গত তিন দশকে একের পর এক নীতিগত পরিবর্তন আনা হলেও দেশের ব্যাংকিং খাতে শৃঙ্খলা নিশ্চিত করতে পারেনি বাংলাদেশ ব্যাংক। ব্যাংকসহ আর্থিক খাতকে সুশৃঙ্খল করতে সংশ্লিষ্ট একাধিক আইনের পাশাপাশি বিভিন্ন সময়ে নানা নির্দেশনা জারি করে নিয়ন্ত্রক সংস্থাগুলো। এর মাধ্যমে একদিকে যেমন ব্যাংকের নিয়মিত কার্যক্রমের পদ্ধতিগত নানা দিক ঠিক করে দেওয়া হয়, তেমনি বাস্তব পরিস্থিতির সঙ্গে সংগতি রেখে বিভিন্ন সময়ে নীতিগত নানা পরিবর্তনও আনা হয়। তবে নানামুখী এসব পদক্ষেপের পর দেশের ব্যাংকিং খাতে সুশাসনের সংকট কাটানো যাচ্ছে না বলে বিশ্লেষকরা মনে করেন।
অর্থনীতিবিদরা বলছেন, বারবার নীতিমালা ঘোষণা করলেও রাজনীতিক, ব্যবসায়ীসহ বিভিন্ন খাতের প্রভাবশালীদের হস্তক্ষেপে বাংলাদেশ ব্যাংক তা বাস্তবায়ন করতে পারছে না। অবৈধ হস্তক্ষেপের মাধ্যমে বিশেষ করে ব্যাংক থেকে হাজার হাজার কোটি টাকা হাতিয়ে নেওয়া হচ্ছে। রাজনৈতিক কারণে বাংলাদেশ ব্যাংক এগুলো নিয়ন্ত্রণ করতে পারছে না। এজন্য ব্যাংক খাতে শৃঙ্খলা ফেরাতে হলে সবার আগে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের পূর্ণাঙ্গ ও কার্যকর স্বায়ত্তশাসন নিশ্চিত করা জরুরি।
বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর সালেহ উদ্দিন আহমেদ কালবেলাকে বলেন, ‘মূলত বাংলাদেশ ব্যাংক নীতিমালা করেই থেমে যায়, তা বাস্তবায়ন করতে পারে না। এ কারণে সুশাসন ফেরে না। আমি দায়িত্বে থাকা অবস্থায় ব্যাংক একীভূত করার নীতি করে দিয়ে এসেছিলাম। সেটা বাস্তবায়ন হয়নি। সুশাসন ফেরাতে হলে বাংলাদেশ ব্যাংককে শক্ত অবস্থানে যেতে হবে। ব্যাংক ব্যবস্থার উন্নতির স্বার্থে কারও কথায় কর্ণপাত করা
যাবে না। ঘোষিত নীতি বাস্তবায়নে কেন্দ্রীয় ব্যাংক কঠোর হতে পারলে সুফল আসবে। কিন্তু ব্যবসায়ী, রাজনীতিবিদ ও প্রভাবশালীদের ডিঙিয়ে বাংলাদেশ ব্যাংক কতটা শক্ত অবস্থানে যেতে পারবে, তা নিয়ে সন্দেহ রয়েছে।’
প্রাপ্ত তথ্যমতে, ঋণ বিতরণে এখন ইন্টারনাল ক্রেডিট রিস্ক রেটিং (আইসিআরআর) নীতিমালা অনুসরণের নির্দেশনা রয়েছে। এর বাস্তবায়ন কতটুকু হচ্ছে তা নিয়ে প্রশ্ন রয়েছে। এর আগে ছিল ক্রেডিট রিস্ক গ্রেডিং (সিআরজি), তারও আগে ঋণ বিতরণে লেন্ডিং রিস্ক অ্যানালইসিসি (এলআরএ) অনুসরণের বাধ্যবাধকতা ছিল। এভাবে পর্যায়ক্রমে ঋণ বিতরণের নিয়ম কঠোর করা হলেও বেড়েছে খেলাপির পরিমাণ। সেইসঙ্গে সৃষ্টি হয়েছে নানা বিশৃঙ্খলা। এ অবস্থায় শৃঙ্খলা ফেরানোর লক্ষ্যে আবারও নতুন করে কাজ করছে বাংলাদেশ ব্যাংক। সর্বশেষ গত ৪ ফেব্রুয়ারি ব্যাংক খাতের খেলাপিদের ধরতে ১১ দফা রোডম্যাপ ঘোষণা করা হয়েছে।
আর্থিক খাতের নিয়ন্ত্রক সংস্থাগুলোর মধ্যে বাংলাদেশ ব্যাংকের ভূমিকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। সুশাসন ও আর্থিক শৃঙ্খলা বজায় রাখা সংস্থাটির প্রধান কাজ। কিন্তু কিছু কিছু ক্ষেত্রে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নেওয়া উদ্যোগও প্রশ্নবিদ্ধ হয়ে উঠেছে।
তথ্য বলছে, ২০১৬ সালের ২০ মার্চ গভর্নর হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণ করেছিলেন ফজলে কবির। সেই সময়ে ব্যাংক খাতের খেলাপি ঋণ ছিল ৫৯ হাজার ৪১১ কোটি। ২০২২ সালের ৩ জুলাই তিনি অবসরে যান। সেসময় খেলাপি ঋণের পরিমাণ দাঁড়ায় ১ লাখ ২৫ হাজার ২৭৫ কোটি টাকা। অর্থাৎ এই সাত বছরে ৬৫ হাজার ৮৪৬ কোটি টাকা বৃদ্ধি পায় খেলাপি ঋণ।
প্রাপ্ত তথ্য বলছে, ব্যাংক খাতের অনিয়ম কমাতে ২০১৯ সালের ১৭ জানুয়ারি বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব ব্যাংক ম্যানেজমেন্ট (বিআইবিএম) মিলনায়তনে ঋণের ঝুঁকি পরিমাপের নতুন নীতিমালা উদ্বোধন করেন গভর্নর ফজলে কবির। ইন্টারনাল ক্রেডিট রিস্ক রেটিং (আইসিআরআর) নামের এই নীতিমালায় ঋণের পরিমাণ ও গুণগত উভয় ধরনের সক্ষমতার মূল্যায়ন শর্ত রাখা হয়। মূল্যায়নের ভিত্তিতে গ্রাহককে চার শ্রেণিতে বিভাজন করবে ব্যাংকগুলো। কোনো গ্রাহক ‘চমৎকার’ (এক্সিলেন্ট) বা ‘ভালো’ (গুড) রেটিং পেলে ব্যাংক তাকে অর্থায়ন করতে পারবে। ‘প্রান্তিক’ (মার্জিনাল) রেটিংধারী গ্রাহককে পুরোনো ঋণ নবায়ন বা নতুন করে ঋণ দেওয়ার ক্ষেত্রে সতর্কতা অবলম্বন করতে হবে। তবে ‘অগ্রহণযোগ্য’ রেটিংধারীকে কোনো পরিস্থিতিতেই নতুন ঋণ দিতে পারবে না ব্যাংকগুলো, যদি না আগের ঋণ শতভাগ নগদ পরিশোধ হয় অথবা জামানত দিয়ে ঋণটি আচ্ছাদন করা হয়। ‘অগ্রহণযোগ্য’ (আনএকসেপ্টেবল) রেটিংভুক্ত গ্রাহকের আগের ঋণ সর্বোচ্চ দুবার নবায়ন বা বর্ধিত করা যাবে।
এই নীতিমালা জারির পর দেশের আর্থিক খাতে সুশাসন ফেরার ইঙ্গিত দিয়েছিলেন অর্থনীতিবিদরা। কিন্তু বিভিন্ন মহলের চাপে অল্প সময়ের মধ্যেই ওই নীতিমালায় পরিবর্তন আসে। এর পরও বেশ কয়েকবার পরিবর্তন করা হলেও এখন পর্যন্ত ওই নীতিমালা কার্যকর রয়েছে। তবে এটি কতটা অনুসরণ করা হচ্ছে, সে বিষয়ে প্রশ্ন রয়েছে।
তথ্য বলছে, দেশে করোনাভাইরাসের প্রকোপ শুরু হলে ২০২০ সালের পুরো সময়ে ঋণ পরিশোধ না করে খেলাপিমুক্ত থাকার সুযোগ পান গ্রাহক। ২০২১ সালের ১৪ ডিসেম্বর নির্ধারিত ঋণের কিস্তির ২৫ শতাংশ জমা দিয়েই নিয়মিত গ্রাহক হিসেবে বিবেচনার সুযোগ দেয় কেন্দ্রীয় ব্যাংক। পুরো বছরই এই সুবিধা ভোগ করেন ব্যাংকের সব গ্রাহক। ২০২২ সালে ন্যূনতম ২ শতাংশ ডাউন পেমেন্টে ঋণ পুনঃতপশিলে সুযোগ দিয়ে প্রজ্ঞাপন জারি করা হয়। গত বছরের ৪ সেপ্টেম্বর জারি করা ওই প্রজ্ঞাপনে বলা হয়, যেসব গ্রাহক ঋণ পরিশোধ করেননি, তাদের জন্য ৪ বার ঋণ পুনঃতপশিল বা ঋণ পুনর্গঠনের সুযোগ দেওয়া হবে। ঋণ পরিশোধে ২৯ বছর সময় পাবেন। সেই প্রজ্ঞাপন এখনো বহাল।
তদারকি দুর্বলতা ও পরিচালকদের অনিয়মের কারণে পিপলস লিজিং অ্যান্ড ফিন্যান্সিয়াল সার্ভিসেস লিমিটেড এখন অবসায়নে। এমন অবস্থা আরও কয়েকটি ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানেরও। পিকে হালদারসহ একাধিক ব্যাংক কর্মকর্তার সংশ্লিষ্টতা পাওয়া যায় অনুসন্ধানে।
এর আগে ২০০৫ সালে ব্যাংক খাতে সুশাসন ফেরাতে ক্রেডিট রিস্ক গ্রেডিং (সিআরজি) ঘোষণা করেছিল বাংলাদেশ ব্যাংক। মূলত ওই সময়ে ব্যাংক খাতে নানা অনিয়মসহ বিভিন্ন কারণে সংস্কারের প্রয়োজন হয়ে পড়ে। এ জন্যই এই নীতিমালা জারি করেছিলেন গভর্নর সালেহ উদ্দিন আহমেদ। তার পরও ওরিয়েন্টাল ব্যাংকের পতন ঠেকাতে পারেননি এই গভর্নর। মালিক পক্ষের লুটপাটের কারণে অতিরুগণ হয়ে পড়লে ২০০৬ সালের ১৯ জুন ব্যাংকটির দায়িত্ব নেয় কেন্দ্রীয় ব্যাংক। পরে মালিক পক্ষের ৮৬ শতাংশ শেয়ারের বড় অংশ কিনে নেয় মালয়েশিয়ার আইসিবি গ্রুপ। তারপর ব্যাংকটির নাম পরিবর্তন করে করা হয় আইসিবি ইসলামিক ব্যাংক। এখনো ব্যাংকটি রুগণ অবস্থায়ই আছে। এই নীতিমালা জারির সময় ব্যাংক খাতে খেলাপির পরিমাণ ছিল ২০ হাজার ১০ কোটি টাকা। কিন্তু খেলাপি নিয়ন্ত্রণ করা যায়নি। গভর্নর হিসেবে ড. সালেহ উদ্দিন আহমেদ দায়িত্ব ছাড়ার সময় ব্যাংক খাতে খেলাপি বেড়ে দাঁড়িয়েছিল ২২ হাজার ৪৮০ কোটি টাকা। অর্থাৎ এই গভর্নরের ৩ বছরের ব্যাংক খাতে খেলাপি ঋণ বেড়েছিল ২ হাজার কোটি টাকা।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্য বলছে, ১৯৯০ সালে ব্যাংক খাতের খেলাপির পরিমাণ ছিল ৪ হাজার ৬২১ কোটি টাকা। ১৯৯২ সালে ঋণ অনিয়মসহ নানা কারণে ব্যাংক অব ক্রেডিট অ্যান্ড কমার্স ইন্টারন্যাশনাল (বিসিসিআই) বিলুপ্ত হয়ে ইস্টার্ন ব্যাংক গড়ে উঠেছিল। ওই সময় ব্যাংক খাতে সুশাসন ফেরাতে বড় ধরনের পদক্ষেপের দরকার হয়ে পড়ে। পরে ১৯৯৩ সালে ব্যাংক খাতের খেলাপি বেড়ে ৮ হাজার ৫১৬ কোটি টাকায় দাঁড়ালে ব্যাংক খাতে সুশাসন ফেরাতে ১৯৯৩ সালে লেন্ডিং রিস্ক অ্যানালইসিসি (এলআরএ) ঘোষণা করে বাংলাদেশ ব্যাংক। ওই সময় গভর্নর ছিলেন খুরশিদ আলম। কিন্তু নীতিমালা জারি করেও ব্যাংকের খেলাপি কমানো যায়নি। ১৯৯৬ সালে তিনি দায়িত্ব ছাড়ার সময় ব্যাংক খাতের খেলাপি ঋণ বেড়ে দাঁড়ায় ১১ হাজার ৫৪ কোটি টাকা।
তথ্য বিশ্লেষণে দেখা যায়, আব্দুর রউফ তালুকদার, ফজলে কবির ও ড. আতিউর রহমানের সময় খেলাপি ঋণ সবচেয়ে বেশি বেড়েছে। এই তিন গভর্নরের আমলে ২২ হাজার ৪৮০ কোটি থেকে ১ লাখ ৫৬ হাজার ৩৯ কোটি টাকায় পৌঁছেছে খেলাপি। হিসাব অনুযায়ী এই তিন গভর্নরের আমলে খেলাপি বৃদ্ধির পরিমাণ ১ লাখ ৩৩ হাজার ৫৫৯ কোটি টাকা।
আব্দুর রউফ তালুকদার গভর্নর হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণ করেন ২০২২ সালের ১২ জুলাই। সে সময়ের সবশেষ তথ্যমতে, ২০২২ সালের জুন পর্যন্ত খেলাপি ঋণের আকার ছিল ১ লাখ ২৫ হাজার ২৭৫ কোটি টাকা। খেলাপি কমানের জন্য দায়িত্ব নেওয়ার কয়েক দিনের মধ্যেই ঋণ পুনঃতপশিলে বিশেষ সুবিধা দিয়ে প্রজ্ঞাপন জারি করা হয়। কিন্তু সেই নীতিমালা কোনো কাজে আসেনি। গত বছরের জুন শেষে ব্যাংক খাতের এই ক্যান্সার ১ লাখ ৫৬ হাজার ৩৯ কোটিতে পৌঁছায়। অর্থাৎ গ্রাহকের মধ্যে খেলাপি ঋণের প্রবণতা এতটাই বেড়েছে যে, সুযোগ দিয়েও এই পাগলা ঘোড়ার লাগাম টানা যাচ্ছে না। যদিও সেপ্টেম্বরে ১ লাখ ৫৫ হাজার ৩৯৭ কোটি টাকায় নেমেছে। কিন্তু দেশের বাজারে মূল্যস্ফীতি ও ডলার বাজারের অস্থিরতা এখনো সামাল দিয়ে উঠতে পারেননি তিনি।
ব্যাংকিং খাতে খেলাপি ঋণ পরিস্থিতি সম্পর্কে বেসরকারি গবেষণা সংস্থা সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) সম্মাননীয় ফেলো অধ্যাপক মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, ‘খেলাপি সংস্কৃতি দূর করতে হলে সর্বোচ্চ পর্যায়ের রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত প্রয়োজন। বাংলাদেশ ব্যাংক খেলাপি আদায়ে যেভাবে চেষ্টা করছে, তাতে মাঝে মাঝে উল্টো ফল ভোগ করছে জনগণ। এর মধ্যে সামান্য টাকা শোধ করে ঋণ পুনঃতপশিলের সিদ্ধান্ত একটি।’
তিনি বলেন, ‘দেশে যেসব আইন আছে তার যথাযথ প্রয়োগ নেই। ফলে ঋণ ফেরত না দিয়ে আবার ক্ষেত্র বিশেষে বিদেশে পাচার করেও ছাড় পেয়ে যাচ্ছেন অনেকে। এসব সমস্যা সমাধানে ব্যাংক খাতে সুশাসন, শৃঙ্খলা, স্পষ্টতা ও জবাবদিহি নিশ্চিত করতে হবে।’