আজ বৃহস্পতিবার উদযাপিত হচ্ছে ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের (ডিএমপি) ৪৯তম প্রতিষ্ঠা দিবস। নানা আয়োজনের মধ্য দিয়ে দিবসটি উপযাপন করছে পুলিশের সবচেয়ে এই বড় ইউনিট। ১৯৭৬ সালের ১ ফেব্রুয়ারি ৬ হাজার পুলিশ সদস্য এবং ১২টি থানা নিয়ে যাত্রা শুরু করে ডিএমপি। দীর্ঘ পথপরিক্রমায় ঢাকা মহানগরীর প্রায় ২ কোটি ২৫ লাখ নাগরিকের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে ডিএমপির কার্যক্রম এখন ৫০টি থানায় বিস্তৃত হয়েছে।
প্রতিষ্ঠা দিবসে কালবেলাকে দেওয়া একান্ত সাক্ষাৎকারে ডিএমপি কমিশনার হাবিবুর রহমান পুলিশের কার্যক্রম, ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা, নাগরিক সেবা, থানায় হয়রানি, বিরোধী দলের নেতাকর্মীদের গ্রেপ্তারের অভিযোগসহ নানা বিষয়ে খোলাখুলি কথা বলেন। পারস্পরিক সহযোগিতার ভিত্তিতে আইন মান্যতার সংস্কৃতিকে উৎসাহিত করার আহ্বান জানিয়েছেন তিনি। সেবা ও সদাচারের অঙ্গীকার নিয়ে সার্বক্ষণিক মানুষের আস্থা ও নির্ভরতার প্রতীক হয়ে পাশে থাকারও প্রতিশ্রুতি দেন তিনি।
কালবেলা: ডিএমপির পথচলার ৪৯ বছর পূর্ণ হচ্ছে। রাজধানীর মতো একটি গুরুত্বপূর্ণ জায়গায় আইনশৃঙ্খলা রক্ষায় ডিএমপির কর্মপদ্ধতি সম্পর্কে কিছু বলুন।
ডিএমপি কমিশনার: মেগাসিটি ঢাকার ২ কোটি ২৫ লাখ নগরবাসীর নিরাপত্তা নিশ্চিতে কাজ করে যাচ্ছেন ডিএমপির প্রত্যেক পুলিশ সদস্য। অপরাধ প্রতিরোধ, প্রতিকার, নিয়ন্ত্রণ, নিবারণ, উদ্ঘাটন—সব ধরনের প্রস্তুতি নিয়েই ডিএমপি কাজ করে। নিয়মিত চেকপোস্ট, টহল এবং প্যাট্রলিংয়ের পাশাপাশি কমিউনিটি ও বিট পুলিশিংয়ের মাধ্যমে জনগণকে সম্পৃক্ত করে যেমন আমরা কাজ করছি, তেমনি প্রো-অ্যাকটিভ পুলিশিংয়ের অংশ হিসেবে ইন্টেলিজেন্স সংগ্রহ করে অপরাধ সংঘটনের আগেই ব্যবস্থা নেওয়া হয়। আবার কোনো অপরাধ ঘটে গেলে রহস্য উদ্ঘাটন, আসামি গ্রেপ্তার ও সুষ্ঠু তদন্ত করা হয়। দেশের প্রাণকেন্দ্র ঢাকায় অবস্থিত রাষ্ট্রীয় গুরুত্বপূর্ণ সব স্থাপনা, বিদেশি দূতাবাস, কেপিআইসহ সব উন্নয়ন প্রকল্পের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা হচ্ছে। ডিএমপির বিশেষায়িত ইউনিট সিটিটিসি সর্বমহল প্রশংসিত। যুগের সঙ্গে তাল মিলিয়ে ডিএমপি তথ্য প্রযুক্তির উৎকর্ষতার আলোকে পেশাদারিত্বের সঙ্গে কাজ করে যাচ্ছে।
কালবেলা: ১২টি থানা নিয়ে ডিএমপির কার্যক্রম শুরু হয়েছিল। এখন থানার সংখ্যা ৫০টি। জনবলসহ সবকিছুই বেড়েছে। এরপরও কাঙ্ক্ষিত সেবা দেওয়া যাচ্ছে কি?
ডিএমপি কমিশনার: ডিএমপির ৪৯তম প্রতিষ্ঠা দিবসে প্রতিপাদ্য হলো—‘সেবা ও সদাচার, ডিএমপির অঙ্গীকার’। সেবার সুমহান ব্রত নিয়ে ডিএমপির প্রতিটি সদস্য কাজ করে যাচ্ছে। কাঙ্ক্ষিত সেবার মান উন্নয়নে নতুন নতুন বিভিন্ন বিষয় সংযোজন হচ্ছে। আমি যোগদান করার পরই ‘মেসেজ টু কমিশনার (M2C)’ সার্ভিস চালু করেছি। ফলে যে কোনো নাগরিক সরাসরি যে কোনো তথ্য কমিশনারকে মেসেজের মাধ্যমে জানাতে পারবেন।
ঢাকা মেট্রোপলিটন এলাকায় সহিংসতার শিকার নারী ও শিশুদের সংবেদনশীলতা ও অধিকারকে গুরুত্ব দিয়ে উইমেন সাপোর্ট অ্যান্ড ইনভেস্টিগেশন ডিভিশন কাজ করছে। গত এক বছরে নারী ও শিশুবিষয়ক ১২১টি মামলা নিষ্পত্তি, ৭৬টি পারিবারিক বিরোধ মীমাংসা এবং ৩২৫ জন ভিকটিমকে ভিকটিম সাপোর্ট সেন্টারে রেখে সেবা দেওয়া হয়েছে।
ডিএমপির পুলিশ ক্লিয়ারেন্স সার্ভিস সেল থেকে গত এক বছরে মোট ৫৩ হাজার ২৮৯টি আবেদন নিষ্পত্তি করা হয়েছে। যার মধ্যে ৭২ ঘণ্টায় ভেরিফিকেশন সম্পন্ন করা হয়েছে ২৬ হাজার ৪৭৫টি আবেদনের।
পেশাগত দায়িত্বের পাশাপাশি ডিএমপি সর্বদা মানবিক পুলিশিংয়ের অনন্য দৃষ্টান্ত স্থাপন করে যাচ্ছে। করোনা মহামারি থেকে শুরু করে যে কোনো প্রাকৃতিক কিংবা মনুষ্যসৃষ্ট দুর্যোগে সর্বশক্তি দিয়ে ডিএমপির সদস্যরা মানবিক কার্যক্রমে আত্মনিয়োগ করেছে। ২০১০ থেকে পুলিশ ব্লাড ব্যাংক থেকে ৬৭ হাজার ৬০১ ব্যাগ রক্ত সরবরাহ করা হয়েছে। পুলিশি সেবাকে দ্রুত সহজীকরণের সর্বাত্মক প্রচেষ্টা অব্যাহত আছে।
কালবেলা: সাধারণ মানুষ প্রায়ই আক্ষেপ করে, থানায় গিয়ে সেবা পাওয়ার ক্ষেত্রে নানা ধরনের বিড়ম্বনায় পড়তে হয়। এ বিষয়ে আপনার বক্তব্য কী?
ডিএমপি কমিশনার: প্রতিটি থানাকে আমরা নাগরিকদের জন্য সেবাকেন্দ্র হিসেবে প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ নিয়েছি। পুলিশ জনগণের বন্ধু। থানায় গিয়ে যেন কেউ হয়রানির শিকার না হয়, এজন্য থানাগুলোতে সিনিয়র অফিসারদের মনিটরিং বাড়ানো হয়েছে। প্রতিটি থানা সিসিটিভি ক্যামেরার আওতাভুক্ত যা ডিএমপি হেডকোয়ার্টার্স থেকে সরাসরি মনিটরিং করা হয়। ইন্টারনাল ওভারসাইট উইং গত ১ বছরে রুজুকৃত মামলা ও জিডির বাদী এবং পুলিশ ক্লিয়ারেন্সের আবেদনকারীর মধ্যে ২ লক্ষ ৫৮ হাজার ৭৭৩ জন সেবা প্রার্থীর সঙ্গে ডিএমপি হেডকোয়ার্টার্স থেকে দায়িত্বপ্রাপ্ত অফিসার ও ফোর্স সরাসরি ফোনে যোগাযোগ করে তাদের মূল্যবান মতামত লিপিবদ্ধ করে। কারও বিরুদ্ধে যদি সুনির্দিষ্ট অভিযোগ পাওয়া যায় তাহলে অতিসত্বর বিভাগীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়।
কালবেলা: বর্তমান সরকার রাজধানীতে মেট্রোরেল, উড়াল সড়কসহ যোগাযোগ ব্যবস্থার আধুনিকায়ন করেছে। এর পরও যানজট রয়ে গেছে, অনেকেই বলেন গণপরিবহনে শৃঙ্খলা না থাকায় এই যানজট—এক্ষেত্রে ডিএমপির করণীয় কী?
ডিএমপি কমিশনার: ঢাকা মহানগরীর প্রতি বর্গ কিলোমিটারে গড়ে ৩০ হাজার ৯১১ জন মানুষ বাস করে। যানবাহন সংখ্যা প্রায় ২১ লাখ। অবকাঠামোগত অপ্রতুলতা ও ক্ষেত্রবিশেষ ট্রাফিক আইন মান্যতার বিষয়ে সচেতনতার অভাব পরিলক্ষিত হলেও, এই মহানগরীর অন্যতম চ্যালেঞ্জ সুষ্ঠু ট্রাফিক ব্যবস্থাপনা নিশ্চিতে নিরলস কাজ করে যাচ্ছে আমাদের ট্রাফিক ইউনিট। গত পাঁচ বছরে সড়কে শৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠায় আধুনিক e-Traffic Prosecution ব্যবস্থায় POS ডিভাইসের মাধ্যমে ২৭ লাখ ২২ হাজার ২৯৫টি মামলা হয়েছে। এ ছাড়া ট্রাফিক সচেতনতা বৃদ্ধির লক্ষ্যে গত এক বছর প্রতি মাসে গড়ে ২০০টি সভা ও সেমিনারের আয়োজন করা হয়। যানজট নিরসন পুলিশের একার পক্ষে সম্ভব নয়। এজন্য সম্মিলিত প্রয়াস, সমন্বিত উদ্যোগ ও পরিকল্পিত নগরায়ণ নিশ্চিত করতে হবে।
কালবেলা: আপনি ডিএমপির কমিশনার হিসেবে যোগ দিয়েই ফোর্সদের বাসস্থান-খাবারে নজর দিয়েছিলেন, এর নেপথ্যে কী?
ডিএমপি কমিশনার: ডিএমপির মোট জনবলের ৮৫ শতাংশ সদস্য শত প্রতিকূলতার মধ্যে দিয়ে নিরাপত্তা নিশ্চিতে কাজ করে যাচ্ছেন। ডিএমপি কমিশনার হিসেবে যোগ দেওয়ার আগে ২০০৯ থেকে ২০১২ সাল পর্যন্ত আমি এই ইউনিটের ডিসি সদর দপ্তর ও প্রশাসনে কাজ করেছি। আমি আমার ফোর্সদের কাছে থেকে দেখার সুযোগ পেয়েছি। তাদের মনোবল ও আত্মবিশ্বাস সমুন্নত রাখতে ডিএমপি অভিভাবক হিসেবে তাদের কল্যাণের বিষয়টি নিশ্চিত করা আমার অন্যতম দায়িত্ব বলে মনে করি।
কালবেলা: বিরোধী দলগুলো অভিযোগ করে থাকে ভিন্নমতের কারণে পুলিশ রাজনৈতিক নেতাকর্মীদের গ্রেপ্তার করছে, এই অভিযোগের জবাব কী?
ডিএমপি কমিশনার: বাংলাদেশ পুলিশ রাষ্ট্রের আইনি কাঠামোর মধ্যে পরিচালিত হয়ে শতভাগ পেশাদারিত্বের সঙ্গে কাজ করে যাচ্ছে। যদি রাজনৈতিক কর্মসূচির নামে কেউ ফৌজদারি আইন লঙ্ঘন করে, জননিরাপত্তার বিঘ্ন ঘটায়, সেক্ষেত্রে আইনি পরিকাঠামোর মধ্যে থেকে নাগরিকদের নিরাপত্তা ও জনশৃঙ্খলা রক্ষায় আমরা আমাদের অর্পিত দায়িত্ব পালন করে থাকি। সুনির্দিষ্ট অভিযোগ, মামলা কিংবা ওয়ারেন্ট ব্যতিত কাউকে হয়রানি করার সুযোগ নেই। যদি কেউ কোনো অপরাধ করে, সে আইনের দৃষ্টিতে অপরাধী। আমাদের কাছে তার আলাদা কোনো পরিচয় বিবেচ্য নয়।
কালবেলা: আগামী বছর ডিএমপির ৫০ বছর পূর্ণ হবে। সুবর্ণজয়ন্তী সামনে রেখে ঢাকা মহানগর পুলিশকে একটি আধুনিক ও স্মার্ট বাহিনী হিসেবে গড়ে তুলতে কোনো উদ্যোগ আছে কি? কী বার্তা দেবেন নগরবাসীকে?
ডিএমপি কমিশনার: বর্তমান বিশ্বায়নের বাস্তবতায় Information and Intelligence সর্বক্ষেত্রে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। অপরাধ দমন ও নিবারণে এর ব্যতিক্রম নয়। CIMS (Citi“en Information Management System) সফটওয়্যারে ৪,১৪,৮২,৩১৪ জন নাগরিকের তথ্য সন্নিবেশ করা হয়েছে। SIVS++ (Suspect Identification and Verification System) ডাটাবেজের মাধ্যমে সন্দিগ্ধ অপরাধীদের বায়োমেট্রিকসহ যাবতীয় তথ্য সংরক্ষণ করা হচ্ছে। সিঙ্গেল ক্লিকে কোনো ব্যক্তির সব তথ্য বিভিন্ন প্ল্যাটফর্ম থেকে সংগ্রহপূর্বক একটি পূর্ণাঙ্গ প্রোফাইল তৈরির নিমিত্তে DRIMS (DMP Renovated Information Management System) নামক ওয়ানস্টপ প্ল্যাটফর্ম চালু করা হয়েছে। উন্নত মেগাসিটিগুলোর আদলে আধুনিক সার্ভেইল্যান্স ব্যবস্থা নিশ্চিতকল্পে ২২১টি লোকেশনে ১২০০টি সিসিটিভি ক্যামেরা বসানো হয়েছে। পুরো ঢাকা মহানগরীকে সিসি ক্যামেরার আওতাভুক্ত করতে LOCC-এর আদলে আমরা পদক্ষেপ নিয়েছি। সেক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট পাবলিক ও প্রাইভেট সেক্টরের অনেক স্টেকহোল্ডারের সহযোগিতা এই প্রকল্প বাস্তবায়নে ভূমিকা রাখবে। ছিনতাই প্রতিরোধে কার্যকরী ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য ‘ছিনতাই প্রতিরোধ টাস্কফোর্স’ গঠন করা হয়েছে। এ ছাড়া ক্রমবর্ধমান সাইবার ক্রাইম মোকাবিলায় ‘সাইবার সাপোর্ট সেন্টার’ স্থাপন করা হয়েছে।
কালবেলা: সময় দেওয়ার জন্য আপনাকে ধন্যবাদ।
ডিএমপি কমিশনার: কালবেলা ও পাঠকদের ধন্যবাদ।