পুঁজিবাজারে বিনিয়োগকারীরা বিনিয়োগ করে থাকেন মুনাফার আশায়। ভালো মৌলভিত্তির কোম্পানিগুলোতে দীর্ঘমেয়াদে বিনিয়োগে ভালো রিটার্ন পেয়ে থাকেন তারা। বিশ্বের বিভিন্ন দেশের পুঁজিবাজারের এটাই স্বাভাবিক চিত্র। কিন্তু বাংলাদেশের পুঁজিবাজারে দেখা যায় ঠিক এর উল্টো চিত্র। দেশের পুঁজিবাজারে নামসর্বস্ব, উৎপাদনে না থাকা এমনকি বন্ধ কোম্পানির শেয়ারের প্রতি বিনিয়োগকারীদের আগ্রহ থাকে বেশ। বিনিয়োগকারীদের পেছনে মূলত কারসাজিকারকরা তাদের কারসাজির মাধ্যমে কৃত্রিমভাবে বন্ধ কোম্পানির শেয়ারের দাম বাড়িয়ে বিনিয়োগকারীদের ফাঁদে ফেলে হাতিয়ে নেন কোটি কোটি টাকা। এমনই একটি কোম্পানি হচ্ছে খুলনা প্রিন্টিং অ্যান্ড প্যাকেজিং লিমিটেড (কেপিপিএল)। যে কোম্পানিটি পরিদর্শনে দেশের প্রধান পুঁজিবাজার ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জ (ডিএসই) বন্ধ পেয়েছে, সেই কেপিপিএলের শেয়ারের দাম বাড়ছে পাগলা ঘোড়ার মতো। মাত্র এক মাসের ব্যবধানে ১১ টাকার শেয়ার ২০০ শতাংশ বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৩৩ টাকায়। এ বিষয়টিকে কারসাজি ও অস্বাভাবিক বলছেন বাজার সংশ্লিষ্টরা।
কোম্পানিটির শেয়ারের দাম ও লেনদেন অস্বাভাবিক হারে বাড়ার কারণ তদন্তের উদ্যোগ নিয়েছে পুঁজিবাজারের নিয়ন্ত্রক সংস্থা বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন (বিএসইসি)। বিষয়টি খতিয়ে দেখতে গত ৫ ফেব্রুয়ারি ডিএসইকে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। এ বিষয়ে নির্দেশ দিয়ে ডিএসইর চিফ রেগুলেটরি অফিসার বরাবর চিঠি পাঠিয়েছে বিএসইসি। চিঠিতে ডিএসইকে ৩০ কার্যদিবসের মধ্যে তদন্ত প্রতিবেদন জমা দিতে বলা হয়েছে। তদন্তের নির্দেশ দেওয়ার পর থেকে কোম্পানিটির শেয়ারের দাম কমতে শুরু করেছে। গতকাল সর্বশেষ শেয়ারটি লেনদেন হয়েছে ২৯ টাকা ৬০ পয়সায়।
এ বিষয়ে জানার জন্য ডিএসইতে দেওয়া কোম্পানির প্রোফাইলে তাদের কোনো যোগাযোগের নম্বর পাওয়া যায়নি। এমনকি কোম্পানিটিতে সচিব হিসেবে কে কর্মরত আছেন বা ছিলেন, তার কোনো তথ্যও দেওয়া নেই। ফলে কোম্পানি কর্তৃপক্ষের সঙ্গে এ ব্যাপারে যোগাযোগ করা সম্ভব হয়নি। যদিও নিয়ম অনুযায়ী কোম্পানি সচিবের বিস্তারিত তথ্য ও যোগাযোগের নম্বর থাকা বাধ্যতামূলক, তবুও কোম্পানিটি সেই নিয়মে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে চলেছে। তবে এস এম আমজাদ হোসেন নামে এক ব্যক্তি এ কোম্পানির চেয়ারম্যান বলে জানা গেছে। তার সঙ্গেও যোগাযোগ করা সম্ভব হয়নি।
এ ব্যাপারে পুঁজিবাজার বিশ্লেষক অধ্যাপক আবু আহমেদ কালবেলাকে বলেন, ‘বাংলাদেশের পুঁজিবাজারের নিয়মিত চিত্রই এটি। আমরা প্রায়ই দেখি বিভিন্ন কোম্পানির শেয়ারদর পাগলা ঘোড়ার মতো বাড়ে। এসবের পেছনে কাজ করে একটি কারসাজি চক্র। কয়েক মাস নামসর্বস্ব বন্ধ কোম্পানির শেয়ার নিয়ে খেলাধুলা করে তার দাম কয়েক গুণ বাড়িয়ে তাতে বিনিয়োগকারীদের আকর্ষণ করেন। যখনই বিনিয়োগকারীরা ফাঁদে পা দিয়ে কোম্পানিটির শেয়ার বেশি দাম দিয়ে কেনেন, তখনই কারসাজিকারকরা সেসব শেয়ার বিনিয়োগকারীদের হাতে ধরিয়ে দিয়ে বেরিয়ে যান। এটি একটি পরিকল্পিত ফাঁদ। দুঃখের বিষয়, আমাদের দেশের বিনিয়োগকারীরা জেনে বুঝেই এসব শেয়ারে বিনিয়োগ করে ধরা খান। এই স্বভাব থেকে আমাদের বেরিয়ে আসতে হবে।’
তথ্য অনুযায়ী, দেশের প্রধান পুঁজিবাজার ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের (ডিএসই) একটি প্রতিনিধিদল গত ২৭ জানুয়ারি সরেজমিন কোম্পানিটির খুলনার বাগেরহাটে অবস্থিত কারখানা পরিদর্শন করে বন্ধ দেখতে পায়। সেই খবর ডিএসই তাদের ওয়েবসাইটেও প্রকাশ করে। কোম্পানিটির পক্ষ থেকেও জানানো হয় এই শেয়ারদর বাড়ার পেছনে কোনো মূল্য সংবেদনশীল তথ্য নেই। এসব খবর দেওয়ার পরও দেখা গেছে কোম্পানিটির শেয়ার টানা বাড়ছে।
তথ্য বিশ্লেষণে দেখা গেছে, চলতি বছরের ৫ জানুয়ারি কোম্পানিটির শেয়ারদর ছিল ১১ টাকা ২০ পয়সা। এই দরে কোম্পানিটির মোট শেয়ারের মূল্য দাঁড়ায় ৮১ কোটি ৮০ লাখ টাকা। এই দর বাড়তে বাড়তে ১৫ জানুয়ারি দাঁড়ায় ১৮ টাকা ৯০ পয়সা। মাত্র ১০ কার্যদিবসের মধ্যে ৭ টাকা বেড়ে যায় কোম্পানিটির শেয়ার। এরপর তা টানা বাড়তে বাড়তে গত ৪ ফেব্রুয়ারি এসে দাঁড়ায় ৩৩ টাকা ২০ পয়সায়। এ হিসাবে এক মাসের ব্যবধানে কোম্পানিটির শেয়ারদর বেড়েছে ২২ টাকা। কোম্পানিটির মোট শেয়ারের মূল্য বেড়ে দাঁড়িয়েছে ২৪২ কোটি ৪৯ লাখ টাকা।
তথ্যানুসারে, গত বছরের ২৩ ডিসেম্বর ডিএসইতে খুলনা প্রিন্টিং অ্যান্ড প্যাকেজিংয়ের শেয়ারদর ছিল ৭ টাকা ২০ পয়সা। এর পর থেকেই কোম্পানিটির শেয়ারদর টানা বাড়তে থাকে। বন্ধ থাকা এ কোম্পানিটির শেয়ারদর ও লেনদেন বাড়ার কারণ জানতে চেয়ে ডিএসইর পক্ষ থেকে চিঠি দেওয়া হয়েছিল। এর জবাবে কোম্পানিটি জানিয়েছে, কোম্পানিটির সাম্প্রতিক শেয়ারদর ও লেনদেন বাড়ার পেছনে কোনো ধরনের মূল্য সংবেদনশীল তথ্য নেই। ডিএসইর কর্মকর্তারা কোম্পানিটির কারখানা পরিদর্শনে গিয়ে এর কার্যক্রম বন্ধ পেয়েছে।
সর্বশেষ অনিরীক্ষিত আর্থিক প্রতিবেদন অনুসারে, সমাপ্ত ২০২২-২৩ হিসাব বছরের প্রথমার্ধে (জুলাই-ডিসেম্বর) কোম্পানিটির শেয়ারপ্রতি লোকসান হয়েছে ১১ পয়সা, আগের হিসাব বছরে যা ছিল ২ টাকা ৯৯ পয়সা। আর সর্বশেষ দ্বিতীয় প্রান্তিকে (অক্টোবর-ডিসেম্বর) কোম্পানিটির শেয়ারপ্রতি লোকসান হয়েছে ৬ পয়সা, আগের হিসাব বছরের একই সময়ে যা ছিল ১ টাকা ৯৬ পয়সা। ৩১ ডিসেম্বর ২০২২ শেষে কোম্পানিটির শেয়ারপ্রতি নিট দায় দাঁড়িয়েছে ১ টাকা ৯৮ পয়সায়। কোম্পানিটির স্বল্প ও দীর্ঘমেয়াদি ঋণ মিলিয়ে মোট ঋণ রয়েছে ৫৫ কোটি ১৬ লাখ টাকা। এর মধ্যে স্বল্পমেয়াদি ঋণ ২৩ কোটি ৬১ লাখ ও দীর্ঘমেয়াদি ঋণ রয়েছে ৩১ কোটি ৫৫ লাখ টাকা।
সর্বশেষ ছয় বছর ধরে টানা লোকসানে রয়েছে খুলনা প্রিন্টিং অ্যান্ড প্যাকেজিং লিমিটেড। সর্বশেষ বছরগুলোয় কোম্পানিটির ব্যবসার পরিধিও ছোট হয়েছে। আর্থিক প্রতিবেদন বিশ্লেষণে দেখা যায়, ২০১৬-১৭ হিসাব বছর থেকে টানা লোকসানে রয়েছে খুলনা প্রিন্টিং অ্যান্ড প্যাকেজিং। আলোচ্য হিসাব বছরে কোম্পানিটির আয় হয়েছিল ৭ কোটি ১০ লাখ টাকা। এ সামান্য আয়ের বিপরীতে কোম্পানিটিকে পরিচালন লোকসান গুনতে হয়েছে ৪ কোটি ৩৩ লাখ টাকা। বিভিন্ন খরচ শেষে কোম্পানিটির কর-পরবর্তী নিট লোকসান হয়েছে ৮ কোটি ৯৪ লাখ টাকা। লোকসানের কারণে আলোচ্য হিসাব বছরে শেয়ারহোল্ডারদের কোনো লভ্যাংশ দেয়নি কোম্পানিটি। একইভাবে পরের বছর অর্থাৎ ২০১৭-১৮ হিসাব বছরেও শেয়ারহোল্ডারদের কোনো লভ্যাংশ দেয়নি কোম্পানিটি। আলোচ্য হিসাব বছরে কোম্পানিটি আয় দেখিয়েছে শূন্য। এ সময়ে তাদের পরিচালন লোকসান গুনতে হয়েছে ২ কোটি ১১ লাখ টাকা। আর বিভিন্ন খরচ শেষে কর-পরবর্তী নিট লোকসান হয়েছিল ৮ কোটি ৮৯ লাখ টাকা।
২০১৪ সালে পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত খুলনা প্রিন্টিংয়ের অনুমোদিত মূলধন ১০০ কোটি ও পরিশোধিত মূলধন ৭৩ কোটি ৪ লাখ টাকা। কোম্পানির মোট শেয়ার সংখ্যা ৭ কোটি ৩০ লাখ ৪০ হাজার টাকা। এর মধ্যে উদ্যোক্তা পরিচালকদের কাছে ৩৯ দশমিক ৭৬ শতাংশ, প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারীদের কাছে ১ দশমিক ১১ ও সাধারণ বিনিয়োগকারীদের কাছে বাকি ৫৯ দশমিক ১৩ শতাংশ শেয়ার রয়েছে।