চট্টগ্রাম বন্দরের কনটেইনার ওঠানামায় এতদিন নিউমুরিং কনটেইনার টার্মিনাল (এনসিটি) ও চিটাগাং কনটেইনার টার্মিনাল (সিসিটি) ছিল মূল ভরসা। আধুনিক সুবিধাসম্পন্ন এই দুটি টার্মিনালেই ২০২৪ সালে বন্দরের নির্ভরতা আরও বেড়ে যায়। তবে নানা সুবিধা থাকা সত্ত্বেও চলতি বছর দুই টার্মিনাল কিছুটা পিছিয়ে পড়েছে। এর বিপরীতে, নানা প্রতিকূলতার মধ্যেও এগিয়ে এসেছে জেনারেল কার্গো বার্থের (জিসিবি) ছয়টি জেটি, যা এবার রেকর্ডসংখ্যক কনটেইনার হ্যান্ডলিং করেছে।
চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষের তথ্য বলছে, ২০২৪ সালের এপ্রিল মাস শেষ হওয়ার আগেই জিসিবির ছয়টি জেটিতে ৮৩২ টিইইউএস কনটেইনার হ্যান্ডলিং হয়েছে, যা সাম্প্রতিক সময়ের মধ্যে সর্বোচ্চ। এমন সাফল্যকে ইতিবাচক হিসেবে দেখছেন বন্দর ব্যবহারকারীরা। তাদের মতে, আরও সহযোগিতা পেলে এই সংখ্যা আরও বাড়বে।
চট্টগ্রাম বন্দরের চেয়ারম্যান রিয়ার অ্যাডমিরাল এস এম মুনিরুজ্জামান বলেন, জিসিবি এবার অতীতের সব রেকর্ড ভেঙে এনসিটি ও সিসিটিকে ছাড়িয়ে গেছে। যদিও জিসিবিতে গিয়ার্ড জাহাজনির্ভর লোড-আনলোড পদ্ধতি প্রচলিত এবং ব্যাকআপ ইয়ার্ডগুলো ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকায় কাজ তুলনামূলক সময়সাপেক্ষ। অন্যদিকে, এনসিটি-সিসিটি ডেডিকেটেড কনটেইনার টার্মিনাল হওয়ায় সেখানে দ্রুত কনটেইনার হ্যান্ডলিং সম্ভব হয়।
তিনি জানান, ২০২৪ সালে জিসিবিতে প্রতি ঘণ্টায় গড়ে ১৮-১৯টি কনটেইনার হ্যান্ডলিং হয়েছে, যেখানে এনসিটি ও সিসিটিতে হয়েছে ১৭-১৮টি। জিসিবিতে প্রতিদিন একেকটি জাহাজ থেকে গড়ে ৮৬০ টিইইউএস হ্যান্ডলিং হয়েছে, যেখানে সিসিটিতে ৮৩১ ও এনসিটিতে ৮৩৯ টিইইউএস হ্যান্ডলিং হয়েছে। জিসিবির এই অর্জনের পেছনে রয়েছে বার্থ অপারেটরদের ঐকান্তিক প্রচেষ্টা, কঠোর মনিটরিং এবং দক্ষ শ্রমিক ব্যবস্থাপনা।
চট্টগ্রাম বন্দর সচিব মোহাম্মদ ওমর ফারুক জানান, এনসিটি ও সিসিটির পাশাপাশি জিসিবির সক্ষমতাও দ্রুত বাড়ছে। তিনি বলেন, বন্দর কর্তৃপক্ষের পক্ষ থেকে সব ধরনের সহযোগিতা দেওয়া হচ্ছে এবং ভবিষ্যতে তা আরও বাড়ানো হবে।
তথ্য অনুযায়ী, চলতি অর্থবছরের (২০২৪-২৫) অক্টোবরে জিসিবিতে ৮৫৯ টিইইউএস, নভেম্বর মাসে ৮৬২ টিইইউএস, ডিসেম্বরে ৭৭৩ টিইইউএস এবং জানুয়ারিতে ৬৮৭ টিইইউএস হ্যান্ডলিং হয়েছে। ফেব্রুয়ারি ও মার্চ মাসে যথাক্রমে ৬৫৯ ও ৫১৫ টিইইউএস হ্যান্ডলিং হয়। এপ্রিল মাসের ২৭ তারিখ পর্যন্ত হ্যান্ডলিং হয়েছে ৮৩২ টিইইউএস, যা সাম্প্রতিক রেকর্ড।
অন্যদিকে, সিসিটিতে অক্টোবর থেকে মার্চ পর্যন্ত গড়ে ৭০০-৯০০ টিইইউএস হ্যান্ডলিং হয়েছে এবং এনসিটিতে এই সময়কালে হ্যান্ডলিং হয়েছে গড়ে ৮০০-৯০০ টিইইউএস।
বন্দর ব্যবহারকারীরা জানান, দেশের অর্থনৈতিক গতি রক্ষায় এতদিন এনসিটি ছিল প্রধান ভরসা। কারণ দ্রুত পণ্য ওঠানামার জন্য এনসিটির সুবিধাজনক অবস্থান, গভীর পানির সুবিধা এবং ‘কি গ্যান্ট্রি ক্রেন’ (কিউজিসি) থাকার ফলে এনসিটি বেশি সক্ষম ছিল। যদিও কিউজিসির বেশিরভাগই পুরোনো হওয়ায় মাঝেমধ্যেই ত্রুটি দেখা দেয়। সিসিটিতে জেটির সংখ্যা মাত্র দুটি হওয়ায় সেখানকার সামর্থ্য সীমিত।
জিসিবির সুবিধা থাকলেও চ্যালেঞ্জও রয়েছে। এখানে গিয়ার্ড জাহাজ ব্যবহার করা হয় এবং ট্রেইলর ও চালক-সহকারী নিয়ে বাহিরের পক্ষের ওপর নির্ভর করতে হয়। তবুও, ২০২৪ সালে জিসিবি ছয়টি জেটি মিলিয়ে ১০ লাখ ১৬ হাজার টিইইউএস কনটেইনার হ্যান্ডলিং করেছে, যেখানে এনসিটি চারটি জেটি মিলিয়ে করেছে ১২ লাখ ৬২ হাজার টিইইউএস।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, জিসিবির অভ্যন্তরীণ দুর্বলতা থাকা সত্ত্বেও তাদের দৃঢ় মনোবল, শ্রমিক দক্ষতা এবং মনিটরিং ব্যবস্থা উন্নত হওয়ায় এমন সাফল্য অর্জন সম্ভব হয়েছে। ভবিষ্যতে যদি জিসিবিতে অবকাঠামো ও সরঞ্জাম উন্নয়ন করা হয়, তাহলে তারা এনসিটির পর আরও বড় বিকল্প হয়ে উঠতে পারবে।
মন্তব্য করুন