‘বঙ্গবন্ধুকে খুশি করতে গিয়ে আল্লাহকে নারাজ করব নাকি। মানুষকে সন্তুষ্ট করতে গিয়ে, আল্লাহকে অসন্তুষ্ট করা যাবে না।’ রাজশাহী সিটি ফটকে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ম্যুরাল স্থাপন নিয়ে এমনই কটূক্তি করেছিলেন কাটাখালীর সাবেক পৌর মেয়র মো. আব্বাস আলী। এ মন্তব্যের কারণে আওয়ামী লীগ থেকে বহিষ্কারের পাশাপাশি মেয়রের দায়িত্ব থেকেও তাকে স্থায়ীভাবে অপসারণ করা হয়। এবার সেই আব্বাসকে স্বপদে পুনর্বহালে তৎপরতা চালাচ্ছেন ক্ষমতাসীন দলটির এক সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য। ওই নেতার ইশারায় ইতোমধ্যেই ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের দুই মামলা থেকে অব্যাহতি পেয়েছেন আব্বাস। অথচ এ বিষয়ে কিছুই জানেন না এক মামলার বাদী!
জানা যায়, এই ‘বিতর্কিত’ ব্যক্তিকে পুনর্বহাল করতে ওই সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য বাগিয়ে নিয়েছেন মোটা অঙ্কের টাকা। এই লেনদেনের বিষয়ে অবগত আওয়ামী লীগ ও সহযোগী সংগঠনের একাধিক নেতা কালবেলাকে এ তথ্য নিশ্চিত করেছেন।
জাতীয় চার নেতার একজন শহীদ এএইচএম কামারুজ্জামানের পুত্র রাজশাহীর মেয়র এএইচএম খায়রুজ্জামান লিটনকে নিয়েও আব্বাসের ‘কুরুচি ও কটূক্তিমূলক’ বক্তব্য সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ভাইরাল হয়েছিল।
আব্বাসকে মেয়র পদে পুনর্বহালের চেষ্টার বিষয়টি বুঝতে পেরে পৌরসভার ১২ কাউন্সিলর ২০ জুলাই স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় মন্ত্রণালয়ের সচিব (স্থানীয় সরকার বিভাগ) বরাবর একটি আবেদন পাঠিয়েছেন। ওই আবেদনে বলা হয়, আব্বাস আলীকে স্বপদে পুনর্বহালের প্রক্রিয়া চলছে। অথচ গত বছরের ২১ জুন পৌরসভা কক্ষে অনুষ্ঠিত সভায় ১২ কাউন্সিলরের মধ্যে ১১ জনের অনাস্থা ও যথাযথ আইনি প্রক্রিয়া অনুসরণপূর্বক আব্বাসকে মেয়র পদ থেকে স্থায়ীভাবে অপসারণ করা হয়। তাকে পুনর্বহাল করা হলে সব কাউন্সিলরের নিজ পদ থেকে স্বেচ্ছায় পদত্যাগ ও যথাযথ আইনের আশ্রয় গ্রহণের কথাও ওই আবেদনে উল্লেখ করা হয়।
সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা যায়, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এবং রাসিক মেয়র লিটনকে নিয়ে কটূক্তির অভিযোগে ২০২২ সালের ১৭ জানুয়ারি রাজশাহীর বোয়ালিয়া মডেল থানায় একটি এবং ২৪ ডিসেম্বর কাটাখালী থানায় ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে অন্য একটি মামলা হয়। এ ছাড়া চাঁদা দাবি, মারধর ও ভয়ভীতি প্রদর্শনের অভিযোগে ২০২১ সালের ২৩ ডিসেম্বর মো. আব্দুল কুদ্দুস নামে এক ব্যক্তি তার বিরুদ্ধে আরও একটি মামলা করেন।
জানা যায়, ওই নেতার হস্তক্ষেপে আব্বাসের বিরুদ্ধে রাজশাহীর সাইবার ট্রাইব্যুনাল আদালতে বিচারাধীন ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের মামলাটি বাদীর সঙ্গে আপস-মীমাংসার মাধ্যমে নিষ্পত্তি করা হয়েছে। এ বিষয়ে জানতে মামলার বাদী মহানগর স্বেচ্ছাসেবক লীগ সভাপতি ও সিটি করপোরেশনের ১৩ নম্বর ওয়ার্ড কাউন্সিলর আব্দুল মোমিনকে একাধিকবার কল করা হলেও তিনি ফোন ধরেননি। আর মেয়র লিটনকে নিয়ে কটূক্তি করায় একই আদালতে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে আরেকটি মামলা বিচারধীন ছিল। সেই মামলার বাদী কাটাখালী পৌর যুবলীগের আহ্বায়ক জনি ইসলাম। ওই মামলাটিও নিষ্পত্তি করতে আদালতের পাবলিক প্রসিকিউটর (পিপি) ইসমত আরা বেগম বাদীকে বিভিন্ন সময় নানাভাবে চাপ প্রয়োগ করেছেন।
জনি কালবেলাকে বলেন, ‘মামলা তুলে নিতে ইসমত আরা এর আগে রাজশাহী কোর্ট চত্বরে আমাকে হুমকি দিয়েছেন। তিনি বলেছেন, আরেকটি মামলার বাদী মোমিন মামলা তুলতে পারলে আপনি কেন তুলবেন না? তখন আমি বলেছি, লিটন ভাইকে নিয়ে কটূক্তি করার বিষয়টি আমার প্রচণ্ড খারাপ লেগেছে। এজন্য স্বপ্রণোদিত হয়ে মামলাটি করেছি। আমি তো কারও প্ররোচণায় বাদী হইনি।’ এ নিয়ে আব্বাসের আইনজীবী পারভেজ তৌফিক জাহেদীর সঙ্গেও জনির বাগবিতণ্ডা হয়েছে বলেও জানান তিনি। এমনকি ওই মামলা নিষ্পত্তির বিষয়টিও জানেন না জনি। তিনি বলেন, ‘আমি আদালতে যে বিষয়গুলো বলেছি, তাতে কোনোভাবেই আব্বাস খালাস পাওয়ার কথা নয়। আমি বাদী অথচ আমি নিজেই জানি না, আব্বাস আমার দায়ের করা মামলায় খালাস পেয়েছেন!’
আওয়ামী লীগ ও সহযোগী সংগঠনের একাধিক নেতা কালবেলাকে বলেন, কিছুদিন আগে আব্বাস কাপাশিয়া এলাকায় তার নিজের একটি জমি বিক্রি করেছেন। জমি বিক্রির টাকা দিয়ে ফের মেয়রের চেয়ারে বসতে দেনদরবার করছেন। এর আগে আব্বাস কোর্ট থেকে জামিন পাওয়ার পূর্বমুহূর্তে প্রায় অর্ধকোটি টাকা দলের প্রভাবশালী মহলকে দিয়েছেন।
২০২১ সালের ২২ নভেম্বর রাতে ফেসবুকে ভাইরাল হয় মেয়র আব্বাসের অডিও ক্লিপ। এতে তাকে বলতে শোনা যায়, ‘ওই গেটটি দ্রুত নির্মাণ হবে। তবে আমরা যে ফার্মকে কাজটি দিয়েছি, তারা গেটের ওপরে বঙ্গবন্ধুর যে ম্যুরাল বসানোর ডিজাইন দিয়েছে, সেটি ইসলামী দৃষ্টিতে সঠিক নয়। তাই সেটি বাদ দিতে বলেছি।’ তিনি বলেছিলেন, ‘যেভাবে বুঝেছি তাতে আমার মুনে (মনে) হইছে, ম্যুরালটা হইলে আমার ভুল হইয়া যাবে। এজন্য চেঞ্জ করছি। এই খবরটাও যদি যায় তো আবার রাজনীতি শুরু হয়ে যাবে। ওই বঙ্গবন্ধুর ম্যুরাল দিতে চাইয়া দিচ্ছে না! বঙ্গবন্ধুকে খুশি করতে যাইয়া আল্লাহকে নারাজ করব নাকি?’ আব্বাসের অডিও ফাঁসের পরপরই স্থানীয় আওয়ামী লীগের একটি অংশ ফুঁসে ওঠে। তাকে দলীয় ও মেয়রের পদ থেকে অপসারণের দাবিতে ওই সময় শুরু হয় নানা কর্মসূচি। পরপর তার বিরুদ্ধে দায়ের হয় বেশ কয়েকটি মামলা। এই ঘটনায় ২০২১ সালের ২৫ নভেম্বর আব্বাস আলীকে পৌর আওয়ামী লীগের আহ্বায়ক পদ এবং ২৬ নভেম্বর জেলা আওয়ামী লীগের সদস্য পদ থেকে অব্যাহতি দেওয়া হয়। এরপর ওই বছরের ৯ ডিসেম্বর স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় মন্ত্রণালয়ের পৌর শাখা-২-এর উপসচিব স্বাক্ষরিত এক প্রজ্ঞাপনে আব্বাস আলীকে মেয়র পদ থেকে সাময়িক বরখাস্ত করা হয়। এরপর ওই বছরের ১ ডিসেম্বর রাজধানীর কাকরাইলের ইশা খাঁ হোটেল থেকে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে দায়ের করা মামলায় র্যাব সদস্যরা আব্বাস আলীকে গ্রেপ্তার করে রাজশাহীতে নিয়ে আসেন। তারপর থেকে তিনি রাজশাহী কেন্দ্রীয় কারাগারে বন্দি ছিলেন। এক বছর কারাভোগের পর ২০২২ সালের ২৯ নভেম্বর জামিনে মুক্তি পান।
জানতে চাইলে রাজশাহীর সাইবার ট্রাইব্যুনাল আদালতের পিপি অ্যাডভোকেট ইসমত আরা বেগম বলেন, ‘আব্বাসের বিরুদ্ধে সাইবার ট্রাইব্যুনাল আদালতে দুটি মামলা বিচারাধীন ছিল। পরে সাক্ষী-প্রমাণ সব কিছু শেষ হওয়ার পর মামলাটি শেষ হয়ে গেছে।’ এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘জনি নিজেও সাক্ষ্য দিয়ে গেছেন। তিনি যেভাবে সাক্ষ্য দিতে চেয়েছেন, সেভাবেই নেওয়া হয়েছে।’
রাজশাহী-৩ (পবা-মোহনপুর) আসনের সংসদ সদস্য মো. আয়েন উদ্দিন বলেন, ‘জাতির পিতাকে নিয়ে কটূক্তিকারী আব্বাস কোনোভাবেই পার পেতে পারে না। বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে যে কটূক্তি করতে পারে, তাকে যদি কেউ আবার স্বপদে পুনর্বহাল করতে জোর তদবির চালায়, তাহলে কিছু বলার নেই। এটি খুবই দুঃখ ও হতাশাজনক।’
এ ব্যাপারে জানতে আব্বাসকে ফোনে কল করা হলে তিনি বিস্তারিত বলতে অপারগতা প্রকাশ করেন। তিনি বলেন, ‘মেয়র পদ ফিরে পেতে চেষ্টা অব্যাহত আছে, দেখা যাক কী হয়।’
মেয়র আব্বাসকে স্বপদে পুনর্বহালের চেষ্টাকারী আওয়ামী লীগের সেই সভাপতিমণ্ডলীর সদস্যকে একাধিকবার ফোন করা হলেও তিনি ফোন রিসিভ না করায় এ ব্যাপারে তার বক্তব্য পাওয়া যায়নি।
মন্তব্য করুন