ভর্তির মৌসুম এলেই রাজধানীর নামি স্কুলগুলোতে রীতিমতো হুমড়ি খেয়ে পড়েন অভিভাবকরা। পছন্দের প্রতিষ্ঠানে সন্তানকে ভর্তি করাতে অনৈতিক পথ বেছে নিতেও দ্বিধা করেন না তারা। শিশুদের শিক্ষাজীবনের শুরু থেকেই চলে এমন অসুস্থ প্রতিযোগিতা। ভিকারুননিসা নূন স্কুল অ্যান্ড কলেজসহ অনেক প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে অবৈধভাবে শিক্ষার্থী ভর্তির অভিযোগ অনেক দিনের। এবার সেই তালিকায় যুক্ত হলো আরেক নামি প্রতিষ্ঠান ঢাকা রেসিডেনসিয়াল মডেল কলেজ। এ বছর প্রতিষ্ঠানটিতে তৃতীয়, ষষ্ঠ ও নবম শ্রেণির ১২৪ শিক্ষার্থীকে অবৈধ পন্থায় ভর্তি করা হয়েছে বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে।
জানা গেছে, চলতি বছর তৃতীয়, ষষ্ঠ ও নবম শ্রেণিতে শিক্ষার্থী ভর্তির জন্য বিজ্ঞপ্তি দেয় ঢাকা রেসিডেনসিয়াল মডেল কলেজ। এতে তৃতীয় শ্রেণির প্রভাতি আবাসিক শাখার বাংলা মাধ্যমে ৯০ ও ইংরেজি ভার্সনে ৪৫ জন, দিবা অনাবাসিক শাখায় বাংলা মাধ্যমে ৯০ ও ইংরেজি ভার্সনে ৪৫ জন, বাংলা মাধ্যমে ষষ্ঠ শ্রেণির প্রভাতি আবাসিক শাখায় ৪৫ ও দিবা অনাবাসিক শাখায় ৪৫ জন, বাংলা মাধ্যমে নবম শ্রেণির প্রভাতি আবাসিক শাখায় ৪০ ও অনাবাসিক শাখায় ২৮ জন, প্রভাতি অনাবাসিক শাখায় ইংরেজি ভার্সনে ৫, দিবা অনাবাসিক শাখার বাংলা ভার্সনে ৭১ ও ইংরেজি ভার্সনে ৫ জন ভর্তি করা হবে বলে ঘোষণা দেওয়া হয়। তবে বাস্তবে ভর্তি করা হয়েছে এর চেয়ে বেশি শিক্ষার্থী।
অনুসন্ধানে জানা গেছে, তৃতীয় শ্রেণির প্রভাতি আবাসিক শাখার বাংলা মাধ্যমে অতিরিক্ত ১৬ জনসহ ১০৬, ইংরেজি ভার্সনে অতিরিক্ত ৯ জনসহ ৫৪, দিবা অনাবাসিক শাখায় বাংলা ভার্সনে অতিরিক্ত ৬৬ জনসহ ১৫৬, ষষ্ঠ শ্রেণির প্রভাতি আবাসিক শাখায় বাংলা ভার্সনে অতিরিক্ত ১১ জনসহ ৫৫, দিবা অনাবাসিক শাখায় অতিরিক্ত ১৪ জনসহ ৫৯, নবম শ্রেণির প্রভাতি আবাসিক শাখায় বাংলা ভার্সনে অতিরিক্ত ৩ জনসহ ৪৩, অনাবাসিক শাখায় অতিরিক্ত ৩ জনসহ ৩১, প্রভাতি অনাবাসিক শাখায় ইংরেজি ভার্সনে অতিরিক্ত ২ জনসহ ৭ জন শিক্ষার্থী ভর্তি করা হয়েছে। তবে দিবা অনাবাসিক শাখার বাংলা ভার্সনে ৭১ জনের জায়গায় ৬২ শিক্ষার্থী ভর্তি করা হলেও পরবর্তী সময়ে বিজ্ঞপ্তি না দিয়েই সেগুলো পূরণ করা হয়। সব মিলিয়ে অতিরিক্ত ভর্তি করা হয় ১২৪ শিক্ষার্থী।
শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের ভর্তি নীতিমালা অনুযায়ী, দেশের সরকারি ও বেসরকারি বিদ্যালয়ে প্রথম থেকে নবম শ্রেণি পর্যন্ত লটারির মাধ্যমে শিক্ষার্থী ভর্তি করাতে হবে। অন্য কোনো প্রক্রিয়ায় শিক্ষার্থী ভর্তি সম্পূর্ণ অবৈধ। গত বছর শিক্ষা সচিব সোলেমান খান স্বাক্ষরিত ভর্তি নীতিমালার ৭.২ ধারায় বলা আছে, ‘ঢাকা মহানগরীর ভর্তি কমিটি কেন্দ্রীয়ভাবে বেসরকারি মাধ্যমিক বিদ্যালয়গুলোর ভর্তি প্রক্রিয়া ডিজিটাল লটারির যাবতীয় প্রয়োজনীয় কার্যক্রম সম্পাদন করবে। বেসরকারি মাধ্যমিক বিদ্যালয়গুলোর ভর্তির আবেদন ও ফি গ্রহণ এবং ফলাফল প্রক্রিয়াকরণ ও প্রকাশ কেন্দ্রীয়ভাবে অনলাইনের মাধ্যমে সম্পন্ন করতে হবে।’
ওই নীতিমালায় আরও বলা হয়েছে, ‘ডিজিটাল লটারির মাধ্যমে নির্বাচিত শিক্ষার্থীর তালিকা প্রস্তুত করার পাশাপাশি শূন্য আসনের সমানসংখ্যক অপেক্ষমাণ তালিকাও প্রস্তুত করতে হবে। ভর্তি কমিটি কর্তৃক নির্ধারিত তারিখে নির্বাচিত শিক্ষার্থী ভর্তি না হলে অপেক্ষমাণ তালিকা থেকে তালিকার ক্রমানুসারে ভর্তির ব্যবস্থা করতে হবে। প্রকাশিত ফলের তালিকার ক্রমের ধারাবাহিকতা রক্ষা করতে হবে। শিক্ষাবর্ষের কোনো সময়ে আসন শূন্য হলে প্রকাশিত অপেক্ষমাণ তালিকা থেকে ক্রমানুসারে ভর্তি করে আসন পূরণ করতে হবে। শিক্ষাবর্ষের কোনো সময়ই এন্ট্রি/প্রথম থেকে নবম শ্রেণি পর্যন্ত শিক্ষার্থী ভর্তির ক্ষেত্রে কোনো ধরনের পরীক্ষা গ্রহণ করা যাবে না।’
নীতিমালা অনুযায়ী, ডিজিটাল লটারির মাধ্যমে শিক্ষার্থী নির্বাচিত করে তালিকা প্রস্তুত করার পাশাপাশি শূন্য আসনের সমানসংখ্যক অপেক্ষমাণ তালিকাও প্রকাশ করে ঢাকা রেসিডেনসিয়াল মডেল কলেজ। কিন্তু পরবর্তী সময়ে ‘মেধা যাচাই’-এর নামে মৌখিক পরীক্ষা নিয়ে মেধাতালিকায় থাকা অনেক শিক্ষার্থীকে বাদ দেওয়া হয়।
এ বিষয়ে কর্তৃপক্ষের ভাষ্য, ‘সম্মানীয় অনেক ব্যক্তির সন্তান এই প্রতিষ্ঠানে পড়ে। এই মুহূর্তে পাঁচজন সংসদ সদস্য ও দুজন মন্ত্রীর সন্তান পড়ছে। সে কারণে বাছাই করে শিক্ষার্থী নেওয়া হয়। শুধু লটারি করলে যে কেউ ভর্তি হয়ে যেতে পারে।’
রেসিডেনসিয়ালে লটারির মাধ্যমে করা তালিকায় স্থান পেয়েছিলেন মনিপুর উচ্চ বিদ্যালযয়ের শিক্ষার্থী নাসিফ। সাধারণ কোটায় ৩৪ জনের মধ্যে তার অবস্থান ছিল ২০। কিন্তু পরে নাসিফকে ইচ্ছা করে বাদ দেওয়া হয়েছে বলে অভিযোগ করেছেন তার বাবা ব্যাংকার শাহাবুদ্দিন আহমেদ।
তিনি কালবেলাকে বলেন, ‘অন্য সব স্কুলে লটারির মাধ্যমে ভর্তি করা হলেও এখানে মৌখিক পরীক্ষা নেওয়া হয় যোগ্য শিক্ষার্থীদের বাদ দিয়ে টাকাওয়ালাদের বাচ্চাদের ভর্তি করানোর জন্য। বিশেষ গোষ্ঠীকে সুবিধা দিতে ও তাদের বাচ্চাদের এখানে ভর্তি করানোর জন্য সাধারণ অভিভাবকদের বাচ্চাদের উল্টাপাল্টা প্রশ্ন করে নার্ভাস করে দিয়ে বাদ দেওয়া হচ্ছে। আমার ছেলে নবম শ্রেণির মেধাতালিকায় এলেও তাকে বাদ দেওয়া হয়েছে। ইচ্ছা করেই ছয় থেকে সাতজনের ভাইভা বোর্ড বসিয়ে কঠিন কঠিন প্রশ্ন করা হয়েছে। অধ্যক্ষও বাজে ব্যবহার করেছেন।’
তার অভিযোগ, ‘অপমানিত হয়ে বেরিয়ে যাওয়ার সময় ওই প্রতিষ্ঠানের স্টাফরা বলেছেন, সাড়ে ৪ লাখ টাকা করে দিলে বাচ্চা ভর্তি করানো যাবে। কেন তারা এটি বলল, তা আমার বোধগম্য নয়।’
এদিকে গত ৪ জানুয়ারি নবম শ্রেণিতে পরীক্ষা নিয়ে বেশ কয়েকজন শিক্ষার্থীকে ভর্তি করানো হয়েছে বলে অভিযোগ করেছেন প্রতিষ্ঠানটির কয়েকজন শিক্ষক, অভিভাবক ও কর্মচারী। অন্যদিকে অপেক্ষমাণ তালিকা থেকে ভর্তির জন্য ডাকা হয়নি বলে জানিয়েছেন বেশ কয়েকজন অভিভাবক।
অপেক্ষমাণ তালিকায় থাকা এক শিক্ষার্থীর অভিভাবক আসমা আঞ্জুমান জানান, তারা অপেক্ষমাণ তালিকা থেকে ভর্তি করানোর বিষয়ে কোনো বিজ্ঞপ্তি পাননি এবং তাদের সঙ্গে কোনো ধরনের যোগাযোগও করা হয়নি।
অভিভাবক ঐক্য ফোরামের সভাপতি জিয়াউল কবির দুলু বলেন, ‘শিক্ষা সচিব যে প্রতিষ্ঠানের সভাপতি সেখানে এসব ঘটনা ঘটা দুঃখজনক। তার হাত দিয়েই মন্ত্রণালয় থেকে নীতিমালা প্রকাশিত হয়। সেখানে এমন অবস্থা হলে কিছুই বলার থাকে না। এ বিষয়ে প্রধানমন্ত্রী ও শিক্ষামন্ত্রীর দৃষ্টি আকর্ষণ করছি।’
জানতে চাইলে ঢাকা রেসিডেনসিয়াল মডেল কলেজের অধ্যক্ষ ব্রিগেডিয়ার জেনারেল কাজী শামিম ফরহাদ কালবেলাকে বলেন, ‘১২৪ জনকে অবৈধভাবে ভর্তি করানোর তথ্যটি সঠিক নয়। অনেক শিক্ষার্থী ফেল করার কারণে তাদের পুনঃভর্তি নেওয়া হয়েছে। সে কারণে শিক্ষার্থীর সংখ্যা কিছুটা বেশি দেখা যাচ্ছে।’
পরীক্ষার মাধ্যমে শিক্ষার্থী ভর্তির বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘ভালো শিক্ষার্থী নেওয়ার জন্যই মেধা যাচাই করা হয়। এটাকে পরীক্ষা বলা চলে না। আর কাউকে ইচ্ছা করে বাদ দেওয়া হচ্ছে না। এখানে যারা পড়ে সেসব শিক্ষার্থী যথেষ্ট মেধাবী। অন্য শিক্ষার্থী যারা ভর্তি হয়ে আসবে, তাদের যাচাই করে নেওয়া হয় যাতে অন্যরা তাদের সঙ্গে খাপ খাওয়াতে পারে, এরাও অন্যদের সঙ্গে খাপ খাওয়াতে পারে। আবার অপেক্ষমাণ তালিকা থেকেও শিক্ষার্থী ভর্তি করা হচ্ছে। ফলাফলের বিষয়ে আমরা বেশি জোর দিই। সেজন্যই একটু কঠোর হতে হয়।’
তবে নির্ভরযোগ্য সূত্রে জানা গেছে, নবম শ্রেণিতে অল্প কয়েকজন শিক্ষার্থীকে পুনঃভর্তি করা হয়েছে। তৃতীয় ও ষষ্ঠ শ্রেণিতে কাউকে পুনঃভর্তি করা হয়নি।
এ বিষয়ে যোগাযোগ করা হলে মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা অধিদপ্তরের (মাউশি) মহাপরিচালক অধ্যাপক নেহাল আহমেদ কালবেলাকে বলেন, ‘রেসিডেনসিয়াল মডেল কলেজের বিষয়ে কোনো অভিযোগ পাইনি। অভিযোগ পেলে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’
তবে তিনি জানান, ঢাকা রেসিডেনসিয়াল মডেল কলেজ ও রাজউক উত্তরা মডেল কলেজ এখনো কেন্দ্রীয় লটারির আওতায় আসেনি। আগামী বছর থেকে তারা কেন্দ্রীয় লটারির আওতায় আসবে। তখন আর লটারি-সংক্রান্ত সমস্যা হবে না বলে আশা প্রকাশ করেন মাউশির মহাপরিচালক।
রেসিডেনসিয়াল মডেল কলেজের চেয়ারম্যান ও মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা বিভাগের সচিব সোলেমান খান এ বিষয়ে কালবেলাকে বলেন, ‘বিষয়টি আমার জানা নেই। এ নিয়ে অধ্যক্ষের সঙ্গে কথা বলব।’