

চট্টগ্রামের সীতাকুণ্ডের শীতলপুরের বাসিন্দা মোহাম্মদ সেলিম। তার শিশুকন্যা নাদিয়া জান্নাত তাসকিয়া জ্বরে আক্রান্ত হয়। শুরুতে বাড়ির পাশের ওষুধের দোকান থেকে নাপা কিনে খাওয়ান। পরিস্থিতি খারাপ হতে শুরু করলে সীতাকুণ্ডের বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব ট্রপিক্যাল অ্যান্ড ইনফেকশাস ডিজিজেস (বিআইটিআইডি) হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। পরীক্ষা-নিরীক্ষার পর চিকিৎসকরা দেখেন, নাদিয়ার ফুসফুসে সংক্রমণ হয়েছে, শ্বাসকষ্টও ছিল। এরপর তাকে মেডিকেল সেন্টারে ভর্তি করে এনআইসিইউতে রাখা হয়। সেখানে ছয় দিন ছিল নাদিয়া। মেডিকেল সেন্টার থেকে জানানো হয়, তাদের চেষ্টা সব ব্যর্থ। তখন নাদিয়াকে চট্টগ্রাম এভারকেয়ারে নিয়ে যান বাবা। সেখানে চিকিৎসাধীন অবস্থায় ১১ নভেম্বর নাদিয়া মারা যায়।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের তথ্যমতে, চলতি বছরের শুরু থেকে গতকাল পর্যন্ত ডেঙ্গুতে ৩৯৪ জন মারা গেছেন। তার মধ্যে এক দিন থেকে ১৫ বছরের শিশু মারা গেছে ৭০ জন। আর রোগটি নিয়ে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছে ১৫ হাজার ৯৬১ শিশু। ডেঙ্গুতে এ বছর মোট মৃত্যুর ১৭ দশমিক ৭৬ শতাংশ শিশু। তার মধ্যে পাঁচ বছরের কম বয়সী শিশু ডেঙ্গু নিয়ে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছে ৫ হাজার ৫১৪ জন। মারা গেছে ২১ জন। ৬ থেকে ১০ বছর বয়সী ৪ হাজার ৭৭৮ জন শিশু রোগটি নিয়ে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছে আর মারা গেছে ১৪ জন। ১১ থেকে ১৫ বছর বয়সী ৫ হাজার ৬৬৯ জন শিশু ডেঙ্গু নিয়ে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছে আর তাদের মধ্যে মারা গেছে ৩৫ জন। গত বছর ডেঙ্গুতে মোট মৃত্যুর সংখ্যা ছিল ৫৭৫, যার মধ্যে শিশু ছিল ৬৪ জন।
রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের (আইইডিসিআর) উপদেষ্টা ও জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ ডা. মুশতাক হোসেন বলেন, নভেম্বরে এডিস মশার বিস্তার যতটা কমবে ধারণা করা হয়েছিল সেই অনুপাতে কমেনি। ফলে ডেঙ্গুতে আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা বেড়েছে। ডেঙ্গুর প্রকোপ কমাতে এডিস মশা নির্মূলের বিকল্প নেই। তবে, আমরা এখনো সেই কাজটি সঠিকভাবে করতে পারিনি। ফল ডেঙ্গুতে মৃত্যু ঠেকানো যাচ্ছে না। অথচ এই মৃত্যু ঠেকানো সম্ভব। ডেঙ্গুতে মৌসুমি রোগ ভেবে হালকা করে দেখার সময় শেষ।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের তথ্যমতে, চলতি বছরের ১ জানুয়ারি থেকে গতকাল পর্যন্ত ডেঙ্গু জ্বর নিয়ে ৯৬ হাজার ৮২৭ জন রাজধানীসহ সারা দেশের বিভিন্ন হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন। তার মধ্যে ৬২ দশমিক ৪ শতাংশ পুরুষ এবং ৩৭ দশমিক ৬ শতাংশ নারী এ সময় ডেঙ্গুতে মারা গেছেন। এর মধ্যে চলতি মাসে মারা গেছেন ১২ জন। গত মাসে মারা গেছেন ১০৪ জন। গত অক্টোবর মাসে মৃত্যু হয়েছে ৮০ জনের। আর সেপ্টেম্বরে ৭৬ জনের মৃত্যু হয়েছিল। এ ছাড়া জানুয়ারিতে ১০, ফেব্রুয়ারিতে তিনজনের মৃত্যু হয়েছে। মার্চ ছিল মৃত্যুহীন। এপ্রিলে ৭, মে মাসে তিনজনের মৃত্যু হলেও বাড়তে থাকে জুন মাস থেকে। জুনে ডেঙ্গুতে ১৯ জনের মৃত্যু হয়। জুলাইয়ে সেই সংখ্যা গিয়ে দাঁড়ায় ৪১-এ। আর আগস্টে মৃত্যু ছিল ৩৯ জনের।
২০০০ সালে ঢাকায় ডেঙ্গুর প্রকোপ দেখা দেয়। ওই বছর ৫ হাজার ৫৫১ জন মানুষের শরীরে ডেঙ্গু শনাক্ত হয়। ওই বছর মারা যান ৯৩ জন। ঘটনাটি সাধারণ মানুষের কাছে নতুন ছিল। দেশে ডেঙ্গুর ভয়াবহতা প্রকট আকার নেয় ২০১৯ সালে। ওই বছর এক লাখেরও বেশি মানুষ আক্রান্ত হয় এবং মৃত্যুর সংখ্যা দাঁড়ায় ১৭৯ জনে। যা তখন পর্যন্ত ছিল সর্বোচ্চ। তবে চার বছর পর ২০২৩ সালে পরিস্থিতি আরও ভয়াবহ রূপ নেয়। ইতিহাসের সর্বাধিক সংক্রমণ ও মৃত্যুর রেকর্ড তৈরি হয় সে বছর, যা দেশের স্বাস্থ্য ব্যবস্থার জন্য বড় সতর্ক সংকেত হিসেবে চিহ্নিত হয়। ডেঙ্গুতে সবচেয়ে বেশি মানুষ শনাক্ত ও মারা যায় ২০২৩ সালে। সে বছর রোগটি শনাক্ত হয়েছিল তিন লাখের বেশি মানুষ, তার মধ্যে মারা যায় ১ হাজার ৭০৫ জন। এদিকে, গত বছর জানুয়ারি থেকে ৩১ ডিসেম্বর পর্যন্ত ডেঙ্গু নিয়ে ১ লাখ ১ হাজার ২১৪ জন সারা দেশের বিভিন্ন হাসপাতালে ভর্তি হন। এ সময় মারা যান ৫৭৫ জন।
মন্তব্য করুন