সিলেটের অন্যতম পর্যটনকেন্দ্র কোম্পানীগঞ্জের ভোলাগঞ্জের সাদাপাথরে পাথর লুটপাটের পর এবার ঘুম ভেঙেছে সবার। জেলা প্রশাসন, দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক), স্থানীয় প্রশাসন, রাজনৈতিক দলসহ সুশীল সমাজের টনক নড়েছে। সবাই যে যার মতো ব্যবস্থা নিচ্ছেন। আন্দোলনে নেমেছেন পরিবেশবাদীরাও। এ পর্যটনকেন্দ্রকে আগের রূপে ফেরাতে পাথর উদ্ধার করে নদীতে ফেলা হচ্ছে। কিন্তু কয়েক মাস ধরে কালবেলাসহ বিভিন্ন গণমাধ্যম ও টেলিভিশনে ধারাবাহিক প্রতিবেদন প্রচার হলেও এর প্রতিকারে কারও কোনো পদক্ষেপ দেখা যায়নি। গত ১২ আগস্ট রাতে ট্রাকে করে পাথর সরিয়ে নেওয়ার ভিডিও প্রকাশ করে কালবেলা। এরপর থেকেই তীব্র সমালোচনার মুখে পড়ে স্থানীয় প্রশাসন সরব হয়।
এদিকে, ভোলাগঞ্জ থেকে পাথর লুটপাটকারীদের তালিকা দাখিলের জন্য স্থানীয় প্রশাসনকে নির্দেশ দিয়েছেন হাইকোর্ট। আগামী দুই মাসের মধ্যে র্যাব, বিজিবি, পুলিশসহ স্থানীয় সিভিল প্রশাসনের সহযোগিতায় এই তালিকা করে প্রতিবেদন আকারে হাইকোর্টে দাখিল করতে বলা হয়েছে।
জেলা প্রশাসকের সাদাপাথর পরিদর্শন: গতকাল বৃহস্পতিবার দুপুরে কোম্পানীগঞ্জের পর্যটনকেন্দ্র সাদাপাথর এলাকা পরিদর্শন করেছেন সিলেটের জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ শের মাহবুব মুরাদ। এ সময় সাংবাদিকদের তিনি বলেন, ‘সাদাপাথর এলাকায় সাম্প্রতিক সময়ে যে লুটপাট হয়েছে, তা রোধে জেলা প্রশাসন কঠোর অবস্থান নিয়েছে। যারা এই অবৈধ কাজে জড়িত, তাদের গ্রেপ্তারসহ আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়া হবে। আমরা আশা করছি, দ্রুত সময়ের মধ্যে যেগুলো চুরি হয়ে গিয়েছিল, সেগুলো পুনরুদ্ধার করে এখানে আবার প্রতিস্থাপন করতে পারব। এ ছাড়া পাথর লুটে জড়িতদের গ্রেপ্তারসহ আইনানুগ ব্যবস্থা নেব।’ পর্যটকদের উদ্দেশে তিনি বলেন, ‘আপনারা সাদাপাথরে আসুন। এখানকার পরিবেশ এখনো পর্যটনবান্ধব।’
লুট হওয়া ৩৫ হাজার ঘনফুট পাথর জব্দ, ফেলা হচ্ছে সাদাপাথরে: গতকাল পর্যন্ত সিলেটে যৌথ বাহিনীর অভিযানে ৩৫ হাজার ঘনফুট পাথর জব্দ করা হয়েছে। সিলেটের বিভিন্ন এলাকায় এ অভিযান চালানো হয়। অভিযানে প্রায় ১৩০টি গাড়ি তল্লাশি করা হয়। এর মধ্যে ৭০টি ট্রাকে থাকা প্রায় ৩৫ হাজার ঘনফুট পাথর জব্দ করা হয়। এগুলো সাদাপাথর ও জাফলং এলাকার নদীতে ফেরত দেওয়ার প্রক্রিয়া চলছে বলে জানিয়েছে প্রশাসন। গতকাল বিকেল ৫টা পর্যন্ত ভোলাগঞ্জ ঘাট থেকে ১৫টি নৌকায় করে সাদাপাথর পর্যটন কেন্দ্রে নিয়ে ফেলা হচ্ছিল। এর আগে বুধবার সাদাপাথর এলাকায় অভিযান চালিয়ে ১২ হাজার ঘনফুট পাথর জব্দ করা হয়।
জাফলংয়ে দুই হাজার ঘনফুট পাথর উদ্ধার: জাফলংয়ে জিরো পয়েন্টে পাথর চুরি ও লুটপাট বন্ধ করতে অভিযান চালিয়েছে প্রশাসন। এ সময় দুই হাজার ঘনফুট পাথর উদ্ধার করা হয়েছে। তবে এ ঘটনায় জড়িত কাউকে গ্রেপ্তার করা সম্ভব হয়নি। গতকাল সকাল থেকে বিকেল সোয়া ৪টা পর্যন্ত অভিযান চালিয়ে ২ হাজার ঘনফুট পাথর উদ্ধার করা হয়। বিষয়টি কালবেলাকে নিশ্চিত করেছেন অভিযানে নেতৃত্ব দেওয়া গোয়াইনঘাট উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইএনও) রতন কুমার অধিকারী।
পাথর লুটকারীদের তালিকা দাখিলের নির্দেশ: ভোলাগঞ্জ থেকে সাদা পাথর লুটকারীদের তালিকা দাখিলের জন্য স্থানীয় প্রশাসনকে নির্দেশ দিয়েছেন হাইকোর্ট। আগামী দুই মাসের মধ্যে র্যাব, বিজিবি, পুলিশসহ স্থানী সিভিল প্রশাসনের সহযোগিতায় এ তালিকা করে প্রতিবেদন আকারে হাইকোর্টে দাখিল করতে বলা হয়েছে। একই সঙ্গে ভোলাগঞ্জের লুট হওয়া সব পাথর দেশের যেসব এলাকায় গেছে, সেখান থেকে ফেরত এনে স্থানীয় প্রশাসন ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সহযোগিতায় সাত দিনের মধ্যে আগের জায়গায় ফেলতে নির্দেশ দিয়েছেন আদালত। আগামী বৃহস্পতিবারের মধ্যে এসব আদেশ বাস্তবায়নের অগ্রগতি প্রতিবেদন দাখিল করতে প্রশাসনকে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।
এ ছাড়া এই সাদাপাথর লুটের ঘটনায় কী পরিমাণ আর্থিক ও পরিবেশগত ক্ষতি হয়েছে, তা বুয়েটের একজন অধ্যাপকের নেতৃত্বে উচ্চ ক্ষমতাসম্পন্ন একটি বিশেষজ্ঞ কমিটি গঠন করতে বিবাদীদের প্রতি নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। পরিবেশ সচিব ও খনিজসম্পদ মন্ত্রণালয়ের সচিবকে সাত দিনের মধ্যে ওই কমিটি করতে এবং তিন মাসের মধ্যে তদন্ত করে প্রতিবেদন দাখিল করতে বলা হয়েছে।
জনস্বার্থে পরিবেশবাদী সংগঠন হিউম্যান রাইটস অ্যান্ড পিস ফর বাংলাদেশের করা এক রিটের প্রাথমিক শুনানি নিয়ে গতকাল বিচারপতি কাজী জিনাত হক ও বিচারপতি আইনুন নাহার সিদ্দিকার সমন্বয়ে গঠিত হাইকোর্ট বেঞ্চ রুলসহ এ আদেশ দেন।
ভোলাগঞ্জে সাদাপাথর লুট করে নেওয়ার ক্ষেত্রে প্রশাসনের নিষ্ক্রিয়তাকে কেন অবৈধ ও বেআইনি ঘোষণা করা হবে না এবং এ এলাকাটিকে সংরক্ষণের কেন নির্দেশ দেওয়া হবে না, তা জানতে রুল জারি করা হয়েছে। একই সঙ্গে পরিবেশ আইনের ৫ ধারা অনুযায়ী ওই এলাকাকে কেন ইকোলজিক্যাল ক্রিটিক্যাল এরিয়া হিসেবে ঘোষণা করা হবে না এবং যারা এই পাথর লুট করে পরিবেশের ক্ষতি করেছেন তাদের কাছ থেকে কেন ক্ষতিপূরণ আদায়ের নির্দেশ দেওয়া হবে না রুলে তাও জানতে চাওয়া হয়েছে। পরিবেশ সচিব, সিলেটের জেলা প্রশাসক, এসপি, বিজিবি, র্যাবসহ স্থানীয় প্রশাসনকে এসব রুলের জবাব দিতে বলা হয়েছে। আদালতে রিটের পক্ষে শুনানি করেন অ্যাডভোকেট মনজিল মোরসেদ।
আইনজীবী মনজিল মোরসেদ জানিয়েছেন, প্রশাসনের চোখের সামনে দিয়ে এই সাদাপাথর লুট করে নেওয়া হয়েছে, পরিবেশের ক্ষতি করা হয়েছে। আমরা যেহেতু পরিবেশ নিয়ে কাজ করি, তাই জনস্বার্থে রিট করি। সকালে রিট করার পর দুপুরে ওই রিটের শুনানি হয়।
এদিকে ভোলাগঞ্জ থেকে সাদাপাথর লুটের ঘটনায় দায়ীদের বিরুদ্ধে যথাযথ আইনি ব্যবস্থা নিতে দায়ের করা আরেকটি রিটের শুনানির জন্য রোববার দিন ধার্য করেছেন হাইকোর্ট। গতকাল বিচারপতি ফাহমিদা কাদের ও বিচারপতি সৈয়দ জাহেদ মনসুরের হাইকোর্ট বেঞ্চ এ দিন ধার্য করেন। আদালতে রিট আবেদনটি শুনানির জন্য উপস্থাপন করেন অ্যাডভোকেট মীর একেএম নূরুন নবী। বুধবার আইনজীবী নুরুন নবী রিট আবেদনটি দায়ের করেন।
‘পাথর লুটের ঘটনায় প্রকৃত অপরাধীকে আড়ালের চেষ্টা হচ্ছে’:
ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশের মুখপাত্র ও দলের যুগ্ম মহাসচিব মাওলানা গাজী আতাউর রহমান বলেছেন, জুলাই অভ্যুত্থানের অন্যতম প্রধান নেতা ইসলামী আন্দোলনের সিনিয়র নায়েবে আমির মুফতি সৈয়দ মুহাম্মাদ ফয়জুল করীমকে বিতর্কিত করার একটি সম্মিলিত প্রচেষ্টা চলছে। সিলেটের ভোলাগঞ্জ থেকে পাথর চুরি করল বিএনপির স্থানীয় নেতৃবৃন্দ। কিন্তু একটি নীতিগত অবস্থান ব্যক্ত করায় মুফতি ফয়জুল করীমকে লক্ষ্য করে সমালোচনার বৃত্ত তৈরি করা হচ্ছে। গতকাল এক বিবৃতিতে তিনি এ কথা বলেন।
গাজী আতাউর রহমান বলেন, বিগত ফ্যাসিস্ট সরকার স্থানীয় মানুষের রুটি-রুজির বিষয়টি বিবেচনা না করে পাথর উত্তোলন পুরোপুরি বন্ধ করে দেয়। যার আর্থসামাজিক ও প্রাকৃতিক বিরূপ প্রতিক্রিয়া হয়েছিল। সেই বিবেচনায় ফয়জুল করিম সরকারের কাছে একটি নীতিমালার ভিত্তিতে পাথর উত্তোলনের জন্য অনুমতি প্রদানের দাবি জানিয়েছেন। একই সঙ্গে স্পষ্ট করে পরিবেশ রক্ষার তাগিদও প্রদান করেছেন। তার এ অবস্থান নীতিগতভাবে এবং আইনগতভাবে সম্পূর্ণ বৈধ। তার ই বক্তব্যকে কাটছাঁট করে উদ্দেশ্যপ্রণোদিত অপপ্রচার করা রাজনৈতিক শিষ্টাচারবহির্ভূত এবং প্রকৃত অপরাধীকে আড়াল করার অপচেষ্টা। ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশ এর তীব্র নিন্দা ও প্রতিবাদ জানাচ্ছে।
মন্তব্য করুন