযোগ সৃষ্টি করে আমাদের দলের নেতাকর্মীদের ওপরে অন্যায়ভাবে হামলা এবং দায় চাপানোর চেষ্টা করছে। আমরা পরিষ্কার ভাষায় বলতে চাই, আমাদের দলের কোনো নেতাকর্মী কোনোভাবে গোলযোগের সঙ্গে জড়িত নয়। আমরা সর্বাত্মকভাবে চেষ্টা করছি সেটাকে বন্ধ করার। এজন্য সবাইকে সজাগ থাকতে হবে।
ছাত্র-জনতার আন্দোলনে গত ৫ আগস্ট শেখ হাসিনা প্রধানমন্ত্রীর পদ ছেড়ে ভারতে পালিয়ে আশ্রয় নেন। শেখ হাসিনা ও তার সরকারের নির্মম পতনের পর দেশজুড়ে জ্বালাও-পোড়াও, ভাঙচুরসহ বিভীষিকাময় পরিস্থিতি তৈরি হয়। বিভিন্ন স্থানে ডাকাতিসহ রাজনৈতিক দ্বন্দ্ব-সংঘাত মাথা চড়া দিয়ে ওঠে। হিন্দু সম্প্রদায়ের মন্দির ও উপাসনালয়ে ভাঙচুর, অগ্নিসংযোগ, লুটপাটের ঘটনাও ঘটছে। তবে এসব নৈরাজ্য প্রতিরোধে জনমনে স্বস্তি ফেরাতে মাঠে নানামুখী উদ্যোগ নেয় বিএনপি ও এর অঙ্গসংগঠনগুলো। সারা দেশে থানা-উপজেলা, ওয়ার্ড এবং ইউনিয়ন পর্যায়ে নৈরাজ্য মোকাবিলার পাশাপাশি মসজিদ-মন্দিরসহ বিভিন্ন উপাসনালয় রাত-দিন পাহারা দেন নেতাকর্মীরা। কোনো অপকর্মে দলীয় নেতাকর্মীদের সংশ্লিষ্টতা পেলে বহিষ্কার করা হচ্ছে। এরই মধ্যে শৃঙ্খলা পরিপন্থি কর্মকাণ্ডে জড়িত থাকার অভিযোগের ভিত্তিতে অঙ্গসহযোগী সংগঠনের শতাধিক নেতাকর্মীকে বহিষ্কার করা হয়েছে। শোকজ করা হয়েছে বেশ কয়েকজনকে। কয়েকটি জেলা থেকে স্থানীয় নেতাকর্মীরা বিএনপির হাইকমান্ডের কাছে অভিযোগ দিয়েছেন। অবশ্য সাংগঠনিক জেলা শাখার শীর্ষ নেতারা কেন্দ্রের কঠোর বার্তা সব স্তরের নেতাকর্মীর কাছে পৌঁছে দিয়েছেন। দুষ্কৃতকারীদের আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর হাতে তুলে দেওয়ার অনুরোধ জানাচ্ছেন নেতাকর্মীরা।
বিএনপির যুগ্ম মহাসচিব শহীদ উদ্দীন চৌধুরী এ্যানি কালবেলাকে বলেন, হাজারও ছাত্রজনতার জীবন ও রক্তের বিনিময়ে দীর্ঘ ১৬ বছর পর স্বৈরাচার শেখ হাসিনা ও ফ্যাসিস্ট আওয়ামী লীগের পতন হয়েছে। এই বিজয় কোনোভাবেই হাতছাড়া করতে দেওয়া হবে না। কিন্তু অসাধু গোষ্ঠী ষড়যন্ত্র অব্যাহত রেখেছে। তারা বিএনপি বা এর অঙ্গসংগঠনের নাম ব্যবহার করে দখল ও চাঁদাবাজির মাধ্যমে আমাদের ইমেজ ক্ষুণ্ন করতে চায়। পরিষ্কারভাবে বলছি, এ বিষয়ে বিএনপি ও আমাদের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান অত্যন্ত কঠোর। তিনি নিজে সমাবেশে নৈরাজ্য প্রতিরোধ যে কোনো অন্যায়ের বিরুদ্ধে সতর্ক থাকার আহ্বান জানিয়েছেন।
এ্যানি বলেন, এখন অন্তর্বর্তীকালীন সরকার আছে। তারা একটি গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের ব্যবস্থা করে দেশে গণতন্ত্র ও ভোটাধিকার পুনরুদ্ধার করবে; কিন্তু এই সময়ের মধ্যে কেউ কোনো অন্যায় কাজে যুক্ত হলে তার বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া হবে। তিনি যে দলের যেই হোন না কেনো।
ঝিনাইদহ জেলা বিএনপির সভাপতি এমএ মজিদ জানান, গত ৪ আগস্ট বিকেলে ঝিনাইদহ শহরের কলাবাগানে তার বাড়ি ও এইচএসএস সড়কে জেলা বিএনপি কার্যালয় আগুন দিয়ে জ্বালিয়ে দেয় আওয়ামী লীগ নেতাকর্মীরা। তার বাড়িতে থাকা একটি প্রাইভেটকার ও তিনটি মোটরসাইকেল আগুনে ছাই হয়ে গেছে। বিভিন্ন আসবাব পুড়ে গেছে। অসংখ্য গাছ কেটে ফেলা হয়েছে। সব মিলিয়ে তার বাড়িতে এক কোটি টাকার মতো ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে। তা ছাড়া দলীয় কার্যালয়ে বিভিন্ন কাগজপত্র এবং চেয়ার-টেবিল পুড়ে ছাই হয়ে গেছে। এসব বিষয় বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান অবগত আছেন। তিনি কথা বলে শান্ত থাকা এবং ধৈর্যের সঙ্গে পরিস্থিতি মোকাবিলার নির্দেশ দিয়েছেন।
এম এ মজিদ বলেন, তিনি নিজে ক্ষতিগ্রস্ত হলেও কেন্দ্রে তার ও তার কয়েকজন অনুসারীর নামে চাঁদাবাজি ও জমি দখলের লিখিত অভিযোগ করা হয়েছে। তবে অভিযোগকারী হিসেবে যার নাম আবেদনে রয়েছে তিনি নিজেই অভিযোগের বিষয়ে জানেন না। পরে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, জেলা বিএনপির সাংগঠনিক সম্পাদক মৌ চৌধুরী অন্যের নাম ব্যবহার করে ভুয়া ও মিথ্যা অভিযোগ দিয়েছেন। এ বিষয়ে বিএনপির কেন্দ্রে ব্যাখ্যা দেওয়া হয়েছে বলে জানান এম এ মজিদ। অভিযোগের বিষয়ে মৌ চৌধুরী বলেন, ‘আমি আপনাকে চিনি না। বিষয়টি বুঝতে হবে। নম্বর কে দিয়েছে?’
বিএনপির কেন্দ্রীয় সহদপ্তর সম্পাদক তাইফুল ইসলাম টিপু কালবেলাকে বলেন, দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে বিচ্ছিন্নভাবে অভিযোগ আসছে। যার বেশিরভাগই সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে মোবাইলে কথা বলে সমাধান করা হচ্ছে। তিনি বলেন, দখল, চাঁদাবাজি ও নৈরাজ্যের বিরুদ্ধে দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের কঠোর নির্দেশনা রয়েছে। কেউ শৃঙ্খলা ভঙ্গ করলে তার বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে এবং এটি অব্যাহত থাকবে।