সম্প্রতি বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের (ইউজিসি) চেয়ারম্যান পদে নিয়োগ পেয়েছেন সরকারি কর্ম কমিশনের (পিএসসি) সাবেক চেয়ারম্যান এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য অধ্যাপক ড. এস এম এ ফায়েজ। দেশের উচ্চ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের বর্তমান পরিস্থিতি, ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা, ইউজিসির নানা সংকটসহ বিভিন্ন বিষয়ে কালবেলার সঙ্গে কথা বলেছেন এই শিক্ষাবিদ। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন আব্দুল্লাহ আল জোবায়ের
কালবেলা: পাবলিক-প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয় ও স্কুল-কলেজের শিক্ষার্থী এবং সর্বস্তরের জনতার যে গণঅভ্যুত্থান, সেটি কীভাবে দেখছেন?
এস এম এ ফায়েজ: আমি তো বলব, এটার (গণঅভ্যুত্থান) যে ফল, সেটি হলো একটি নতুন বাংলাদেশ। অনেক ত্যাগের বিনিময়ে, বুদ্ধিমত্তার সঙ্গে যারা এটি করেছে, মনে হচ্ছে তারা ভাইব্রেন্ট নেশন। ইটস অ্যা নিউ জেনারেশন। তারা যেটি করল, তা শুধু বাংলাদেশিদের নয়, সারা বিশ্বকে অবাক করেছে। তারা জীবনের চেয়ে বেশি মূল্যবান মনে করেছে তাদের অধিকারকে, দেশের স্বার্থকে। উই স্যালুট। এ ছাড়া প্রাইভেট ইউনিভার্সিটি ইজ অ্যা নিউ ডাইমেনশন। এসব বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের পিএসসির বিষয়ে সিরিয়াস আমার কাছে কখনো মনে হয়নি। তারা এই সময়টায় ন্যায়-অন্যায়ের মধ্যে ন্যায়টাকে বেছে নিয়েছে। আমার ভাইকে হত্যা করা হচ্ছে, আমি কীভাবে বসে থাকব—এই চিন্তা থেকে তারা এগিয়ে এসেছে। সে সময় কে প্রাইভেট, কে পাবলিক—সেই ভেদাভেদ ছিল না। এত কম সময়ের মধ্যে ছাত্রদের পাশাপাশি সাধারণ মানুষও জীবন দিয়েছে, আমি জানি না পৃথিবীর আর কোথাও এমন উদাহরণ আছে কি না। এটা যে আমরা আমাদের জীবদ্দশায় দেখে যেতে পারলাম, এটাই ‘সামথিং ফর আস’। কিন্তু যারা প্রাণ দিলেন, তাদের পরিবারের প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করে শেষ করতে পারব না। তাদের ত্যাগ এই জাতি সারা জীবন মনে রাখবে, বিশ্ব মনে রাখবে।
কালবেলা: বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর অনেক শিক্ষকই সরাসরি ছাত্র-জনতার আন্দোলনের বিরোধিতা করেছেন। শিক্ষক সমিতিগুলো বিজ্ঞপ্তি এবং বিভিন্ন কর্মসূচির মাধ্যমে বিরোধিতা করেছে। এটিকে কীভাবে দেখছেন?
এস এম এ ফায়েজ: ছাত্ররা দলমতের ঊর্ধ্বে গিয়ে আন্দোলনে ঝাঁপিয়ে পড়েছে। শিক্ষকদের সেটা অনুসরণ করা দরকার ছিল। সন্তানরা এত ঝুঁকি নিয়ে রাস্তায়, আমাদের তো শিক্ষক হিসেবে তাদের পাশে থাকার দরকার ছিল। শিক্ষকদের একটি রাজনৈতিক আদর্শের প্রতি সম্মান থাকতে পারে, কিন্তু তাদের কর্মকাণ্ডের মধ্য দিয়ে এর বহিঃপ্রকাশ ঘটা কোনোভাবেই ঠিক নয়।
কালবেলা: সরকার পতনের পর অনেক বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যসহ প্রশাসন সংশ্লিষ্টরা পদত্যাগ করেছেন। এসব বিশ্ববিদ্যালয়ে শৃঙ্খলা আনতে করণীয় কী?
এস এম এ ফায়েজ: আন্দোলনের পরে খুব বেশি সময় পার হয়নি। আমার বিশ্বাস, সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়গুলো খুব গুরুত্ব সহকারে বিষয়টি দেখছে। যত তাড়াতাড়ি সম্ভব তারা ব্যবস্থা গ্রহণ করবে। কয়েকটি বিশ্ববিদ্যালয় এরই মধ্যে শিক্ষা কার্যক্রম শুরুর জন্য পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে। আরেকটু সময় দিলে এটি ঠিক হয়ে যাবে। আর ছাত্ররাও জানে, যে ক্ষতি হয়েছে, তা কীভাবে কত কম সময়ে পুষিয়ে ওঠা যায়। এ ছাড়া শিক্ষকদের পক্ষ থেকেও সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দেওয়া দরকার।
কালবেলা: কোটা সংস্কার আন্দোলন যখন তুঙ্গে, তখন ইউজিসি পাবলিক ও প্রাইভেট ইউনিভার্সিটি বন্ধের ঘোষণা দিল। এমনকি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের হলও। ইউজিসি এমন নির্দেশনা দেওয়ার এখতিয়ার রাখে কি না?
এস এম এ ফায়েজ: সে সময় এমন সিদ্ধান্তে আমরা শিক্ষার্থীদের আরও বেশি ঝুঁকির মধ্যে ঠেলে দিলাম। ইউজিসির এটা করা মোটেই সমীচীন হয়নি। বিশ্ববিদ্যালয়গুলো দায়িত্ব কখন বন্ধ করবে বা খুলবে। অবশ্য তাদের আরও বিচক্ষণতার পরিচয় দেওয়া উচিত ছিল। এতে অবশ্য উল্টো ফল হয়েছে। ছাত্ররা দমে যায়নি, মনে হয়েছে দ্বিগুণ উৎসাহ নিয়ে এগিয়ে এসেছে।
কালবেলা: শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের অধীন হওয়ায় বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য, উপ-উপাচার্য ও কোষাধ্যক্ষ নিয়োগে ইউজিসির তেমন কোনো ভূমিকা থাকে না। তাই ইউজিসিকে রাষ্ট্রপতির কার্যালয়ে সংযুক্ত করা উচিত কি না, আপনার কী মনে হয়?
এস এম এ ফায়েজ: আমি মনে করি, সবসময় পরস্পরের প্রতি শ্রদ্ধাশীল থেকে কাজ করা উচিত। তবে কাজটা সহজ করার জন্য কিছু কিছু দায়িত্ব তো দৃঢ়ভাবেই একটি প্রতিষ্ঠানকে দিতে হবে। সেই জায়গা থেকে ইউজিসির যে দায়িত্ব, তা যথাযথভাবে পালন করতে পারছে না বা সুযোগ নেই, এমন যদি হয় সেটির অবশ্যই সমাধান হবে ইনশাআল্লাহ। ইটস অ্যা নিউ বাংলাদেশ। এখানে অনেক কিছুই নতুন দেখব আমরা।
কালবেলা: পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের যে পরিমাণ চাহিদা, সে অনুযায়ী সরকার অর্থ বরাদ্দ দেয় না। তাই ইউজিসির মাধ্যমে অর্থ বরাদ্দ দেওয়া গেলে চাহিদা অনুযায়ী বিশ্ববিদ্যালয়গুলো বরাদ্দ পাবে বলে মনে করেন অনেকেই। আপনি কী মনে করেন?
এস এম এ ফায়েজ: বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে আন্তর্জাতিক মানে নেওয়ার জন্য প্রচুর টাকার দরকার। তবে গবেষণা এখন খুবই ব্যয়বহুল। সরকারের জন্যও এত ফান্ড দেওয়া কঠিন। তবে আমার বিশ্বাস, বর্তমান সরকার এটি গুরুত্ব সহকারে দেখবে। যাতে গবেষণায় আমরা অনেক দূর এগিয়ে যেতে পারি।
কালবেলা: বাজেট সংকট কাটাতে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর করণীয় কী? ইউজিসি কী ভাবছে?
এস এম এ ফায়েজ: সরকারের এককভাবে কোনো কিছু করা সম্ভব নয়। এখানে সমাজের দায়বদ্ধতা রয়েছে। ইন্ডাস্ট্রি, অ্যালামনাইদের এগিয়ে আসতে হবে। তাদের যথেষ্ট সহযোগিতা দরকার।
কালবেলা: বিশ্ববিদ্যালয়ের দেশীয় ও আন্তর্জাতিক র্যাঙ্কিং কতটুকু জরুরি মনে করেন?
এস এম এ ফায়েজ: আমাদের মাথায় রাখতে হবে, আমরা আন্তর্জাতিক মানদণ্ড ধারণ করব। এ ছাড়া দেশীয় ক্ষেত্রে ইউজিসির একটি সিস্টেম আছে। কোয়ালিটি অ্যাসেসমেন্ট, এক্রিডিটেশন কাউন্সিল কাজ করছে। তবে আমরা আপ টু দ্য মার্ক কতটুকু করতে পারছি, তা নিশ্চিত নই। আমার মনে হয় না, খুব বেশি করতে পারছি।
কালবেলা: ইউজিসিসহ বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর সক্ষমতা বৃদ্ধির জন্য শিক্ষক ও কর্মকর্তাদের পদায়নের ক্ষেত্রে দক্ষতার মূল্যায়ন কীভাবে হবে?
এস এম এ ফায়েজ: প্রথমেই মেরিট দেখতে হবে। রাজনৈতিক বিবেচনা আসতে পারে। কিন্তু সেটি মেরিটের ওপরে স্থান পেতে পারে না। গ্রহণযোগ্য ব্যক্তিকেই নিয়োগ দেওয়া উচিত।
কালবেলা: গত সরকার জেলায় জেলায় একটা বিশ্ববিদ্যালয় নির্মাণের ঘোষণা দিয়েছিল এবং বেশকিছু জেলায় তা নির্মাণও হয়েছিল। তবে অনেক বিশ্ববিদ্যালয়ের মান নিয়ে প্রশ্ন রয়েছে। এ ছাড়া প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ের সংখ্যাও বেড়েছে। আসলেই এতগুলো বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রয়োজন আছে কি না?
এস এম এ ফায়েজ: আমি যদি প্রথমেই চিন্তা করি, এটিকে ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠান করব, তাহলে তো সেটি বিশ্ববিদ্যালয় হচ্ছে না। এক্ষেত্রে বিশ্ববিদ্যালয় সংশ্লিষ্টদের সামাজিক দায়বদ্ধতা লাগবে। এটি আমরা ইউজিসি থেকেও বলব। এখন দেশে যে পরিমাণ শিক্ষার্থী, তারা যদি উচ্চশিক্ষা গ্রহণ করতে চায়, তাদের জন্য তো বিশ্ববিদ্যালয় লাগবে। তবে মানসম্মত শিক্ষা যাতে নিশ্চিত হয়, সেটি ইউজিসিও দেখবে।
কালবেলা: বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে শিক্ষকের পাশাপাশি উপাচার্য, উপউপাচার্য, কোষাধ্যক্ষ নিয়োগের মানদণ্ড কী হওয়া উচিত?
এস এম এ ফায়েজ: ছাত্ররা কিন্তু অত্যন্ত মেধাবী। কিন্তু মেধাবী শিক্ষককে নিয়োগ দিচ্ছি কি না তা দেখতে হবে। কোনো কম্প্রোমাইজ করছি কি না, দেখতে হবে। নাম্বার ওয়ানকে পাশ কাটিয়ে নাম্বার টু যেন চাকরি না পেয়ে যায়। সবচেয়ে মেধাবীকে শিক্ষক হিসেবে নিয়োগ করতে হবে। অন্য বিবেচনাগুলো আসতেই পারবে না। এ ছাড়া, প্রশাসনে নিয়োগদানের ক্ষেত্রে একটি বিষয়—যিনি কিছু হতে চাচ্ছেন, পদের প্রতি শ্রদ্ধা ও সম্মান নয় বরং মোহ প্রদর্শন করছেন; তিনি তো উপাচার্য, উপউপাচার্য কিংবা কোষাধ্যক্ষ হওয়ার উপযুক্ত নন। যারা নিয়োগ দেবেন, তারা খুঁজে বের করবেন, কে সবচেয়ে বেশি উপযুক্ত। তার ভালো একাডেমিক ও প্রশাসনিক দক্ষতা থাকতে হবে। আর যিনি লবিং করবেন, তাকে প্রথমেই বাদ দিতে হবে। কারণ, তার পদের প্রতি সম্মানবোধ নয়, মোহ কাজ করছে।
কালবেলা: প্রযুক্তিনির্ভর বিশ্বের সঙ্গে তাল মেলাতে পাবলিক ও প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ের কোর্স-কারিকুলাম পরিবর্তনের কোনো চিন্তা আছে কি না?
এস এম এ ফায়েজ: আমি লক্ষ করেছি, আমাদের সিলেবাস আপ-টু-ডেট। এটা সবসময় পরিবর্তন হচ্ছে। এখানে কারও পিছিয়ে থাকার মানসিকতা নেই বলে বিশ্বাস করি। সিলেবাস আপ-টু-ডেট থাকা এবং বিশ্বমানের হওয়াটাই জরুরি। পাশাপাশি দেশীয় চাহিদাও ধারণ করতে হবে।
কালবেলা: দেশের উচ্চশিক্ষার বাস্তবিক কোনো প্ল্যান বা রোডম্যাপ প্রয়োজন কি না? সেক্ষেত্রে কোনো পরিকল্পনা আছে কি না?
এস এম এ ফায়েজ: প্ল্যান বা রোডম্যাপ তো একজনের মাথা থেকে আসবে না। টিমওয়ার্কের প্রয়োজন। ইউজিসিতে এখন একজন সদস্যও নেই। সদস্য যুক্ত হলে তাদের নিয়ে আমাদের জায়গা থেকে যেটুকু করার, সেটি করা হবে। রোডম্যাপের জন্য সময়ও লাগবে। তবে এক্ষেত্রে সময় নষ্ট না করার চিন্তা আমাদের। যেহেতু নতুন বাংলাদেশ, সেজন্য এক্সপেক্টেশনও অনেক বেশি। আমাদেরও সেটি ধারণ করে তাল মিলিয়ে চলতে হবে।
কালবেলা: বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে নিয়োগের ক্ষেত্রে উপাচার্যসহ প্রশাসন সংশ্লিষ্টদের স্বজনপ্রীতি, অনিয়মের অভিযোগ আমাদের ব্যথিত করে। নিয়োগের ক্ষেত্রে বিভিন্ন নীতিমালা বাস্তবায়ন হয় না। এ বিষয়ে পদক্ষেপ নেবেন কি না?
এস এম এ ফায়েজ: ভুল মানুষকে উপাচার্যসহ প্রশাসন সংশ্লিষ্ট পদগুলোতে বসানোর কারণেই এমনটি হয়েছে। সে জায়গায় মোহ বাদ দিয়ে সম্মানের বিষয়টি চিন্তা করলে অন্যরাও আমাকে অনুকরণ করবে। এভাবেই চলতে হবে।
কালবেলা: সময় দেওয়ার জন্য আপনাকে অনেক ধন্যবাদ।
এস এম এ ফায়েজ: আপনাকেও ধন্যবাদ, কালবেলাকেও ধন্যবাদ।