মানুষ স্বভাবতই ঘুরতে চায়। সেজন্যই পাহাড়, ঝরনা, সাগর, নদী, সৈকত, বন, প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন, ঐতিহাসিক স্থাপনা মানুষকে টানে। সেই টানে হয়তো বারবার ছুটে যায় এসবের কাছে। অনেকেই ছুটে চলেন প্রত্নতত্ত্বের মায়া ছুঁতে। তেমনি ভ্রমণপিপাসুদের এক পছন্দের স্থান হচ্ছে কুমিল্লার লালমাই উপজেলার ২৫ কিলোমিটারের প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শনগুলো। যা ঘিরে গড়ে উঠেছে সেনানিবাস, ক্যাডেট কলেজ, ল্যাবরেটরি, শিক্ষক প্রশিক্ষণ কেন্দ্র, বিশ্ববিদ্যালয়, ট্রেনিং সেন্টারসহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান।
লালমাইয়ের এই লালচে মাটিতে ১৯৪৩ সালে ৫৬টি প্রত্নতাত্ত্বিক স্থাপনা চিহ্নিত হয়। এরপর সেগুলোর খনন শুরু হলেও শেষ করতে পারেনি ব্রিটিশ সরকার। এতে ধীরে ধীরে অধিকাংশ প্রত্ন-নিদর্শন বিলুপ্ত হতে থাকে। বর্তমানে ২৪টি প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন সংরক্ষণে আছে বলে জানিয়েছেন প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তর চট্টগ্রাম ও সিলেট বিভাগের কুমিল্লার আঞ্চলিক পরিচালক এ কে এম সাইফুর রহমান।
তিনি বলেন, এগুলো দেশের উত্তর-পূর্ব ও দক্ষিণ-পূর্ব অঞ্চলের সংস্কৃতি, ইতিহাস ও ঐতিহ্য। এর মধ্যে এখন পর্যন্ত ১৪টি স্থাপনা খনন করা হয়েছে। টিকিটের আওতায় আনা হয়েছে বেশ কিছু স্থান। সেখান থেকেই বার্ষিক রেভিনিউ আসে এক কোটি টাকারও বেশি। টিকিটের আওতায় আসা স্থাপনাগুলোর মধ্যে রয়েছে শালবন বিহার, ময়নামতি জাদুঘর, ইটাখোলা মুড়া মন্দির ও বিহার এবং রূপবান মুড়া মন্দির ও বিহার। বাকি স্থাপনাগুলোকে অবকাঠামোগত কারণ ও ভৌগোলিক অবস্থানের কারণে এখনো টিকিটের আওতায় আনা সম্ভব হয়নি বলে জানিয়েছেন কাস্টোডিয়ান শাহিন আলম। তিনি আরও বলেন, কুমিল্লায় ১৯৫৬ সাল থেকে এখন পর্যন্ত ১৪টি প্রত্নতাত্ত্বিক স্থাপনা খনন করা হয়েছে। খননকৃত উল্লেখযোগ্য স্থাপনার মধ্যে রয়েছে শালবন বিহার, রূপবান মুড়া, ইটাখোলা মুড়া, লতিকোট মুড়া, আনন্দ বিহার, কুটিলা মুড়া, চারপত্র মুড়া, রূপবান কন্যা মুড়া (রূপবানী মুড়া), হাতিগাড়া মুড়া, ভোজ রাজার বিহার, রানী ময়নামতির প্রাসাদ ও সতেরো রত্নের মন্দির।
ধারণা করা হয়, সপ্তম শতাব্দীর শেষ থেকে অষ্টম শতাব্দীর প্রথম ভাগে দেব বংশের চতুর্থ রাজা শ্রীভবদেব এ বৌদ্ধবিহার নির্মাণ করেন। শালবন বিহারের ছয়টি নির্মাণ ও পুনর্নির্মাণ পর্বের কথা জানা যায়। অষ্টম শতাব্দীর মধ্যে তৃতীয় পর্যায়ে কেন্দ্রীয় মন্দিরটি নির্মাণ করা হয় ও বিহারটির সার্বিক সংস্কার হয় বলে অনুমান করা হয়। চতুর্থ ও পঞ্চম পর্যায়ের নির্মাণকাজ ও সংস্কার কাজ সম্পন্ন হয় নবম-দশম শতাব্দীতে। তবে পরিচর্যার অভাবে অধিকাংশ স্থাপনা ক্ষয় হয়ে যাচ্ছে।
হাবিবা নামে ঘুরতে আসা এক দর্শনার্থী বলেন, প্রত্নতাত্ত্বিক এই নিদর্শনগুলো অবশ্যই সুন্দর ও ইতিহাসলব্ধ। কিন্তু এখানে বিশ্রাম নেওয়ার মতো কোনো জায়গা নেই, এমনকি ওয়াশরুমও নেই। পরিবার নিয়ে ঘুরতে আসা সাইফুল নামে আরেক দর্শনার্থী বলেন, এখানে গেস্ট রুম থাকলে ভালো হতো। আর এখানকার রিসোর্টগুলোতে খাবারের দাম অনেক। সংস্কৃতি মন্ত্রণালয় যদি এগুলোর দিকে মনোযোগ দেয়, তাহলে বাংলাদেশের পর্যটন খাত আরও সমৃদ্ধ হবে।
প্রত্নতত্ত্ব বিভাগের শিক্ষার্থী জান্নাতুন নাইম বলেন, এসব স্থাপনায় পাওয়া বিভিন্ন প্রত্ননিদর্শন (মন্দির, মূর্তি, মুদ্রা, পোড়ামাটির ফলক, মৃৎপাত্র) সে সময়ের ইতিহাস সম্পর্কে বিস্তারিত জানতে সাহায্য করে। প্রত্ননিদর্শনগুলো নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। অথচ কর্তৃপক্ষ সেদিকে নজর দিচ্ছে না। কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়ের সামজিক বিজ্ঞান অনুষদের ডিন ও প্রত্নতত্ত্ব বিভাগের চেয়ারম্যান ড. সোহরাব উদ্দিন সৌরভ বলেন, এসব স্থান থেকে বর্তমানে যে অবস্থায় কোটি টাকা আয় হয়, সেখানে রক্ষণাবেক্ষণ করলে এখান থেকেই হাজার কোটি টাকা আয় করা কোনো ব্যাপার না। তিনি আরও বলেন, বিশ্বের বিভিন্ন দেশের যে মিউজিয়াম, জাদুঘর, প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন আছে সেগুলো রক্ষা করার জন্য সরকারের নির্দিষ্ট বাজেট দেয়। সেগুলোর সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেওয়ার জন্য মানুষও আছে। তবে দুঃখের বিষয় আমাদের দেশে তা হয়ে ওঠে না।
৫৬টি নিদর্শন থেকে ২৪টি কেন সংরক্ষণ করা হয়েছে জানতে চাইলে কুমিল্লার আঞ্চলিক পরিচালক এ কে এম সাইফুর রহমান বলেন, তখন কিছু নিদর্শন দেখে চিহ্নিত করা হয়েছিল। পরে আমরা পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে বাদ দিয়েছি। এ ছাড়া, কিছু কিছু স্থানে, মানুষের বসতভিটা, মসজিদ গড়ে উঠেছে; যার কারণে সব সংরক্ষণ করা সম্ভব হয়নি।