

সিলেটকে বলা হয় দ্বিতীয় লন্ডন। যুক্তরাজ্যে সিলেট প্রবাসীদের আধিক্যের কারণেই এ তকমা। বর্তমানে শুধু যুক্তরাজ্যেই নয়, বিশ্বের অন্যান্য দেশের প্রতিও আগ্রহী হয়ে উঠছেন সিলেটের তরুণরা। তাদের কেউ যাচ্ছেন উচ্চশিক্ষার জন্য, কেউ যাচ্ছেন কাজের ভিসায়। স্বপ্নের বিদেশযাত্রায় বিভোর শিক্ষার্থীরা কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্লাস রেখে সকাল-বিকেল দৌড়াচ্ছেন আইইএলটিএস সেন্টারে।
কয়েক বছর ধরে যুক্তরাজ্য ছাড়াও যুক্তরাষ্ট্র, কানাডা, অস্ট্রেলিয়া, হাঙ্গেরি, ইতালি, রোমানিয়া, সাইপ্রাস, ক্রোয়েশিয়া, গ্রিস, ফ্রান্স, পর্তুগাল, মাল্টাসহ বিভিন্ন দেশে পাড়ি জমাচ্ছেন তরুণরা। শিক্ষার্থীদের জন্য উন্নত দেশগুলোর ভিসা নীতি কিছুটা নমনীয় হওয়ায় সে সুযোগ কাজে লাগিয়ে তারা দেশ ছাড়ছেন। ইউরোপ-আমেরিকায় যেতে না পারলেও অনেকেই পাড়ি জমাচ্ছেন মধ্যপ্রাচ্যে।
তরুণদের এ বিদেশমুখিতার কারণে দেশে মেধা সংকটের আশঙ্কা করছেন অনেকে। আবার ভবিষ্যতে তারা রেমিট্যান্স পাঠিয়ে দেশের অর্থনীতিতে ভূমিকা রাখার সম্ভাবনার কথাও উঠে আসছে আলোচনায়।
এক হিসাবে দেখা গেছে, গত পাঁচ বছরে সিলেট থেকে ১০ হাজার শিক্ষার্থী উচ্চশিক্ষার জন্য বিভিন্ন দেশে পাড়ি জমিয়েছেন। শিক্ষার্থীরা পাড়ি দেওয়ার পর তার বাবা-মাসহ পুরো পরিবার চলে যাচ্ছে বিদেশে।
এদিকে বিভিন্ন ভিসা প্রসেসিং এজেন্সির কাছে পাসপোর্ট, ডকুমেন্টস ও লাখ লাখ টাকা দিয়ে মাসের পর মাস কেটে গেলেও অনেক তরুণ ভিসা পাননি। এতে করে তারা হতাশায় ভুগছেন।
আবার অনেকে স্বপ্নের দেশে যাওয়ার পরও হতাশ হন। উচ্চ টিউশন ফি পরিশোধ, আবাসন সমস্যা, কাজের সুযোগ না পেয়ে নিদারুণ কষ্টে রয়েছেন সিলেটের বহু তরুণ। তবুও কমছে না ভিএফএস গ্লোবালের সিলেট অফিস ও সিলেট বিভাগীয় পাসপোর্ট অফিসের সামনে বিদেশ গমনেচ্ছুদের লম্বা লাইন।
সম্প্রতি সিলেট থেকে কানাডা ও পর্তুগাল যাওয়ার প্রবণতা বেড়েছে। কানাডার ভিজিট ভিসা এখন আগের তুলনায় অনেক সহজেই মিলছে বলে জানিয়েছে ভিসা প্রসেসিং প্রতিষ্ঠানগুলো। এ ছাড়া পাসপোর্টের মেয়াদ পর্যন্ত মিলছে ভিসা। এ সুযোগ কাজে লাগাতে সিলেটের তরুণরা এখন অনেকটা হুমড়ি খেয়ে পড়ছেন কানাডার ভিজিট ভিসা আবেদনে। সিলেট নগরীর একটি ভিসা প্রসেসিং প্রতিষ্ঠানের পরিচালক জানান, এখন কানাডার ভিসা ইস্যুর হার অনেক বেশি। প্রতিদিনই অনেকের ভিসা হচ্ছে। অনেকে পরিবারসহ ভিজিট ভিসা পাচ্ছেন। এর আগে কানাডার ভিজিট ভিসা ইস্যুর হার এত বেশি ছিল না।
বিদেশমুখিতার কারণ: সিলেটে বিদেশমুখিতার ক্ষেত্রে মূলত পরিবারের অসচ্ছলতা নিরসন, সমাজে মাথা উঁচু করে বাঁচার তাগিদ ও ভবিষ্যৎ স্বপ্নপূরণ করতে অগ্রণী ভূমিকা পালন করছে। এর মধ্যে কেউ কেউ যান ম্যারেজ ভিসায়। আজকাল ছেলেদের পাশাপাশি মেয়েদেরও প্রবাসে পাড়ি দেওয়ার প্রবণতা বাড়ছে। তারা যাচ্ছেন স্টুডেন্ট ভিসা কিংবা ম্যারেজ ভিসায়।
অন্যদিকে, বিদেশের রঙিন স্বপ্নে বিভোর বহু তরুণের স্বপ্নভঙ্গ হয়েছে প্রতারণার ফাঁদে পড়ে। ব্যাঙের ছাতার মতো সিলেট নগরীতে গড়ে ওঠা শতাধিক ভুঁইফোঁড় এজেন্সির খপ্পরে পড়ে অর্থ ও মূল্যবান সময় খুইয়েছেন অনেক তরুণ।
সিলেটের নাগরিক আন্দোলনের অন্যতম সংগঠক আব্দুল করিম কিম কালবেলাকে বলেন, পরিবারের আগ্রহেই সিলেটের শিক্ষার্থীরা বিদেশমুখী হচ্ছেন। পরিবারের এমন আগ্রহের কারণ হচ্ছে দেশে সন্তানের কোনো উজ্জ্বল ভবিষ্যৎ নেই—এমন ন্যারেটিভ তৈরি হওয়া। এখানে স্বল্পশিক্ষিত সন্তানের ভবিষ্যৎ নিয়ে মা-বাবা যেমন হতাশ, তেমনি মেধাবী সন্তানের ভবিষ্যৎ নিয়েও আশাবাদী হতে পারছেন না তারা। পরিবারের প্রবাসী আত্মীয়স্বজনরা দেশে থাকা মেধাবী শিক্ষার্থীদের বিদেশমুখী হতে উৎসাহ দিয়ে থাকেন।
তরুণদের বিদেশমুখিতার প্রবণতা প্রসঙ্গে নর্থ ইস্ট ইউনিভার্সিটি বাংলাদেশের পরীক্ষা নিয়ন্ত্রক, প্রবীণ সাংবাদিক লিয়াকত শাহ ফরিদী কালবেলাকে বলেন, উচ্চশিক্ষার জন্য মেধাবীরা বিদেশ চলে যাচ্ছে, দিন দিন এ প্রবণতা বাড়ছেই। এতে দেশ থেকে মেধা পাচার হচ্ছে। এই মেধাবীদের অনেকেই পড়ালেখা শেষ করে আর দেশে ফিরছে না। আমরা কাঙ্ক্ষিত মানের উচ্চশিক্ষা নিশ্চিত করতে পারলে হয়তো বিদেশমুখিতার সংখ্যা কমত। তবে যারা কাজের ভিসায় বাইরে যাচ্ছেন, তারা একসময় দেশে রেমিট্যান্স পাঠাবেন। এতে আমাদের অর্থনীতি উপকৃত হবে, এটাও সত্যি।
শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিসংখ্যান বিভাগের অধ্যাপক খালেদুর রহমান কালবেলাকে বলেন, এটা এক ধরনের ডেমোস্ট্রেশন ইফেক্ট বা অন্যকে দেখে প্রভাবিত হওয়া। উদাহরণস্বরূপ, যখন বাইরে থেকে কেউ আসেন, তিনি ওখানে কী কাজ করেন সেটা বিষয় নয়। কিন্তু তিনি যতদিন দেশে থেকে বিলাসী জীবনযাপন করেন, সেটা যখন বাচ্চারা দেখে, সে এর দ্বারা প্রভাবিত হয়। ফলে সে তখন চায় তার মতো হতে। এভাবে পাশের বাড়ির বা আত্মীয়ের দ্বারা প্রভাবিত হয়। আমাদের সিলেট অঞ্চলের যারা বাইরে থাকেন, তাদের সামাজিকভাবেও বাড়তি মর্যাদা দেওয়া হয়। এগুলো তাদের প্রভাবিত করে। কয়েক জেনারেশন ধরে এটা চলে আসায় এটাই করছে। এটাই হচ্ছে মূল কারণ।
সিলেট কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের কৃষি অনুষদের চেয়ারম্যান অধ্যাপক মোজাম্মেল হক বলেন, বাংলাদেশের যে কোনো এলাকা থেকে সিলেটে বিদেশে যাওয়ার প্রবণতা বেশি। আমাদের দেশের আর্থসামাজিক বা রাজনৈতিক পরিস্থিতি বিবেচনায় শিক্ষার্থীরা একটু বিব্রত বা হতাশ। এখানে তাদের মেধা ও যোগ্যতার যথাযথ মূল্যায়ন অনেক ক্ষেত্রে পাচ্ছেন না। আমাদের কাজের পরিবেশ বা সামাজিক নিরাপত্তা নিয়েও তারা ভীত। এসব বিষয়ই তাদের বিদেশমুখী করে তুলছে।
সিলেট সরকারি মহিলা কলেজের সাবেক অধ্যক্ষ, শিক্ষাবিদ অধ্যাপক হায়াতুল ইসলাম আকঞ্জি বলেন, আমাদের শিক্ষার্থীরা দেশের পড়াশোনা মূল্যায়ন করতে চায় না। কারণ অনার্স-মাস্টার্স শেষ করে চাকরি পায় না তারা। ফলে পড়াশোনার প্রতি তাদের আকর্ষণ কমে গেছে। এইচএসসির পর মোটামুটি একটা রেজাল্ট করলেই আইইএলটিএসে ভর্তি হয়ে ৫ বা ৫.৫ রেজাল্ট করতে পারলেই যে কোনো দেশে চলে যেতে চায়। এর মূল কারণই হচ্ছে পছন্দমতো চাকরি না পাওয়ায় বেকারত্ব বেড়ে যাওয়া।
তিনি বলেন, এ সমস্যা থেকে উত্তরণের জন্য আমাদের অভিভাবকদের সচেতন হতে হবে। বাচ্চাদের সঠিক গাইডলাইন দিয়ে পড়াশোনা করাতে হবে। উদাসীনতা না দেখিয়ে দায়সারা পড়াশোনা করানো বন্ধ করতে হবে। পাশাপাশি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানকে সচেতন ও আন্তরিক হতে হবে।
মেট্রোপলিটন ইউনিভার্সিটির উপাচার্য ড. মোহাম্মদ জহিরুল হক কালবেলাকে বলেন, বিশ্বায়নের যুগে সারা বিশ্বে মেধাবীরা লেখাপড়া করবে, তাদের ক্যারিয়ার গড়বে এটাই স্বাভাবিক। এক যুগ আগেও সাধারণত পোস্ট গ্র্যাজুয়েট প্রোগ্রামে আমাদের শিক্ষার্থীরা বিদেশ যেত। সাম্প্রতিককালে উচ্চ মাধ্যমিক পাস করেই শিক্ষার্থীদের একটা বিশেষ অংশ বিদেশ চলে যাচ্ছে। সম্ভাবনাময় এসব শিক্ষার্থী মেডিকেল, প্রকৌশল ও বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি পরীক্ষায় অংশগ্রহণ না করে আইইএলটিএস দিচ্ছে। ইউরোপ যাত্রা হয়ে যায় তাদের স্বপ্ন। অধ্যাপক জহিরুল মনে করেন, শুধু অভিবাসন সামনে রেখে যেনতেনভাবে একটি ক্যারিয়ার গড়ার উদ্দেশ্যে বিদেশ যাওয়াটা দুঃখজনক।
শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় উপ-উপাচার্য অধ্যাপক সাজেদুল করিম বলেন, সিলেটে আমাদের শিক্ষার্থী যারা ভালো রেজাল্ট করে তাদের নিয়ে আমাদের প্রত্যাশা থাকে গবেষণা করার। দেশে ওই ধরনের গবেষণার সুযোগ নেই। বাইরে যেতে পারলে গবেষণার ক্ষেত্র বেড়ে যায়। সে কারণে তারা আগ্রহ প্রকাশ করে। তারপর যোগ্যতা অনুযায়ী সেখানে চাকরি পাওয়ার একটা সম্ভাবনা থাকে। আবার অনেকে মনে করে, দেশে এত চ্যালেঞ্জ নিয়ে চাকরি করার চেয়ে বিদেশে থাকা ভালো।
সিলেট জেলা শিক্ষা কর্মকর্তা এস এম আবু সাঈদ মো. আব্দুল ওয়াদুদ বলেন, ‘এখন সবার একটা উচ্চাকাঙ্ক্ষা হচ্ছে জীবনযাত্রার মান উন্নত করা। আরেকটি কারণ হচ্ছে বেকারত্ব। অনেক শিক্ষার্থী মাস্টার্স পাস করেও যোগ্যতা অনুযায়ী চাকরি পায় না। এ কারণে অনেকে মনে করে, বিদেশে পড়াশোনা করলে উন্নত পরিবেশে শিক্ষা অর্জনের পাশাপাশি কর্মসংস্থানেরও ব্যবস্থা হবে। এসব বিবেচনায় তরুণরা বিদেশ চলে যাচ্ছে। এ ছাড়া অনেকে দেখছে পাশের বাড়ির কম পড়াশোনা করা অনেকে বিদেশে গিয়ে উন্নতমানের জীবনযাপন করছে। কিন্তু দেশে মাস্টার্স পাস করেও অনেকে বেকার। আবার অনেককে পিয়নের চাকরি করতে হয়। তাও সেই চাকরি পেতে অনেক কাঠখড় পোড়াতে হয়। এটি হচ্ছে অন্যতম কারণ।’
মন্তব্য করুন