বাংলা পঞ্জিকা অনুযায়ী প্রায় শেষের দিকে কার্তিক মাস। এরপর অগ্রহায়ণ, আর তারপরই আসবে পৌষ মাস অর্থাৎ শীত মৌসুম। দেশে সাধারণত শীতে গ্যাসের সংকট বাড়ে। তবে এবার আগেভাগেই রাজধানীসহ দেশের অনেক এলাকায় গ্যাস সংকট দেখা দিয়েছে। শিল্পকারখানা, সিএনজি স্টেশন, বাসাবাড়িসহ সব ক্ষেত্রেই গ্যাসের চাপ কমে গেছে। ফলে উৎপাদন কমে গেছে শিল্পকারখানায়, বাসাবাড়িতে হচ্ছে রান্নার সমস্যা, আর যানবাহনে সিএনজি সরবরাহ করতে না পারায় ক্ষতির সম্মুখীন হচ্ছেন ব্যবসায়ীরা। এমন পরিস্থিতিতে আসছে শীতে গ্যাস সংকট আরও প্রকট হবে বলে আশঙ্কা করছেন খাত-সংশ্লিষ্টরা।
পেট্রোবাংলার সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা বলছেন, প্রতিবছর শীত এলেই গ্যাসের সংকট দেখা দেয়। এ সময়টায় পাইপলাইনে গ্যাসের চাপ কমে যায়। তবে এবার সেই সংকট আরও প্রকট হবে। কারণ রাজধানীর অনেক এলাকায় এখনো মেয়াদোত্তীর্ণ পাইপলাইন রয়েছে। এসব এলাকায় গ্যাস সংকট হবেই। সেইসঙ্গে চলছে পাইপলাইন পরিবর্তনের কাজ। এ ছাড়া রক্ষণাবেক্ষণের জন্য গত ২ নভেম্বর দুটি এলএনজি টার্মিনালের মধ্যে একটি বন্ধ হয়ে গেছে। ফলে এখনই দৈনিক ৫০০ মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস কম সরবরাহ হচ্ছে। এসব কারণে আগামী ডিসেম্বরে গ্যাসের সংকট প্রকট আকার ধারণ করবে।
তবে এই শীতে গ্যাসের সংকট হলেও প্রকট হবে না বলে মনে করেন পেট্রোবাংলার পরিচালক (অপারেশন্স অ্যান্ড মাইন্স) প্রকৌশলী কামরুজ্জামান খান। কালবেলাকে তিনি বলেন, শীতে গ্যাসের চাহিদা বেড়ে যায়। তাই এ সময় গ্যাসের কিছুটা সংকট তৈরি হয়। তবে এ সময়টাতে বিদ্যুৎ উৎপাদনে গ্যাসের চাহিদা কমে যাওয়ায় এলএনজি টার্মিনাল বন্ধের কারণে গ্যাসের সরবরাহ যতটুকু কমেছে, তা বিদ্যুৎ উৎপাদনে সরবরাহ করা গ্যাস থেকে ভাগাভাগি করা হবে।
গতকাল বৃহস্পতিবার পেট্রোবাংলার দৈনিক গ্যাস উৎপাদন ও সরবরাহের চিত্রে দেখা গেছে, গতকাল এলএনজিসহ গ্যাসের মোট সরবরাহ ছিল ২ হাজার ৫৮৮ মিলিয়ন ঘনফুট। এর মধ্যে এলএনজি সরবরাহ ছিল ৪৯৫ মিলিয়ন ঘনফুট। এর বিপরীতে বিদ্যুৎ উৎপাদনে ২ হাজার ২৪০ মিলিয়ন ঘনফুট চাহিদার বিপরীতে সরবরাহ করা হয়েছে ৮৭৮ মিলিয়ন ঘনফুট। সার উৎপাদনে ৩২৯ মিলিয়ন ঘনফুটের বিপরীতে ১৩৭ মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস সরবরাহ করা হয়েছে। এ ছাড়া শিল্প, বাসাবাড়িতে গ্যাস সরবরাহ করা হয়েছে ১ হাজার ৪৪২ মিলিয়ন ঘনফুট।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, রাজধানীর মহাখালী, পল্লবী, কাফরুল, শেওড়াপাড়া, মিরপুর-১০, রায়েরবাগ, গ্রিন রোড, কলাবাগান, কাঁঠালবাগান, মগবাজার, মালিবাগ, রামপুরা, বাসাবো, আরামবাগ, লালবাগ, যাত্রাবাড়ী, পোস্তগোলা ও উত্তরা এলাকার বাসাবাড়িতে ধীরে ধীরে গ্যাসের সংকট প্রকট হচ্ছে। এখনই কোনো এলাকায় ভোর থেকে, আবার কোনো এলাকায় সকাল ৮টার পর থেকে গ্যাসের চাপ একেবারেই কমে যায়।
কাঁঠালবাগানের বাসিন্দা প্রদীপ রায় বলেন, শীতে সব সময়ই এখানে গ্যাসের সংকট দেখা দেয়। কিন্তু এবার আগেভাগেই গ্যাস সংকট হচ্ছে। এখন ভোর থেকেই গ্যাসের চাপ কমতে থাকে। সকাল ৮টার পর চাপ একেবারেই থাকে না বললেই চলে। এমন অভিযোগ বিভিন্ন এলাকার বাসিন্দাদের কাছ থেকে পাওয়া গেছে।
রাজধানীর আশপাশের গাজীপুর, টঙ্গী, সাভার, আশুলিয়া, রূপগজ্ঞ ও নারায়ণগঞ্জের একাধিক গার্মেন্টস মালিকের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, দেশের সবচেয়ে বেশি গার্মেন্টস কারখানা রয়েছে এসব এলাকায়। রয়েছে ইস্পাত, সিমেন্ট ও কাচ কারখানাও। এসব ভারী কারখানায় উৎপাদন সচল রাখতে সার্বক্ষণিক গ্যাসের প্রয়োজন। গ্যাসের সরবরাহ ও চাপ কমে যাওয়ায় এসব এলাকার উৎপাদন অনেকটা কমে গেছে।
সাভারের আলমি গার্মেন্টেসের ম্যানেজার অলি উল্লাহ মজুমদার জানান, তার গার্মেন্টেসে গতকাল (বৃহস্পতিবার) সকাল ৯টার পর থেকে গ্যাসের চাপ একেবারেই কমে যায়। এতে উৎপাদন বন্ধ করে দিতে হয়েছে। পরে দুপুরে চাপ কিছুটা স্বাভাবিক হলে স্বল্প পরিসরে উৎপাদন শুরু হয়। এক সপ্তাহ ধরে এমন পরিস্থিতির মধ্য দিয়ে যাচ্ছেন বলেও জানান তিনি।
এ প্রসঙ্গে বিকেএমইএ সহসভাপতি ফজলে শামীম এহসান বলেন, আমরা সব সময়ই সরকারকে গ্যাস সংকটের কথা বলে আসছি। গ্যাসের অভাবে অনেক কারখানায় উৎপাদন অর্ধেকে নেমে এসেছে। ফার্নেস অয়েল ব্যবহার করে কারখানা চালাতে হচ্ছে। এতে উৎপাদন খরচ অনেক বেড়ে যায়। তিনি হতাশা প্রকাশ করে বলেন, এভাবে আর কতদিন চলবে কারখানাগুলো!
এদিকে, তিতাস গ্যাসের এক কর্মকর্তা জানান, আমরা তো গ্যাস উৎপাদন করি না। পেট্রোবাংলা আমাদের যতটুকু গ্যাস সরবরাহ করে, তা গ্রাহকদের মধ্যে বণ্টন করি। এখন আমরা চাহিদার বিপরীতে গ্যাস কম পাচ্ছি। তাই অনেক এলাকায় সংকট দেখা দিচ্ছে। এ ছাড়া পাইপলাইনের সমস্যার কারণেও কোনো কোনো এলাকায় গ্যাসের সমস্যা হচ্ছে। এজন্য প্রতিদিন অনেক অভিযোগ পাচ্ছি। সেগুলোর সমাধানের চেষ্টাও করছি।