

জুলাই গণঅভ্যুত্থানে সংঘটিত মানবতাবিরোধী অপরাধের দায়ে সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বিচারের মুখোমুখি হয়েছেন। ইতিহাসে এমন শীর্ষ নেতা শুধু তিনি একা নন, এর আগে ক্ষমতাচ্যুত বহু প্রেসিডেন্ট ও প্রধানমন্ত্রীর বিচারের মুখোমুখি হওয়ার নজির আছে। এ ছাড়া বিভিন্ন সময়ে আদালতের রায়ে ও বিপ্লবীদের হাতে বেশ কয়েকজন শীর্ষ রাজনীতিবিদের মৃত্যুদণ্ড হয়েছে। যাদের বিরুদ্ধে মানবতাবিরোধী অপরাধ, রাষ্ট্রদ্রোহ, সংবিধান লঙ্ঘনের মতো অভিযোগ ছিল। নিচে এমন কিছু নেতার তথ্য তুলে ধরা হলো, যাদের বিভিন্নভাবে মৃত্যুদণ্ড কার্যকর হয়েছে।
ইরাকের সাদ্দাম হোসেন: আধুনিক যুগে রাষ্ট্রপ্রধানকে মৃত্যুদণ্ডের ঘটনার সর্বশেষ নজির ঘটে ২০০৬ সালের ৩০ ডিসেম্বর ইরাকে। দেশটির সাবেক প্রেসিডেন্ট সাদ্দাম হোসেনকে ইরাকি বিশেষ ট্রাইব্যুনালে গণহত্যা (১৯৮২ সালের দুজাইল গণহত্যা) এবং মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধের অভিযোগে দোষী সাব্যস্ত করে ফাঁসির মাধ্যমে মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করা হয়। দেশটিতে মার্কিন অভিযানের পর এই বিচার আন্তর্জাতিক মনোযোগ আকর্ষণ করে, যদিও এর নিরপেক্ষতা নিয়ে ব্যাপক বিতর্ক রয়েছে।
রোমানিয়ার নিকোলাই চশেস্কু: ১৯৮৯ সালের ২৫ ডিসেম্বর রোমানিয়ার প্রেসিডেন্ট নিকোলাই চশেস্কু এবং তার স্ত্রী এলেনাকে একটি দ্রুত বিচারে গণহত্যা, মানবাধিকার লঙ্ঘন এবং দুর্নীতির অভিযোগে দোষী সাব্যস্ত করে ফায়ারিং স্কোয়াডের মাধ্যমে মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করা হয়। এ ঘটনা ইউরোপের কমিউনিস্ট শাসনের পতনের সবচেয়ে নাটকীয় মুহূর্ত হিসেবে পরিচিত।
ইরানের আমির-আব্বাস হোভেইদা: ১৯৭৯ সালের ৭ এপ্রিল ইসলামী বিপ্লবের পর ইরানের সাবেক প্রধানমন্ত্রী আমির-আব্বাস হোভেইদাকে রাজনৈতিক দমন-পীড়ন এবং দুর্নীতির অভিযোগে ফায়ারিং স্কোয়াডের মাধ্যমে মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করা হয়। শাহ মোহাম্মদ রেজা পাহলভির অধীন হোভেইদার সরকারকে বিপ্লবীদের ‘দমনকারী’ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়। তবে তার বিচার ছিল অত্যন্ত সংক্ষিপ্ত। অনেকের মতে, এটি বিচারবহির্ভূত মৃত্যুদণ্ডের খুব কাছাকাছি ছিল।
পাকিস্তানের জুলফিকার আলী ভুট্টো: সাবেক প্রেসিডেন্ট ও প্রধানমন্ত্রী জুলফিকার আলী ভুট্টোকে ১৯৭৯ সালের ৪ এপ্রিল রাওয়ালপিন্ডি জেলে ফাঁসিতে ঝুলিয়ে মৃত্যুদণ্ড কার্যকর হয়। ১৯৭৪ সালে রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ নওয়াব মোহাম্মদ আহমদ খানকে হত্যার ষড়যন্ত্রের অভিযোগে লাহোর হাইকোর্ট তাকে দোষী সাব্যস্ত করেন। তবে পাকিস্তানে এ ঘটনা ‘বিচারিক হত্যাকাণ্ড’ হিসেবে বিবেচিত, যা পরবর্তীকালে দেশটির সুপ্রিম কোর্টও ‘বিচারিক ব্যর্থতা’ বলে ঘোষণা করেন।
ইতালির মুসোলিনি: দেশটির ফ্যাসিবাদী একনায়ক বেনিতো মুসোলিনিকে ১৯৪৫ সালের ২৮ এপ্রিল দেশটির গিউলিনো দি মেজেগ্রা গ্রামে পার্টিজানরা গুলি করে মৃত্যুদণ্ড দেয়। তিনি তার প্রেমিকা ক্লারা পেতাচ্চির সঙ্গে পালানোর সময় ধরা পড়েন এবং সংক্ষিপ্ত বিচারের (বিপ্লবী ট্রাইব্যুনালের অনুমোদন) পর তাকে হত্যা করা হয়।
হাঙ্গেরির ইমরে ন্যাগি: ১৯৫৮ সালের ১৬ জুন বুদাপেস্টে ফাঁসিতে ঝুলিয়ে মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করা হয় হাঙ্গেরির সমাজতান্ত্রিক নেতা ইমরে ন্যাগির। ১৯৫৬ সালের ব্যর্থ বিপ্লবে নেতৃত্ব দেওয়ার জন্য রাষ্ট্রদ্রোহের অভিযোগ আনা হয় তার বিরুদ্ধে। তবে এটি একটি ‘শো ট্রায়াল’ হিসেবে পরিচিত, যা পরবর্তীকালে হাঙ্গেরিয়ান কমিউনিস্ট পার্টি নিজেরাই অবৈধ বলে স্বীকার করে।
মেক্সিকোর সম্রাট ম্যাক্সিমিলিয়ান: ১৮৬৭ সালে মেক্সিকোর সম্রাট ম্যাক্সিমিলিয়ানকে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয়, যার ফলে দ্বিতীয় মেক্সিকান সাম্রাজ্যের পতন ঘটে। তিনি মূলত ফ্রান্সের সমর্থনে সম্রাট হন। পরে যুক্তরাষ্ট্রের চাপে ফরাসিরা মেক্সিকো ছাড়লে তাকে রিপাবলিকান বাহিনী বন্দি করে। পরে সামরিক আদালতের মাধ্যমে তার মৃত্যুদণ্ড হয়।
ফ্রান্সের রাজা ষোড়শ লুই: ১৭৯৩ সালের ২১ জানুয়ারি ফ্রান্সের রাজা ষোড়শ লুইকে প্যারিসের বিপ্লবী ট্রাইব্যুনালে রাষ্ট্রদ্রোহের অভিযোগে দোষী সাব্যস্ত করা হয়। ফরাসি বিপ্লবের সময় রাজতান্ত্রিক শাসন এবং জনগণের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রের অভিযোগে তাকে গিলোটিনের মাধ্যমে মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করা হয়। এ ঘটনা বিপ্লবীদের জয়ের প্রতীক হিসেবে চিহ্নিত করা হয়, যা ইউরোপীয় রাজতন্ত্রের পতনের সূচনা করে। ওই ঘটনার কয়েক মাস পর রানি মারি আঁতোয়ানেতকেও গিলোটিন যন্ত্রের মাধ্যমে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয়। অনেকে মনে করতেন, তার বিলাসিতা ও খরচের কারণেই ফ্রান্স অর্থনৈতিকভাবে দুর্বল হয়ে পড়েছিল।
ইংল্যান্ডের রাজা প্রথম চার্লস: ১৬৪৯ সালের ৩০ জানুয়ারি ইংল্যান্ডের রাজা প্রথম চার্লসকে শিরশ্ছেদ করে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয়। কর্তৃত্ববাদী শাসন এবং পার্লামেন্টের সঙ্গে বিরোধের জেরে রাষ্ট্রদ্রোহের জন্য দোষী সাব্যস্ত করে তার এ মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করা হয়। রাজা প্রথম চার্লসের মৃত্যুদণ্ড ইংরেজ গৃহযুদ্ধের পরিণতি এবং সাংবিধানিক রাজতন্ত্রের জন্ম দেয়, যা আধুনিক গণতন্ত্রের ভিত্তি স্থাপন করে।
বিশ্লেষকদের মতে, এই মৃত্যুদণ্ডগুলো শুধু আইনি সিদ্ধান্ত নয়। অনেক ক্ষেত্রে ক্ষমতার পরিবর্তন, অভ্যুত্থান বা যুদ্ধ-পরবর্তী পরিস্থিতিতে এসব বিচার অনুষ্ঠিত হয়েছে।
যার কারাদণ্ড হয়েছে: এ ছাড়া অনেক শীর্ষ রাজনীতিবিদের কারাদণ্ড হয়েছে। গত মাসেই কারাভোগ করেছেন ফ্রান্সের সাবেক প্রেসিডেন্ট নিকোলাস সারকোজি।
দুর্নীতির অভিযোগে থাইল্যান্ডের সাবেক প্রধানমন্ত্রী ইংলাক সিনাওয়াত্রার বিরুদ্ধে তার অনুপস্থিতিতে পাঁচ বছরের জেল দেওয়া হয়।
প্রতারণার অভিযোগে দুই বছর তিন মাসের কারাদণ্ড হয়েছিল ইসরায়েলের সাবেক প্রধানমন্ত্রী এহুদ ওলমার্টের। দুর্নীতির মামলায় ২০২০ সালে ১২ বছরের কারাদণ্ড হয় মালয়েশিয়ার সাবেক প্রধানমন্ত্রী নাজিব রাজাকের। দুর্নীতির মামলার তদন্তে সহযোগিতা না করায় দক্ষিণ আফ্রিকার সাবেক প্রেসিডেন্ট জ্যাকব জুমাকে ১৫ মাসের কারাদণ্ড দেওয়া হয়েছিল।
ক্ষমতা হারানোর পর বিচারের মুখোমুখি হওয়া প্রেসিডেন্ট ও প্রধানমন্ত্রীদের তালিকায় আরও আছেন—
ইতালির সাবেক প্রধানমন্ত্রী সিলভিও বার্লুসকোনি, ব্রাজিলের লুলা দা সিলভা (বর্তমানে তৃতীয়বারের মতো ক্ষমতায়) ও বলিভিয়ার সাবেক প্রেসিডেন্ট জিনাইন আনেজ।
মন্তব্য করুন