মসজিদের চারদিকে রঙের মেলা। সুউচ্চ মিনার, দেয়াল, দরজা-জানালা থেকে শুরু করে সব কিছুতে রংবেরঙের কারুকাজ। এসব দেখেই অনুমান করা যায়, এ মসজিদে মোগল স্থাপত্যশৈলীর অনুকরণ করা হয়েছে। বলছিলাম বন্দরনগরী চট্টগ্রামের অনন্য নিদর্শন ১৫৫ বছরের পুরোনো ঐতিহ্যবাহী চন্দনপুরা হামিদিয়া তাজ মসজিদের কথা। মসজিদ-ই-সিরাজউদ্দৌলা নামে এটি পরিচিত হলেও সবাই একে ডাকে চন্দনপুরা তাজ মসজিদ নামে।
সরেজমিন দেখা যায়, মোগল ধাঁচে গড়ে তোলা মসজিদটিতে রয়েছে ছোট-বড় ১৫টি গম্বুজ। মাঝখানে থাকা গম্বুজটি বেশ বড়। গম্বুজের চারপাশে লেখা রয়েছে জীবদ্দশায় জান্নাতের সুসংবাদ পাওয়া ১০ সাহাবির নাম, ইসলামি পরিভাষায় যাদের বলা হয় ‘আশরায়ে মুবাশশারা’। প্রতিটি গম্বুজে যাওয়ার জন্য সিঁড়িও রয়েছে। মসজিদের ভেতরে-বাইরে দেখা যায়, লতাপাতা আর ফুলের নকশা করা নানা কারুকাজ। লাল, সাদা, সবুজ, হলুদসহ নানা রং ব্যবহার করা হয়েছে এতে। দরজা-জানালা, মিনার-মিহরাব সবখানেই বর্ণিল কারুকাজ চোখে পড়ে। দুপাশে রয়েছে ওপরে ওঠার সিঁড়ি। বাঁ দিকে গিয়ে কিছুটা সামনে এগোলেই অজুখানা। নিচতলায় নামাজঘরে ঢোকার তিনটি দরজা রয়েছে। ভেতরে দুপাশের আটটি জানালাও বেশ বড়। এসব জানালা দিয়ে মসজিদে আলো-বাতাস চলাচল স্বাভাবিক থাকার কথা। তবে স্থাপনা নির্মাণের কারণে বর্তমানে উত্তর পাশের জানালাগুলো দিয়ে আলো-বাতাস চলাচল ব্যাহত হচ্ছে।
ইতিহাস থেকে জানা যায়, ১৬৬৬ সালে শায়েস্তা খানের সেনাবাহিনী আরাকান মগরাজাদের কবল থেকে
চট্টগ্রামকে মুক্ত করলে এখানে মোগল শাসন কায়েম হয়। তখন শাহী ফরমান বলে বিজিত অঞ্চলে অনেক মসজিদ নির্মাণ করা হয়। এর মধ্যে সে সময়কার হামজা খানের মসজিদ, আন্দরকিল্লা শাহি জামে মসজিদ, অলি খাঁ জামে মসজিদ অন্যতম।
চট্টগ্রাম নগরীর সিরাজউদ্দৌলা সড়কের পশ্চিম পাশে মোগল স্থাপনাশিল্পের আদলে ১৮৭০ সালে মাটি ও চুন-সুড়কির দেয়াল আর টিনের ছাদের মসজিদ প্রতিষ্ঠা করেন আবদুল হামিদ মাস্টার। তখনো মাটির দেয়ালে কারুকাজে ভরপুর ছিল। তার বংশধর ব্রিটিশ সরকারের ঠিকাদার আবু সৈয়দ দোভাষ ১৯৪৬ সালে এই মসজিদের সংস্কারকাজে হাত দেন। চারপাশের দেয়ালগুলো ভেন্টিলেশন সিস্টেমের। দেয়ালের ফাঁক গলে ঢুকছে আলো। আলোর ঝরনাধারায় ভেতরটা করছে ঝলমল। আছে বাতাসের কোমল পরশ। ব্রিটিশ আমলে শুরু হয়ে পাকিস্তান আমলে ১৯৫০ সালের দিকে মসজিদের প্রথম সংস্কারকাজ সমাপ্ত হয়।
অনেকের কাছে এ মসজিদটি চন্দনপুরা বড় মসজিদ নামেও পরিচিত। এখন মসজিদটির বয়স ১৫৫ বছর। চট্টগ্রামের পর্যটন শিল্পের পরিচয় তুলে ধরতে মসজিদটির ছবি ব্যবহার করা হয় দেশ-বিদেশের বিভিন্ন প্রকাশনায়। এসব প্রকাশনায় এ মসজিদের ছবি থাকায় বিদেশ থেকে পর্যটকরাও আসেন এখানে। আবু সৈয়দ দোভাষ সেই সময়ে কলকাতা থেকে কারিগর ও দিল্লিসহ বিভিন্ন স্থান থেকে উপকরণ এনে ১৩ শতক জায়গার ওপর দোতলা মসজিদটি গড়ে তোলেন।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, বর্তমানে এই মসজিদে একজন ইমাম, একজন হাফেজ ও দুজন মুয়াজ্জিন রয়েছেন। প্রতিদিনই নতুন নতুন মুসল্লি এ মসজিদে নামাজ আদায় করতে ও দেখতে আসেন। আশপাশেও অনেক নতুন মসজিদ গড়ে উঠলেও এই মসজিদে নিয়মিত মুসল্লির সংখ্যা বাড়ছে। সাধারণত দিনে গড়ে ৮০০ থেকে ৯০০ লোক নামাজ পড়েন এ মসজিদে। শুক্রবার জুমায় পাঁচ হাজার মুসল্লি ছাড়িয়ে যায়। তখন মসজিদে জায়গা সংকুলান না হলে মসজিদ সংলগ্ন রাস্তা বন্ধ করে সেখানেই নামাজ আদায় করেন মুসল্লিরা। মসজিদটিতে রয়েছে দুর্লভ ইসলামী নিদর্শনাবলির সমৃদ্ধ সংগ্রহশালা, যা দেখার জন্য দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে পর্যটকরা এখানে আসেন।
মসজিদটির সামনে কথা হয় বাকলিয়া এলাকার বাসিন্দা আজিজুল কাদিরের সঙ্গে। পেশায় চিত্রশিল্পী আজিজুল আসরের নামাজ আদায় করতে মসজিদটিতে এসেছেন। জানতে চাইলে তিনি বলেন, মসজিদজুড়ে বর্ণিল কারুকাজ তাকে মোহিত করে। তাই মাঝেমধ্যে মসজিদটি দেখতে আসেন। একই সঙ্গে নামাজও আদায় করেন। পুরোনো মসজিদে নামাজ আদায়ে এক ধরনের ভালো লাগা কাজ করে।
মুসল্লিদের অভিযোগ, প্রায় কয়েকশ বছর আগে নির্মিত ঐতিহাসিক ‘চন্দনপুরা হামিদিয়া তাজ মসজিদ’ অপরিকল্পিত সংস্কার কাজের ফলে স্থাপত্যকলা বিনষ্ট হওয়ার পথে। প্রতি পাঁচ বছর পরপর মসজিদটি সংস্কার করা হচ্ছে। কিন্তু সুকারুকাজের কারিগরের অভাবে সংস্কারকাজও সঠিকভাবে করা যায় না। বৈরী আবহাওয়ায় এসব জিনিস যেমন নষ্ট হয়েছে, তেমনি সংস্কারের সময়ও অনেক কিছু হারিয়ে গেছে।
স্থপতি আশিক ইমরানের কাছে মসজিদটি সম্পর্কে জানতে চাইলে তিনি বলেন, এটি চট্টগ্রামের ঐতিহ্যবাহী একটি স্থাপনা। অসাধারণ নির্মাণশৈলী, কারুকাজ রয়েছে এখানে। এটি সংরক্ষণ করতে হবে। পৃথিবীর উন্নত দেশে এ ধরনের স্থাপনা সরকারিভাবে রক্ষণাবেক্ষণ, সংস্কার করা হয়। এ ধরনের স্থাপনায় কেউ হাত দিতে পারে না। এখনো মসজিদটির অনেক গুরুত্বপূর্ণ নকশা, ডিজাইন, কারুকাজ, ধাতব উপকরণ অক্ষত আছে। বৈজ্ঞানিক পন্থা, ইঞ্জিনিয়ারিং মেথড অনুসরণ করে প্রাচীন মসজিদটি সংরক্ষণ করা গেলে এটি দেশের মূল্যবান সম্পদ হবে। হাজার হাজার পর্যটক আসবে মসজিদটি দেখতে।
মন্তব্য করুন