অনুমাননির্ভর চাহিদার ভিত্তিতে চলছে দেশের বিদ্যুৎ ব্যবস্থাপনা। এ কারণে বাংলাদেশ বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড (পিডিবি) দৈনিক লোডশেডিংয়ের যে হিসাব দিচ্ছে তার সঙ্গে মাঠ পর্যায়ের বাস্তবতার মিল থাকছে না। পিডিবির হিসাবে বর্তমানে দিনে এক হাজার মেগাওয়াটের মতো লোডশেডিং হচ্ছে। অথচ মাঠ পর্যায়ে বিদ্যুতের ঘাটতির পরিমাণ দুই থেকে আড়াই হাজার মেগাওয়াট। এ কারণেই পিডিবির দেওয়া তথ্য নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন এ খাতের বিশেষজ্ঞরা। এমন পরিস্থিতিতে দেশের বিদ্যুতের চাহিদা ও সরবরাহের প্রকৃত হিসাব নিরূপণের জন্য লোড অ্যাসেসমেন্ট করার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে বলে জানিয়েছেন পিডিবির সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা।
পিডিবির এক কর্মকর্তা জানান, এ মুহূর্তে পিডিবির কাছে দেশে বিদ্যুতের চাহিদার সঠিক কোনো তথ্য নেই। অনুমাননির্ভর চাহিদার প্রাক্কলন করা হয়, যা প্রকৃত চাহিদা থেকে অনেক কম। গ্রামাঞ্চলে লোডশেডিং বেশি করা হচ্ছে। অনেক এলাকায় ১০ থেকে ১২ ঘণ্টা বিদ্যুৎ থাকছে না। গ্রামাঞ্চলে বিদ্যুৎ সরবরাহের দায়িত্বে থাকা পল্লী বিদ্যুতায়ন বোর্ড (আরইবি)-এর যে পরিমাণ চাহিদা তার চেয়ে কম বলা হয়ে থাকে সবসময়।
জানা গেছে, শিগগিরই জোনভিত্তিক লোড অ্যাসেসমেন্ট করবে পিডিবি। শুরুতে ময়মনসিংহ, কুমিল্লা ও ঢাকা জোনে কাজটি শুরু হবে। পর্যায়ক্রমে সারা দেশে লোড অ্যাসেসমেন্ট করা হবে।
পিডিবির সদস্য (বিতরণ) মো. রেজাউল করিম কালবেলাকে বলেন, ‘সারা দেশে আমরা জোনভিত্তিক লোড অ্যাসেসমেন্ট করব। এরই মধ্যে বোর্ডে এটি অনুমোদন পেয়েছে।’
শিগগির কাজ শুরু হবে উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘লোড অ্যাসেসমেন্টের কাজ শেষ হলে জোনভিত্তিক চাহিদা ও সরবরাহের প্রকৃত চিত্র জানা যাবে। বিদ্যুৎ ঘাটতির তথ্যে বিভ্রাট থাকার কথা স্বীকার করেন তিনি।’
জানা গেছে, অনেক কেন্দ্রের সক্ষমতা থাকা সত্ত্বেও জ্বালানির অভাবে সে অনুযায়ী বিদ্যুৎ উৎপাদন করা যাচ্ছে না। গত এক সপ্তাহ দেশব্যাপী লোডশেডিংয়ের মাত্রা বেড়েছে। গরম শুরুর আগে থেকে গ্রামাঞ্চলে অল্প-স্বল্প লোডশেডিং ছিল। এখন তা মাত্রাতিরিক্ত। পাশাপাশি রাজধানী ঢাকায়ও শুরু হয়েছে লোডশেডিং। গ্রামাঞ্চলে লোডশেডিংয়ের কথা পল্লী বিদ্যুতায়ন বোর্ড (আরইবি) স্বীকার করলেও রাজধানীর বিতরণ কোম্পানিগুলো তা স্বীকার করে না। লোডশেডিংয়ে তারা ‘কারিগরি সমস্যা’ হিসেবে উল্লেখ করে।
গত বৃহস্পতিবার পিডিবির উৎপাদন ও সরবরাহের তথ্য বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, এদিন সারা দেশে চাহিদা ধরা হয়েছিলে ১৫ হাজার ১৯১ মেগাওয়াট। আর সরবরাহ করা হয়েছে ১৪ হাজার ৯১৩ মেগাওয়াট। লোডশেডিং হয়েছে ২৭৮ মেগাওয়াট।
একই দিন পাওয়ার গ্রিড কোম্পানি অব বাংলাদেশের (পিজিসিবি) বিদ্যুৎ সরবরাহের চিত্র বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, এদিন সারা দেশে চাহিদা ছিল ১৪ হাজার ৯৯১ মেগাওয়াট। আর সরবরাহ করা হয়েছিল ১৪ হাজার ৫২৩ মেগাওয়াট। লোডশেডিং করা হয়েছে ৪৮৬ মেগাওয়াট। সরকারি দুটি সংস্থার হিসাব একেবারেই ভিন্ন।
জানা গেছে, এখন আরইবির নিয়ন্ত্রিত এলাকার বিদ্যুতের চাহিদা ৯ হাজার ৮০০ মেগাওয়াট। এর বিপরীতে আরইবি পাচ্ছে কম বেশি ৭ হাজার ২০০ মেগাওয়াট। ঘাটতি থাকছে ১৬শ মেগাওয়াট। অথচ পিডিবির হিসাবে সারা দেশে মোট ঘাটতিই ১ হাজার মেগাওয়াট।
আরইবির পরিচালক (কারিগরি) রফিকুল ইসলাম এ প্রসঙ্গে কালবেলাকে বলেন, ‘গ্রামাঞ্চলে লোডশেডিং বেশি। কারণ পিডিবি থেকে চাহিদা অনুযায়ী বিদ্যুতের সরবরাহ পাচ্ছি না। দেড় থেকে দুই হাজার মেগাওয়াট আমাদের ঘাটতি থেকে যাচ্ছে। এ কারণেই লোডশেডিং করতে হচ্ছে।’
পিজিসিবির বিদ্যুৎ উৎপাদন ও সরবরাহ চিত্র থেকে প্রাপ্ত তথ্যানুযায়ী, গতকাল শনিবার বিকেল ৩টায় সারা দেশে চাহিদা ছিল ১৫ হাজার ২৫০ মেগাওয়াট। উৎপাদন করা হয়েছে ১৮ হাজার ২৫ মেগাওয়াট। এই সময় লোডশেডিং ছিল ১ হাজার ১৭০ মেগাওয়াট। এর মধ্যে গ্যাসে উৎপাদন করা হয়েছে ৭ হাজার ২১৯ মেগাওয়াট, জ্বালানি তেলে ২ হাজার ১৬০ মেগাওয়াট, কয়লায় ৩ হাজার ২৬৪ মেগাওয়াট, জলবিদ্যুৎ ৩০ মেগাওয়াট, সৌরবিদ্যুৎ ২৮৪ মেগাওয়াট, বায়ু বিদ্যুৎ ৭ মেগাওয়াট এবং ভারত থেকে আমদানি ৯২৯ মেগাওয়াট।
পিডিবি সূত্রে জানা গেছে, অনেক এলাকায় বিদ্যুতের চাহিদা কয়েকগুণ বেড়ে গেছে। তাই পুনরায় লোড অ্যাসেসমেন্ট করার উদ্যোগ নিয়েছে পিডিবি। কাজটি শুরু হবে ময়মনসিংহ দিয়ে। কারণ ওই অঞ্চলে লোডশেডিং সবচেয়ে বেশি হয়। সেখানে বিদ্যুতের সঠিক চাহিদার হিসাব পিডিবির কাছে নেই। গত শুক্রবার ময়মনসিংহে ১৩৯ মেগাওয়াট লোডশেডিং করা হয়েছে বলে পিডিবি থেকে বলা হলেও প্রকৃত পরিমাণ আরও বেশি। এ অবস্থায় ময়মনসিংহ অঞ্চলে বিদ্যুৎ সরবরাহ বাড়াতে বিদ্যমান ১৩২ কেভি সঞ্চালন লাইনকে ২৩০ বা ৪০০ কেভিতে উন্নীত করার পরিকল্পনা করা হচ্ছে। এরপর কুমিল্লা অঞ্চলেও একই পদক্ষেপ নেওয়া হবে। পরে পর্যায়ক্রমে দেশের অন্যান্য অঞ্চলেও একইভাবে লোড অ্যাসেসমেন্ট করা হবে।