বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান মীর মোহাম্মদ নাসির উদ্দিন ও তার ছেলে ব্যারিস্টার মীর হেলাল উদ্দিনের বিরুদ্ধে চট্টগ্রামের হাটহাজারীর শ্রীশ্রী পুণ্ডরীক ধামের জায়গা জবরদখলের অভিযোগ উঠেছে। এ বিষয়ে গতকাল রোববার সংবাদ সম্মেলন করেছে আন্তর্জাতিক কৃষ্ণভাবনামৃত সংঘ (ইসকন) বাংলাদেশ। এতে লিখিত বক্তব্য পাঠ করেন সংগঠনটির সাধারণ সম্পাদক শ্রীপাদ চারু চন্দ্র দাস ব্রহ্মচারী।
সেইসঙ্গে ধামের সাধু-সন্ন্যাসীদের প্রাণনাশের হুমকিও দেওয়া হচ্ছে বলে দাবি করেন চারু চন্দ্র দাস ব্রহ্মচারী। চট্টগ্রাম প্রেস ক্লাবে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে তিনি বলেন, ‘বিএনপি নেতা মীর নাসির ও মীর হেলালের কথায় সন্ত্রাসী ও এলাকার কিছু গুন্ডাবাহিনী হুমকি দিচ্ছে, যে কারণে সম্প্রীতির হাটহাজারীতে অশান্তির বিষবাষ্প ছড়িয়ে পড়ছে। হিন্দু তীর্থক্ষেত্র পুণ্ডরীক ধামের জমিতে কেন দুই বিএনপি নেতার লোলুপদৃষ্টি পড়েছে, তা বোধগম্য নয়!’ চারু চন্দ্র দাস ব্রহ্মচারী বলেন, ‘হুমকি-ধমকিতে ধামের সাধুরা নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছেন। সাধু-সন্ন্যাসীদের চরিত্র হনন, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম হ্যাক করে ধর্মীয় সম্প্রীতি বিনষ্ট করাসহ বিভিন্ন অপতৎপরতায় শ্রীধামের ক্ষতিসাধনে তৎপর রয়েছেন সন্ত্রাসীরা।’
তবে বিএনপির নির্বাহী কমিটির সদস্য মীর হেলাল কালবেলাকে বলেন, ইসকনের অভিযোগ শতভাগ মিথ্যা। এসব জাতীয় নির্বাচন সামনে রেখে রাজনীতির মাঠে পানি ঘোলা করার অপচেষ্টা। আদালতে বিচারাধীন বিষয়ে সংবাদ সম্মেলন করা বিচার প্রক্রিয়াকে প্রভাবিত করার শামিল।’
অভিযুক্ত দুই বিএনপি নেতাকে সতর্ক হওয়ার আহ্বান জানিয়ে ইসকনের সংবাদ সম্মেলনে বলা হয়, এর মধ্যে তারা যদি সতর্ক না হন এবং পুণ্ডরীক ধামের জায়গা দখলের চেষ্টা করেন কিংবা কোনো রকম ষড়যন্ত্র করেন; তাহলে হিন্দুরা রাস্তায় নামতে বাধ্য হবে। শুধু দেশে নয়, পৃথিবীর বিভিন্ন
প্রান্তের হিন্দুরা এই পবিত্রভূমি রক্ষায় মাঠে নামবে। সারাবিশ্বের হিন্দুদের কাছে এই ধাম অতিপবিত্র।
সংবাদ সম্মেলন থেকে অবিলম্বে পুন্ডরীক ধাম নিয়ে ষড়যন্ত্র বন্ধ করার কার্যকর পদক্ষেপ নিতে প্রধানমন্ত্রী, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী, ভূমিমন্ত্রী, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীসহ সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের কাছে আবেদন জানানো হয়। এ ছাড়া ইসকনের পক্ষ থেকে আরও সাত দফা দাবি জানানো হয়। এর মধ্যে রয়েছে সিএস ও আরএস খতিয়ানের রেকর্ড অনুযায়ী পুন্ডরীক ধামের জায়গায় অবৈধ অনুপ্রবেশ প্রতিরোধে কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ। লক্ষ্মী জনার্দন সরোবর ঘিরে স্থিত চলাচলের পথে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টির চেষ্টা প্রতিহত করা। শ্রীধাম অধ্যক্ষ ও ব্রহ্মচারী-সন্ন্যাসীদের বিরুদ্ধে দায়ের করা মিথ্যা মামলা প্রত্যাহার। ধামের সম্পত্তি জবরদখলের
চেষ্টাকারী বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান মীর নাসির ও মীর হেলালকে আইনের আওতায় আনা। সনাতন পবিত্র ভূমি পুণ্ডরীক ধামের মালিকানাধীন সব জায়গা-সম্পত্তি নিরাপত্তার সঙ্গে সংরক্ষণের ব্যবস্থা গ্রহণ। দেশের সব দেবোত্তর সম্পত্তি পুনরুদ্ধার, সংরক্ষণ ও উন্নয়ন আইন বাস্তবায়ন এবং পুণ্ডরীক ধাম ও ধামের যাবতীয় সহায়-সম্পত্তি, সাধু-সন্ন্যাসীদের পরিপূর্ণ সুরক্ষা প্রদানের জন্য প্রয়োজনীয় কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ।
ইসকনের সাধারণ সম্পাদক শ্রীপাদ চারু চন্দ্র দাস ব্রহ্মচারী বলেন, সুপ্রাচীনকাল থেকে সনাতনী সমাজের প্রাণপুরুষ ভগবান শ্রীকৃষ্ণের যুগলসরূপ শ্রীশ্রী লক্ষ্মী জনার্দন বিগ্রহ প্রতিষ্ঠিত ছিল, যা ভগবান শ্রীকৃষ্ণের নিত্য শক্কি শ্রীমতী রাধারানীর পিতা কলিকালে বৃষভানু অবতার শ্রীল পুণ্ডরীক বিদ্যানিধির সেবিত, যে পবিত্র ভূমি শ্রীল পুণ্ডরীক বিদ্যানিধির জন্মস্থান। ওই বিগ্রহের তদনীন্তন সেবায়েত ছিলেন হর কুমার স্মৃতি তীর্থ, তার নাম আর এস খতিয়ানে লক্ষ্মী জনার্দন বিগ্রহের পক্ষে সেবায়েত হিসেবে লিপি আছে, যা চিরস্থায়ী দেবোত্তর সম্পত্তি হিসেবে উল্লেখ রয়েছে। ওই বিগ্রহ এস্টেস্ট জাতীয় ও আন্তর্জাতিকভাবে পুণ্ডরীক ধাম নামে পরিচিত।
হাটহাজারী শ্রীশ্রী পুণ্ডরীক ধামের অধ্যক্ষ চিণ্ময় কৃষ্ণ দাস ব্রহ্মচারী বলেন, এ স্থানটি ঐতিহাসিকভাবে ভগবান শ্রীচৈতন্য দেবের প্রধান পার্ষদের অপ্রাকৃত লীলাভূমি। ধর্মীয়ভাবে প্রসিদ্ধ এবং ঐতিহাসিকভাবে স্বীকৃত। পুণ্ডরীক ধামে দৈনন্দিন পূজা-অর্চনা, বার্ষিক নির্ধারিত তিথিতে অন্নকূট উৎসব, রাধাষ্টমী, বসন্ত পঞ্চমী, রথযাত্রা, জন্মাষ্টমী, ঝুলন, চন্দন যায়, নৌ-বিহার, দোল পূর্ণিমা অনুষ্ঠিত হয়। পুণ্ডরীক ধামে হাজারো দেশি-বিদেশি ভক্ত প্রতিনিয়ত আসা-যাওয়া করেন, যা উপমহাদেশের মধ্যে অত্যন্ত প্রসিদ্ধ একটি ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান হয়। বিগ্রহ মন্দির তথা ধাম ৫৫০ বছরের অধিককাল ধরে স্থিত আছে। সেখানে ৫৫০ বছরের অধিক পুরোনো ভজন কুঠির এখনো আছে। তা ছাড়া পুণ্ডরীক ধাম এলাকায় মূল ফটকের বাইরের দিকে পশ্চিম পাশে ধামের ৩ তলা বিশিষ্ট ভবনসংলগ্ন ঐতিহ্যবাহী ও পবিত্র সাধনকূপ নামে খ্যাত লক্ষ্মী জনার্দন সরোবর এবং ধামের অভ্যন্তরীণ চলাচলের জন্য সরোবর ঘিরে সুপ্রশস্থ চলাচলের পথ আছে। ওই ৩৮ শতক পরিমাপের চলাচলের পথ ও ১২১ শতক পরিমাপের দুটি পুকুর, যা সম্মিলিতভাবে ‘লক্ষ্মী জনার্দন সরোবর’ নামে পরিচিত। ওই দুটি পুকুর ও চলাচলের রাস্তা আর এস খতিয়ানের মালিকানা কলামে এককভাবে শ্রীশ্রী লক্ষ্মী জনার্দন বিগ্রহ তৎপক্ষে সেবায়েত হর কুমার স্মৃতি তীরের নামে আর এস জরিপ চূড়ান্ত রেকর্ড ও প্রচার আছে, যা চিরস্থায়ী দেবোত্তর সম্পত্তি হিসেবে স্থানীয় সব জনসাধারণ অবগত।
সংবাদ সম্মেলনে বলা হয়, এই বিগ্রহের সংশ্লিষ্ট সেবায়েত ও পরিচালনার দায়িত্বে নিয়োজিত ব্যক্তিরা পূজা-অর্চনা, ধর্মীয় পূজা পার্বণ ও বাৎসরিক উৎসবাদি নিয়া ব্যস্ত থাকেন। জায়গা জমির জরিপ ইত্যাদি সম্পর্কে তাদের কোনো বাস্তব জ্ঞান ছিল না। জমির জরিপ কাজ সম্পর্কে তারা কখনো দৃষ্টিপাত করেননি। জনার্দন বিগ্রহের নামের যাবতীয় সহায়-সম্পত্তিতে সেবায়েত পরম্পরা সবাই স্মরণাতীত কাল থেকে শান্তিপূর্ণভাবে, নির্বিঘ্নে, নিরবচ্ছিন্নভাবে ভোগদখলে আছেন। কিন্তু সম্প্রতি বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান মীর নাসির উদ্দিন ও তার ছেলে বিএনপির কেন্দ্রীয় সদস্য মীর হেলাল বিভিন্ন সময়ে বি এস খতিয়ানে তাদের নাম আছে বলে দাবি করেন এবং স্বত্ব পাবেন মর্মে হাঁকাবকা করতে থাকেন।
চিণ্ময় কৃষ্ণ দাস ব্রহ্মচারী অভিযোগ করেন, তাদের হুমকির ধারাবাহিকতায় একপর্যায়ে ১০-১৫ জন অজ্ঞাত সন্ত্রাসী প্রকৃতির লোকজন পথভূমিতে পাকা দেয়াল নির্মাণের চেষ্টা করেন। পরে ধাম কর্তৃপক্ষ ও স্থানীয় লোকজন বাধা দেন। এ সময় তারা ধামে বসবাসকারী ও আগতদের রাস্তা দিয়া চলাচল করতে না দেওয়ার হুমকি ও রাস্তা জবরদখলে বাধা দিলে হত্যা করা হবে বলেও হুমকি দেন। তিনি বলেন, জোরপূর্বক দখলে সফল না হওয়ায় ধামের অধ্যক্ষ ও ব্যবস্থাপনার দায়িত্বে নিয়োজিত সন্ন্যাসীদের বিরুদ্ধে হয়রানিমূলক মিথ্যা ফৌজদারি মামলা করেছে ওই অপশক্তি, যাতে রথযাত্রা উৎসবসহ বিশাল এই ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানের সামগ্রিক কার্যক্রম ব্যাহত হয়, নেতৃত্বশূন্য হয়।
সংবাদ সম্মেলনে শ্রীশ্রী কৈবল্য ধামের মোহন্ত মহারাজ শ্রীমৎ কালীপদ ভট্টাচার্য্য, ইসকন প্রবর্তক শ্রীকৃষ্ণ মন্দিরের অধ্যক্ষ লীলারাজ গৌর দাস ব্রহ্মচারী, চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের কাউন্সিলর জহর লাল হাজারী ও নীলু নাগ, বাংলাদেশ জন্মাষ্টমী উদযাপন পরিষদের সাবেক সাধারণ সম্পাদক চন্দন তালুকদার ও চট্টগ্রাম মহানগর স্বেচ্ছাসেবক লীগের সভাপতি দেবাশীষ নাথ দেবুসহ হিন্দু সম্প্রদায়ের নেতারা উপস্থিত ছিলেন।
মীর হেলালের বক্তব্য : অভিযোগ প্রসঙ্গে ব্যারিস্টার মীর হেলাল কালবেলাকে বলেন, ‘ইসকনের অভিযোগ শতভাগ মিথ্যা। আলোচিত জায়গা মীর আহমেদ সওদাগর নামে এক ব্যক্তি জমির মালিক থেকে কিনেছেন ১৯৫১ সালে। তার কাছ থেকে আমার আম্মা কিনেছেন
১৯৯২-৯৩ সালে। প্রায় ৭২ বছর ধরে ওই জায়গা নিষ্কণ্টক হিসেবে আছে। আর আমরাও শান্তিপূর্ণভাবে ভোগদখল করে আসছি কেনার পর থেকে।’
সম্প্রতি ইসকনের সরব হওয়াকে আসন্ন নির্বাচন সামনে রেখে রাজনীতির মাঠে হঠাৎ পানি ঘোলা করার অপচেষ্টা উল্লেখ করে মীর হেলাল বলেন, ‘গত মার্চ মাসে ধাম কর্তৃপক্ষ এ ব্যাপারে একটি মামলা দায়ের করে, যা নিয়ে আদালত উপজেলা সহকারী কমিশনার
(ভূমি)-এর কাছ থেকে তদন্ত প্রতিবেদন চান। ওই তদন্ত প্রতিবেদনেও পরিষ্কারভাবে লেখা আছে, ৩০ বছরের অধিক সময় ধরে আমার আম্মা ওই জায়গার শান্তিপূর্ণ দখলে ছিলেন এবং পুরো জায়গা ঘিরে একটি ১০ ফুট উচ্চতার বাউন্ডারি দেয়াল ছিল। যার কারণে সেই মামলাও খারিজ হয়ে যায়; (মামলা নং ২২৯/২০২৩)।’
বিএনপির কেন্দ্রীয় কমিটির নির্বাহী সদস্য মীর হেলাল বলেন, ‘আমরা সবসময় আইনের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। আইন কখনো নিজ হাতে তুলে নিইনি, যেমনটা ধাম কর্তৃপক্ষ করেছে। তারা আমার আম্মার নির্মিত ৩০ বছর পুরোনো দেয়াল ভেঙে ফেলেছেন এবং অনেক গাছ যেগুলো আম্মা নিজ হাতে রোপণ করেছিলেন, সেগুলোও কেটে ফেলেছেন, যা সম্পূর্ণ বেআইনি এবং খুবই দুঃখজনক।’
মন্তব্য করুন