রাজধানী ঢাকার উপকণ্ঠ কেরানীগঞ্জ। দীর্ঘকাল ধরেই দেশের অন্যতম প্রধান বাণিজ্য কেন্দ্র। যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নয়ন এবং বিপুলসংখ্যক আবাসন প্রকল্পের কারণে দিন দিন আরও জমজমাট হচ্ছে উপজেলার প্রতিটি এলাকা। বিস্তৃত হচ্ছে ব্যবসা প্রতিষ্ঠান, গড়ে উঠছে নতুন নতুন স্থাপনা। প্রতিনিয়ত চলছে জমি বেচাকেনা। তবে একটি বিশেষ গোষ্ঠীকে কমিশন না দিয়ে এর কোনোটাই করা যায় না। আর্থিক লেনদেনের বিষয় থাকলেই ওই গোষ্ঠীকে তাদের দাবিমতো চাঁদা দিতে হয়। কেউ অস্বীকৃতি জানালেই নেমে আসে নির্যাতনের খড়্গ। বাসাবাড়িতে ঢুকে মারধর করে হাতিয়ে নেওয়া হয় স্বর্ণালংকার, নগদ টাকাসহ দামি মালপত্র। অস্ত্রের মুখে নারীদের শ্লীলতাহানি, এমনকি ধর্ষণচেষ্টার অভিযোগও রয়েছে এ চক্রের বিরুদ্ধে। তাদের ভয়ে সব সময় তটস্থ থাকেন কেরানীগঞ্জের মানুষ। ডজনের বেশি মামলা হলেও এখন পর্যন্ত ধরাছোঁয়ার বাইরে তারা। অভিযোগ করতে গিয়ে উল্টো বাড়িঘর ছেড়ে পালিয়ে বেড়াচ্ছেন ভুক্তভোগীরা।
ভয়ংকর এই চক্রের মূলহোতা মো. ওমর ফারুক মিন্টু। ভুক্তভোগীদের অভিযোগ, কেরানীগঞ্জজুড়ে ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করেছেন চিহ্নিত এ চাঁদাবাজ। সাধারণ মানুষ তো বটেই; থানা পুলিশকেও তিনি থোড়াই কেয়ার করেন। একজন প্রভাবশালীর ছত্রছায়ায় থাকা এ মিন্টুর কথায়ই বলতে গেলে কেরানীগঞ্জে ‘দিন-রাত’ হয়।
অনুসন্ধানে জানা গেছে, এলাকায় কেউ কোনো নতুন ব্যবসা প্রতিষ্ঠান খুললে বা কোনো কাজ করলে মিন্টু ও তার দলবলকে তাদের দাবিমতো চাঁদা দিতে হয়। কেউ না দিতে চাইলে মিন্টু তার লোকজন দিয়ে প্রথমে কাজে বাধা দেন। এতেও কাজ না হলে দেখানো হয় ভয়ভীতি, চালানো হয় নির্যাতন। এসব কাজে মিন্টুর রয়েছে নিজস্ব ক্যাডার বাহিনী। মো. সালাউদ্দিন সুজন, মো. সাদ্দাম হোসেন জুয়েল, মো. আসাদুল, মো. মুক্তারসহ অন্তত দুই ডজন নিজস্ব ক্যাডার মিন্টুর হয়ে যানবাহন থেকে বাসাবাড়ি, দোকানপাট সর্বত্র চাঁদাবাজি করে বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে। মিন্টু ও তার সন্ত্রাসী বাহিনীর চাঁদাবাজিতে দিন দিন অতিষ্ঠ হয়ে উঠেছেন কেরানীগঞ্জবাসী। মাঝেমধ্যেই বিভিন্ন ব্যবসা প্রতিষ্ঠান ও জমিজমার দখল নিয়ে স্থানীয়দের সঙ্গে সংঘর্ষে জড়ায় মিন্টু বাহিনী। এসব সংঘর্ষে গুলি বিনিময়ের ঘটনা ঘটেছে বলেও অভিযোগ পাওয়া গেছে।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, মিন্টু একটি রাজনৈতিক দলের অঙ্গ সংগঠনের কেরানীগঞ্জ থানা কমিটির সাংগঠনিক সম্পাদক। এ রাজনৈতিক পদবি ব্যবহার করেই তিনি অন্যায়-অনিয়ম করেও ধরাছোঁয়ার বাইরে থাকেন বলে অভিযোগ রয়েছে।
মিন্টুর বিরুদ্ধে দায়ের করা অন্তত সাতটি মামলার কপি এসেছে কালবেলার হাতে। ২০২২ সালে মো. শুকুর আলী নামে এক ব্যক্তি বাদী হয়ে কেরানীগঞ্জ আদালতে একটি মামলা করেন। মামলা নং-৪৩১/২২। মামলার অভিযোগে বলা হয়, মো. শুকুর আলী এবং বাবুল মিয়া নামে দুই ব্যক্তি বাড়িতে ফেরার পথে বাবুল মিয়ার বাড়ির সামনে পৌঁছলে মিন্টু ও তার লোকজন চারদিক থেকে ঘিরে ধরে। এ সময় তাদের মারধর করে পকেটে থাকা টাকা এবং মোবাইল ফোন ছিনিয়ে নেন। এ ছাড়া কেরানীগঞ্জ মডেল থানা এবং কেরানীগঞ্জ আদালতে এ মিন্টুর বিরুদ্ধে একাধিক মামলা রয়েছে। যেসব মামলার নম্বর সিআর মামলা নং-৪৩১/২২, কেরানীগঞ্জ মডেল থানা মামলা নং-১৭(৫)২২ এবং ৬৪/২০১৯, নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনে মামলা নং-১৫৮/১৯, কেরানীগঞ্জ মডেল থানা মামলা নং-৫১(১০)২৩, কেরানীগঞ্জ মডেল থানা মামলা নং-৫২(১০)২৩। এ ছাড়া এই চক্রের বিরুদ্ধে কেরানীগঞ্জ মডেল থানা এবং কোর্টে অন্তত দেড় ডজন মামলা রয়েছে বলে জানা গেছে।
এসব অভিযোগের বিষয়ে জানতে চাইলে মো. ওমর ফারুক মিন্টু কালবেলাকে বলেন, ‘মামলা আমার নামে একশ থাকুক, সেটা আপনার দেখার বিষয় নয়। সুনির্দিষ্ট অভিযোগ বলতে প্রমাণিত অভিযোগ বোঝায়।’
এরপর অশ্লীল শব্দের গালি দিয়ে কে বা কারা তার বিরুদ্ধে অভিযোগ করেছেন, তা জানতে চান। তিনি একবার দাবি করেন, তার নামে কোনো মামলা নেই। আরেকবার বলেন, ‘যে কয়টি মামলা আছে প্রতিটি মামলায় আমি জামিনে আছি। পাশাপাশি প্রতিটি মামলায় আমি খালাস পাইছি। মানুষ যদি শত্রুতা করে আমার নামে মিথ্যা মামলা দেয়, সেটা তো আমি জবাব দিতেছি।’
এরপর তিনি বলেন, ‘আমি জবাব দেব কোর্টে, আপনার কাছে কেন জবাব দেব আমি? আপনি কী? আপনি কি আইন? আদালত? আমার বক্তব্য যা আছে, আমি কোর্টে দিমু।’
এই পর্যায়ে আর কিছু না বললেও ওমর ফারুক মিন্টু পরবর্তী সময়ে আবার ফোন করে সংবাদ প্রকাশ করা হলে মামলা করবেন বলে এ প্রতিবেদককে হুমকি দেন।
হাজী আব্দুল কাদের নামে এক ভুক্তভোগী কালবেলাকে জানান, ‘আমার ভাতিজা বালুর একটা টেন্ডার পেয়েছিল। সেই টেন্ডারের পুরোটাই দাবি করে মিন্টু। আমরা অনেক অনুরোধ করেছিলাম যেন অর্ধেক নেয়। আমরা তার কথা মেনে না নেওয়ায় কাজ করতে দেয়নি। উল্টো আমার স্বজনদের মারধর করে। তখন পুলিশ এলে তাদের সঙ্গেও গোলাগুলি করে।’
তিনি বলেন, ‘এ ঘটনার পর তার বিরুদ্ধে মামলা করাটাই কাল হয়ে দাঁড়িয়েছে। এখন তার বউকে দিয়ে আমাদের বিরুদ্ধেও মামলা দিয়েছে। এখন আমরা ঘরবাড়ি ছাড়া হয়ে গেছি। এলাকায় থাকতে পারছি না। ঢাকায় বিভিন্ন জায়গায় পালিয়ে থাকি।’
মো. শুকুর আলী নামে একজন বলেন, ‘আমার বোনের জমি কিনেছিল ঢাকার এক লোক। কিন্তু চাঁদা না দেওয়ায় সেই জমি তাদের দখলে যেতে দিচ্ছিল না মিন্টু। এর পরও আমরা দখল বুঝিয়ে দিতে বাউন্ডারি দিই। এ কারণে আমাদের নির্মম নির্যাতন করে মিন্টু। পিটিয়ে এবং কুপিয়ে গুরুতর জখম করে।’
তিনি আরও বলেন, ‘মিন্টুর কাজই চাঁদাবাজি করা। এলাকায় কেই কোনো জমি কিনলে বা বেচলে ওকে চাঁদা দিতে হয়। মিন্টুকে চাঁদা না দিয়ে কেউ কিছু করতে পারে না।’
পারুল আক্তার নামে আরেক ভুক্তভোগী বলেন, ‘মিন্টু ও তার লোকজন আমাদের দোকানে বাকি খায়। এরপর টাকা চাইলে দিই দিই বলে টালবাহানা করতে থাকে। এক পর্যায়ে আমি টাকা চাইলে আমাকে মেরে এলাকা ছাড়া করার হুমকি দেয়। এর দুই-তিন দিন পরে গভীর রাতে এক দিন মিন্টু ও তার লোকজন আমাদের বাড়িতে এসে বাকি টাকা দেবে বলে দরজা খুলে বাইরে বের হতে বলে। অনেক রাত এবং বাসায় পুরুষ লোক কেউ না থাকায় আমি বাইরে বের হতে চাই না। এরপর তারা দরজা ভেঙে ভেতরে ঢুকে পড়ে। এ সময় মিন্টু ও তার লোকজন আমাদের ঘরে ব্যাপক ভাঙচুর চালায় এবং দোকানের সব মালপত্র নষ্ট করে দেয়। এক পর্যায়ে আমার মেয়ের রুমে গিয়ে তাকে ধর্ষণের চেষ্টা চালায়। এ সময় আমাদের চিৎকার শুনে আশপাশের লোকজন বের হয়ে এলে তারা চলে যায়।’
স্থানীয়রা জানিয়েছেন, স্থানীয় হযরতপুর ইউনিয়নের চেয়ারম্যান আনোয়ার হোসেন আয়নালের ঘনিষ্ঠ হিসেবে পরিচিত মিন্টু। রাজনৈতিক দলের পদ এবং চেয়ারম্যানের ঘনিষ্ঠ—এই দুই পরিচয়েই দিন দিন বেপরোয়া হয়ে উঠছেন। রয়ে যাচ্ছেন ধরাছোঁয়ার বাইরে। তাকে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী গ্রেপ্তার করলেও জামিনে বের হয়ে এসে ফের অপকর্ম শুরু করেন।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে হযরতপুর ইউনিয়নের চেয়ারম্যান আনোয়ার হোসেন আয়নাল কালবেলাকে বলেন, ‘আসলে আমি এই বিষয়ে তেমন কিছু জানি না। কিছুদিন আগে আলমগীর আর মিন্টুর মধ্যে মাটি ভরাট নিয়ে একটু ঝামেলা হয়েছে। এই ঘটনায় একটি মামলা হয়েছে জানি।’
মিন্টুর সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা সম্পর্কে তিনি বলেন, ‘মিন্টু এবং আমি একই রাজনীতি করি। সেই হিসেবে মিছিল-মিটিংয়ের প্রয়োজনে তার সঙ্গে আমার দেখা সাক্ষাৎ হয়। এ ছাড়া তার সঙ্গে আমার তেমন কোনো সম্পর্ক নেই। প্রায় ৫-৬ বছর আগে তার সঙ্গে কথা কাটাকাটিও হয়েছে।’
সার্বিক বিষয়ে জানতে চাইলে কেরানীগঞ্জ মডেল থানার অফিসার ইনচার্জ (ওসি) মোহাম্মদ মামুন অর-রশিদ কালবেলাকে বলেন, ‘প্রথমত, যখন যে অপরাধ হয়, সে অপরাধে তাকে গ্রেপ্তার করে আদালতে চালান দেওয়া হয়। আমাদের কাজ হলো, কোনো অপরাধ ঘটলে মামলা নেওয়া, আসামি ধরে কোর্টে পাঠানো। একটি মারামারি হয়েছে, এরপর তাকে ধরে কোর্টে পাঠানো হয়েছে। তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হয় না—এ ধরনের অভিযোগ সত্য নয়।’