ওদের কোথায় না খুঁজেছি? মৌলভীবাজারের আদমপুর, হবিগঞ্জের সাতছড়ি জাতীয় উদ্যান, রাঙামাটির কাপ্তাই জাতীয় উদ্যান—সবখানেই। যখন এসব জায়গায় ব্যর্থ হলাম, তখন সন্ধান করতে গেলাম লাউয়াছড়া জাতীয় উদ্যানে। উদ্যানে গিয়ে প্রথমেই মূল ফটকের ডান পাশ দিয়ে নিচের ছড়াটায় নেমে গেলাম। ছাড়া ছাড়া রোদ ও ছায়ায় ধীরে ধীরে প্রায় আধা কিলোমিটার সর্পিল ছড়াটায় হেঁটে রেল সেতুর নিচে পৌঁছলাম। বেশ ঠান্ডা এখানে, তাই মিনিট দশেক দাঁড়িয়ে গা-টা জুড়িয়ে নিলাম। সেতুর গোড়ায় কিছুটা পানি জমে ছিল, এক লাফে পেরোতে পারলাম না। কেডস-মোজা ভিজে গেল, তবে ঠান্ডা পানিতে শরীরটা জুড়িয়ে গেল যেন! এরপর সন্তর্পণে হেঁটে হেঁটে লেবু বাগানের কাছে এসে থামলাম। না, একটিও নেই। অথচ কী সুন্দর ঝলমলে মিষ্টি রোদ আজ। বাতাসে আপেক্ষিক আর্দ্রতাও কম মনে হচ্ছে। তাহলে ওদের কেন দেখছি না?
যাহোক, নিরাশ হলাম না। পা টিপে টিপে লেবু বাগানের শেষ প্রান্তে চলে এলাম। ছড়ার এ অংশে বালুর দানা কিছুটা বড়। চুপচাপ দাঁড়িয়ে ক্ষীণ ধারার বালুময় ছড়ার প্রতি ইঞ্চি জায়গায় ক্যামেরার ভিউ ফাইন্ডার দিয়ে চোখ বোলালাম। তবে, বেশিক্ষণ সময় লাগল না। ১০টা ৪১ মিনিট ৮ সেকেন্ড থেকে ১০টা ৪২ মিনিটি ১০ সেকেন্ডে মোট ১২টি ক্লিক করতে পারলাম। এরপর ওরা দ্রুত উড়ে গাছের উপরের দিকে চলে গেল। আর নেমে এলো না। পরবর্তী সময়ে বেশ কবার ওদের ছবি তুলেছি সাতছড়ি জাতীয় উদ্যানে।
এতক্ষণ যাদের কথা বললাম, ওরা আর কেউ নয়, এ দেশের এক বিরল ও সংকটাপন্ন প্রজাতির প্রজাপতির হলদে খঞ্জর। লাঠিয়াল নামেও পরিচিত। ইংরেজি নাম Five-bar Swordtail। প্যাপিলিওনিডি বা সোয়ালোলেজি গোত্রের প্রজাপতিটির বৈজ্ঞানিক নাম Graphium antiphates। সুদর্শন প্রজাপতিটি বাংলাদেশ ছাড়াও ভারতের বিভিন্ন অঞ্চল, শ্রীলঙ্কা, মিয়ানমার, থাইল্যান্ড, সিঙ্গাপুর, মালয়েশিয়া, ফিলিপাইন প্রভৃতি দেশেও বিস্তৃত।
হলদে খঞ্জর মাঝারি আকারের প্রজাপতি। প্রসারিত অবস্থায় ডানার দৈর্ঘ্য ৮০ থেকে ৯৫ মিলিমিটার। স্ত্রী-পুরুষ দেখতে একই রকম। সামনের ডানার উপরের ভিত্তি রং সাদা ও তার ওপর পাঁচটি কালো ডোরা রয়েছে। ডানার নিচটা দেখতে ওপরের মতোই, তবে কালো ডোরার মধ্যবর্তী অংশে সাদার ওপর সবুজের আভা রয়েছে। পেছনের ডানার নিচের পক্ষমূল সবুজ ও তাতে কমলা-হলদে পার্শ্বদাগ রয়েছে। ডানার মতো দেহ এবং পায়েও একই ধরনের রং ও কারুকাজ দেখা যায়। পেছনের ডানায় তলোয়ারের মতো লম্বা লেজটি সাদায় মোড়ানো কালচে-বাদামি। শুঁড় এবং চোখ গাঢ় কালো রঙের।
ওরা দেশের উত্তরপূর্ব (সিলেট বিভাগ) ও দক্ষিণপূর্বাঞ্চলের (চট্টগ্রাম বিভাগ) পাহাড়ি ও আর্দ্র চিরসবুজ বনের বাসিন্দা। সচরাচর একাকি, জোড়ায় বা দলে দেখা যায়। বেশ দ্রুতগতিতে এবং বাহারি ঢঙে ওড়ে। সচরাচর গাছের ওপরের দিকে চক্রাকারে উড়তে থাকে। অবশ্য প্রায়ই নিচের ভেজা মাটি বা বালুতে নেমে আসতে দেখা যায়। স্ত্রীগুলো সচরাচর সকাল ও বিকেল রসের খোঁজে ফুলে ফুলে ওড়ে বেড়ায়। পুরুষগুলোকে প্রায়ই ভেজা বালু বা স্যাঁতসেঁতে মাটিতে বসে রস চুষে খেতে দেখা যায়।
এই প্রজাপতির জীবনচক্র সম্পন্ন হতে ২৫ থেকে ২৮ দিন সময় লাগে। স্ত্রী প্রজাপতি বিভিন্ন প্রজাতির অ্যান্ননা, স্বর্ণচাপা প্রভৃতি পোশক গাছের কুঁড়ি বা কচি পাতার নিচদিকে পাতাপ্রতি একটি করে ঘিয়ে-সাদা রঙের মসৃণ ও গোলাকার ডিম পাড়ে। ডিম ফুটে সাদা রঙের শূককীট বের হয় তিন থেকে চার দিনে। দুইবার রূপান্তরিত হওয়ার পর শূককীটের বর্ণ হলদে-কমলা হয়ে যায় ও পঞ্চম বা শেষ রূপান্তর পর্যায়ে লালচে-বাদামি রং ধারণ করে। এরপর শূককীটটি কোনো একটি উপযুক্ত কাণ্ডের নিচ দিকে আটকে থেকে মূককীটে পরিণত হয়। হালকা সবুজ রঙের মূককীটের খোলস কেটে পূর্ণাঙ্গ হলেদে খঞ্জর প্রজাপতি বের হতে প্রায় ১২ দিন সময় লাগে।
লেখক: পাখি ও বন্যপ্রাণী প্রজনন ও চিকিৎসা বিশেষজ্ঞ এবং অধ্যাপক, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়, গাজীপুর
মন্তব্য করুন