দূর থেকে স্থাপত্যটি দেখলে যে কারও মনে হবে এটি একটি প্রাচীন জমিদারবাড়ি। ব্রিটিশ স্থাপত্যের আদলে তৈরি এ স্থাপত্যটি ঘুরে দেখতে ভেতরে প্রবেশ করলেই ভেঙে যাবে এ ধারণা। কারণ, এটি আদতে একটি মন্দির। পঞ্চগড়ের দেবীগঞ্জে অবস্থিত এ মন্দিরটির নাম জগবন্ধু ঠাকুরবাড়ি মন্দির। ১৯১৪ সালে কুচবিহারের মহারাজা নৃপেন্দ্র নারায়ণ ভূপ বাহাদুর এটি নির্মাণ করেন।
দেবীগঞ্জ পৌরসদরের চৌরাস্তা থেকে করতোয়া সেতুর দিকে যাওয়ার পথে এশিয়ান মহাসড়ক সংলগ্ন মধ্য পাড়ায় ১ একর ৪ শতাংশ জমির ওপর জগবন্ধু ঠাকুরবাড়ি নির্মাণ করা হয়। ব্রিটিশ স্থাপত্যের সঙ্গে মিল রেখে ইট, সুরকি, চুন, পাথর ও লোহার সমন্বয়ে জমিদারবাড়ির আদলে এটি নির্মাণ করা হয়।
মন্দিরের মূল ভবনে প্রবেশের জন্য রয়েছে একটি গোলাকৃতির প্রবেশদ্বার, যার উভয় পাশে রয়েছে উঁচু দুটি পিলার এবং বাঁ দিকে পুরোহিত প্রবেশের জন্য আরও একটি ছোট প্রবেশদ্বার। মন্দিরের ভেতরে আলো-বাতাস চলাচলের জন্য গোলাকৃতির আটটি জানালা রয়েছে। মন্দিরের ভেতরে রয়েছে তিনটি কক্ষ। ডান দিকের কক্ষে দেবী কালীর প্রতিমা, মাঝের কক্ষে দেবী দুর্গার এবং বাঁ দিকের কক্ষে কৃষ্ণ ঠাকুরের প্রতিমা রয়েছে।
মন্দিরের পেছনের অংশে পূজা অর্চনা ও রক্ষণাবেক্ষণের কাজে নিয়োজিত পুরোহিতের থাকার জায়গা এবং মন্দির কমিটির কার্যালয়, মন্দিরের ডানে
দুর্গাপূজার স্থায়ী মণ্ডব, সামনে বিস্তীর্ণ ফাঁকা মাঠ এবং চতুর্দিকে ইটের সীমানা প্রাচীর দিয়ে ঘেরা ঐতিহাসিক এ মন্দির।
লোকমুখে প্রচলিত কুচবিহারের মহারাজার ম্যানেজার হাতির পিঠে ভজনপুর তহশিলে যাওয়ার সময় শালডাঙ্গার জঙ্গলে একটি পিতলের ভাঙা মূর্তি দেখতে পান। মূর্তিটি ছিল দুর্গা দেবীর। ম্যানেজার মূর্তিটি নিয়ে দেবীগঞ্জে ফিরে আসেন এবং মহারাজার কাছে বিষয়টি জানান। মহারাজা ভাঙা মূর্তিটি কাশি থেকে অষ্টধাতু দ্বারা মেরামত করে এনে ১৯১৪ সালে জগবন্ধু ঠাকুরবাড়ির নির্মাণ করে সেখানে তা স্থাপন করেন। ধারণা করা হয়, শালডাঙ্গায় প্রাপ্ত এই মূর্তিটি দেবী চৌধুরাণী ও ভবানী পাঠকের আন্দোলনের সময় তাদের উপাসনার জন্য গভীর জঙ্গলের স্থাপিত হয়েছিল।
প্রতি বছর বৃহৎ পরিসরে সনাতন ধর্মাবলম্বীদের সব থেকে বড় ধর্মীয় উৎসব দুর্গাপূজার আয়োজন হয় জগবন্ধু ঠাকুরবাড়িতে। দুর্গাপূজার সময় মন্দির প্রাঙ্গণে বসে সপ্তাহব্যাপী মেলা। এ ছাড়া সরস্বতী পূজা, লক্ষ্মীপূজা, কালীপূজাসহ সনাতন ধর্মের অন্যান্য ধর্মীয় আচার-অনুষ্ঠান এখানে হয়।
জগবন্ধু ঠাকুরবাড়ি মন্দিরের পুরোহিত জীবন চক্রবর্তী বলেন, এই মন্দিরটি অনেক পুরোনো ও ঐতিহ্যবাহী। প্রতিষ্ঠার পর থেকে ১১০ বছর ধরে নিয়মিত পূজা-অর্চনা হয় এখানে। এ ছাড়া প্রতিদিন গীতাপাঠ এবং প্রতি শুক্র ও শনিবার ধর্মীয় আলোচনা হয়।
শতবছরের পুরোনো ঐতিহাসিক জগবন্ধু ঠাকুরবাড়ি মন্দির দেখতে প্রতিদিন দূরদূরান্ত থেকে মানুষ আসেন দেবীগঞ্জে। কুমার অংকন সাহা নামে স্থানীয় এক যুবক জানায়, শতবছরের পুরোনো জগবন্ধু ঠাকুরবাড়ি মন্দিরটি ইতিহাস ও ঐতিহ্যকে ধারণ করে আছে। প্রতি বছর পঞ্চগড় জেলার সব থেকে বড় দুর্গাপূজার আয়োজন হয় এখানে।
১১০ বছর আগে নির্মিত জগবন্ধু ঠাকুরবাড়ি মন্দিরটির বেশকিছু স্থানে ফাটল ধরেছে। মন্দিরটি টিকিয়ে রাখতে প্রয়োজন সংস্কার। এ বিষয়ে জগবন্ধু ঠাকুরবাড়ি মন্দিরের দুর্গাপূজা উদযাপন কমিটির সভাপতি শুভ্রাংশু শেখর রায় (শুভ) বলেন, এটি পঞ্চগড় জেলার অন্যতম প্রাচীন এবং বৃহৎ মন্দির। মন্দিরটির সংস্কার করতে হবে। বেশকিছু স্থানে ফাটল দেখা দিয়েছে। সরকারের কাছে আমাদের দাবি,Ñ ঐতিহ্যবাহী এ মন্দিরটি সংস্কারের প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করা হোক। এতে আগামী প্রজন্ম এ মন্দিরের ইতিহাস-ঐতিহ্য সম্পর্কে জানতে পারবে।