রাজধানীর উপকণ্ঠেই রূপগঞ্জের বরুনা গ্রাম। কংক্রিটের নগরীর খুব কাছের গ্রামটিতে নেই কোনো কোলাহল। বাজার থেকে ডানে বাঁক নিয়ে সামান্য এগোলেই শামীম আহমেদের বাড়ি। শান্ত গ্রামটির সর্বস্বান্ত এক বাড়ি, অসহায় এক পরিবার। সম্প্রতি ইউনাইটেড মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতালে চিকিৎসা অবহেলায় মারা যাওয়া ছোট্ট আয়ানের বাড়ি এটি। তার বাবা শামীম আহমেদ বেসরকারি নির্মাণ প্রতিষ্ঠানের মার্কেটিং বিভাগে কর্মরত। তার স্ত্রী রেহানা আক্তার গৃহিণী। শামীম-রেহানার দুই সন্তান। পাঁচ বছরের আয়ান বড় আর ছোট আট মাসের তাসফিয়া।
একমাত্র ছেলের মর্মান্তিক মৃত্যুতে বাড়িতে এখনো চলছে শোকের মাতম। বরুনাজুড়েই ছড়িয়েছে সে নীরবতা। হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের ভাষ্য, ফুসফুসে বাতাস জমে যাওয়ায় কার্ডিয়াক অ্যারেস্ট হয়েছে শিশু আয়ানের। এতে তার হার্ট, কিডনি, লিভারসহ গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গগুলো বিকল হয়ে পড়ে।
আয়ানকে বরুনা কবরস্থানে দাফন করা হয়েছে দুই দিন আগেই।
বাড়িতে তিন দিন ধরেই হাজারো মানুষের ভিড়। সবাই পরিবারটিকে সান্ত্বনা দিচ্ছে। কেউ কেউ আবার চোখ মুছছে আড়ালে-বিরালে।
গতকাল বরুনা বাজারে গিয়ে আয়ানদের বাড়ির ঠিকানা জানতে চাইলে এগিয়ে আসেন হিমেল নামে এক যুবক। পাল্টা প্রশ্ন ছুড়ে বলেন, ‘মুসলমানি করাতে গিয়ে মারা গেছে যে, সেই আয়ানদের বাড়ি যাবেন? আসেন, পথ দেখাতে গিয়ে আক্ষেপের সুরে বলেন, খেলাধুলা আর দুষ্টামিতে সবাইকে মুগ্ধ করে রাখত দুরন্ত আয়ান। ছেলেটার মৃত্যুতে এলাকা নিশ্চুপ হয়ে গেছে! মনে হচ্ছে, গ্রামটা জনমানবশূন্য।’ বাড়ির আঙিনায় পৌঁছানোর আগেই কানে ভেসে আসে কান্নার রোল। ঘরে ঢুকতেই চোখে পড়ে আয়ানের খেলনা গাড়ি। নীল-সাদার মিশ্রণের তিন চাকার গাড়িটি পড়ে আছে অবহেলায়। খেলার সঙ্গী যে নেই। শোবার ঘরে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে আয়ানের বইখাতা। তখনো মায়ের কোলে খেলছিল আদরের ছোটবোন তাসফিয়া। মা জানান, তাসফিয়ার জন্মের পরও মায়ের কোলে ভাগ বসাত ছোট্ট আয়ান। কিন্তু একসময় ছোট্ট বোনকে আপন করে সেই দাবি ছেড়ে দেয় বড় ভাই আয়ান। এখন সেই দাবি চিরতরে ছেড়ে গেছে অজানায়। তাসফিয়া বুঝতেও পারবে না কতবড় আপনজন হারাল সে। যদিও মায়ের আর্তনাদে সে-ও মুখ ভাড় করে রেখেছে। ঘরভর্তি অচেনামুখের ভিড়ে হয়তো খোঁজে বেড়াচ্ছে চিরচেনা ভাইকে।
একমাত্র ছেলে স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে বারবার মূর্ছা যাচ্ছেন রেহানা। বিড় বিড় করে বলেন, আমার বাবাকে ফিরিয়ে দেন, এখন কে আমাকে সারাদিন ব্যস্ত রাখবে? স্কুল থেকে ফিরে কে তাসফিয়াকে বলবে, লক্ষ্মী সোনা, চাঁদের কণা। রাগ করোনা এই তো আমি! মা বলতে থাকেন, জানেন আয়ান সবসময় বলত, বড় হয়ে টিচার হবে, প্রিন্সিপাল হবে। বলত, আম্মু আমি তো বড় ভাই হয়ে গেছি। বোনকেও টিচার বানাব।
আয়ানের মা আরও বলেন, বাপজানকে (আয়ান) ভালো স্কুলে (জলসিঁড়ি ক্যান্টনমেন্ট স্কুল ও কলেজ) দিয়েছিলাম। শিক্ষকরাও বলতেন, ছেলে আমার খুব মেধাবী; তবে একটু চঞ্চল।
গত বছর তাসফিয়ার জন্মের পর বেশ কিছুদিন অসুস্থ ছিলাম। তাই গত জানুয়ারিতে ভর্তি করাতে পারিনি। তার পরও দুই টার্ম পরীক্ষায় ভালো রেজাল্ট করে আয়ান। নতুন বছরে প্লে থেকে নার্সারিতে ওঠে। গত ১৩ ডিসেম্বর স্কুলে ভর্তিও করি নার্সারিতে। পরে ভাবলাম, নির্বাচনের কারণে ক্লাস শুরু হতে দেরি হবে। সুন্নতে খতনা করাই। ভালো ও নিরাপদ সেবার আশায় ইউনাইটেড হাসপাতালে গিয়েছিলাম। কিন্তু দেখেন, তারা আমার বুকের মানিকরে মেরে ফেলল! কার জন্য বাঁচব।
এ সময় অভিযোগ করে তিনি বলেন, চিকিৎসার নামে আমার সন্তানকে খুন করেও তাদের (ইউনাইটেড হাসপাতাল) লজ্জা হয়নি। এখনো বারবার ফোন দিচ্ছে বিলের পৌনে ৬ লাখ টাকার জন্য। তারা চিকিৎসক না, কসাই। কখনো শুনছেন খতনা করাতে এত টাকা বিল হয় কিংবা কারও মৃত্যু হয়েছে?
আয়ানের চাচা লিটন ঢাকা বরিশাল রুটে লঞ্চে কর্মরত। তিনি বলেন, একটা ফুটফুটে শিশুর সঙ্গে কেউ এমন অবিচার করে কীভাবে? নামি হাসপাতালে গেলাম; কিন্তু সেখানে গিয়ে সন্তানকেই হারাতে হলো। প্রধানমন্ত্রীর কাছে এ হত্যার বিচার চাই। কারও সঙ্গে যেন তারা আর এমন অন্যায় করতে না পারে।
গতকাল বুধবার প্রতিবেদক যখন আয়ানদের বাড়িতে পৌঁছান, তখন বিচারের দাবিতে দ্বারে দ্বারে ঘুরছেন সন্তান হারানো শোকে পাথর বাবা শামীম আহমেদ। বিচারের দাবিতে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালক অধ্যাপক ডা. আবুল বাশার মোহাম্মদ খুরশীদ আলমের সঙ্গে দেখা করে অভিযোগপত্র দেন তিনি। সে সময় মহাপরিচালক তাকে তদন্তসাপেক্ষে ন্যায়বিচারের আশ্বাস দিয়েছেন। এদিকে আজ বৃহস্পতিবার সকালে শামীমের বক্তব্য শোনার জন্য মুগদা হাসপাতালে উপস্থিত হতে বলেছে অধিদপ্তরের তদন্ত কমিটি।
এর আগে গতকাল বুধবার সকালে আয়ানের মৃত্যুর ঘটনায় অভিযুক্ত দুই চিকিৎসকসহ দোষীদের গ্রেপ্তারে ২৪ ঘণ্টার আলটিমেটাম দেয় স্বাস্থ্য সুরক্ষা আন্দোলন নামে একটি সংগঠন। অন্যথায় ইউনাইটেড হাসপাতাল ঘেরাও করার হুঁশিয়ারি দেয় সংগঠনটি। রাজধানীর জাতীয় প্রেস ক্লাবের সামনে আয়োজিত মানববন্ধনে এসব ঘোষণা দেওয়া হয়।
প্রসঙ্গত, গত ৩০ ডিসেম্বর খতনা করতে আয়ানকে ওই হাসপাতালে নিয়ে যান বাবা শামীম আহমেদ। পরদিন শিশুটির দেহে খতনা-পূর্ব অ্যানেসথেসিয়া দেওয়া হয়। এর আট দিন পরও জ্ঞান ফেরেনি আয়ানের। গত রোববার রাত ১১টা ২০ মিনিটে তাকে মৃত ঘোষণা করেন চিকিৎসকরা। চিকিৎসায় ব্যয় ধরা হয় ৫ লাখ ৭৭ হাজার ২৫৭ টাকা। হাসপাতালের জনসংযোগ কর্মকর্তা আরিফুল হক এ বিষয়ে বলেন, প্রাতিষ্ঠানিক নিয়মে বিল করা হয়েছে। কিন্তু আয়ানের পরিবারের মানসিক অবস্থাও বিবেচনায় রয়েছে। তাই তারা কী পরিমাণ বিল দেবেন, সেটি পরে আলোচনাসাপেক্ষে নির্ধারণ করা হবে।