কখনো ক্র্যাশ প্রোগ্রাম, কখনো চিরুনি অভিযান, আবার কখনো বিশেষ অভিযান। সপ্তাহ বা মাসব্যাপী এসব অভিযান মূলত মশা মারতে। তবে জটিল নামধারী এসব অভিযান যে নিষ্ফল, তার প্রমাণ মেলে ডেঙ্গুর ভয়াবহতা দেখে। মশার লার্ভা নিধনে লার্ভিসাইডিং এবং উড়ন্ত মশক নিধনে ফগিং কার্যক্রম চলছে প্রায় দুইযুগ ধরে। পাশাপাশি নগরবাসী দেখেছে, জলাশয়ে নোভালরুন ট্যাবলেট, হাঁস, ব্যাঙ ও গাপ্পি মাছ ছাড়া, এমনকি কদমগাছ লাগিয়ে ফিঙে পাখির আগমন ঘটিয়ে উড়ন্ত মশা মারার চেষ্টাও। এ ছাড়া ড্রোন প্রযুক্তি ব্যবহার করে দুর্গম জলাশয়ে ওষুধ ছিটানো ও মশার উৎসস্থলও চিহ্নিত করেছে ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশন (ডিএনসিসি)। মশক নিয়ন্ত্রণে প্রশিক্ষণ নিতে একাধিকবার বিদেশেও গেছে প্রতিনিধিদল। ফিরে এসে জানিয়েছে, এতদিন ভুল পদ্ধতিতে মশা মারার চেষ্টা করছে দুই সিটি করপোরেশন। তাই এবার মশার লার্ভা ধ্বংস করতে ব্যাসিলাস থুরিনজিয়েনসিস ইসরাইলেন্সিস (বিটিআই) নামের ব্যাকটেরিয়ার দারস্থ হচ্ছে ডিএনসিসি।
ডিএনসিসির স্বাস্থ্য বিভাগ জানিয়েছে, বিটিআই এক ধরনের ব্যাকটেরিয়া। মশার লার্ভা ধ্বংস করে এটি। এর বৈশিষ্ট্য হলো, এতে মানুষের কোনো ক্ষতি হবে না। এমনকি পানিতে প্রয়োগ করলে অন্য জলজ প্রাণীরও ক্ষতি হয় না। বিটিআইর পরীক্ষামূলক কার্যক্রম শেষে শতভাগ কার্যকর ফলাফল পাওয়া গেছে। আগামী রোববার ৪ টন ওষুধ পৌঁছাবে সংশ্লিষ্টদের হাতে। আমাদানি করা এ বিটিআই বন্দরে এসে এখন কাস্টমসের পরীক্ষার অপেক্ষায় আছে। মশক নিয়ন্ত্রণে খুব শিগগিরই লার্ভিসাইডিংয়ের মাধ্যমে এ ওষুধ প্রয়োগ শুরু হবে।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বিটিআই প্রাকৃতিক, সাশ্রয়ী এবং টেকসই। এটি মূলত পেটের বিষক্রিয়াসহ মাইক্রোবায়াল উৎসের একটি নিম্ন-বিষাক্ত কীটনাশক হিসেবে ব্যবহার করা যায়। ব্যাকটেরিয়াটি বড় টক্সিন তৈরি করতে পারে, যা কীট-পতঙ্গের খাওয়া বন্ধ করে দেয়।
ডিএনসিসির স্বাস্থ্য বিভাগের কর্মকর্তারা জানান, বিটিআই লার্ভাকে খুব সহজেই ধ্বংস করে দিতে সক্ষম। জমে থাকা পানি, জলাধার বা ড্রেনে অর্থাৎ মশার লার্ভার জন্মস্থানে লার্ভিসাইটের মাধ্যমে বিটিআই প্রয়োগ করা হয়। ফলে লার্ভা ব্যাকটেরিয়াগুলো খেয়ে ফেলে। বিটিআই যখন লার্ভার পরিপাকতন্ত্রে যায়, এর বিষক্রিয়া লার্ভার পরিপাকতন্ত্র ধ্বংস করে ফেলে। লার্ভা পরে আর কিছুই খেতে পারে না। এক পর্যায়ে না খেয়েই লার্ভাগুলো মরে যায়।
ডিএনসিসি জানায়, প্রায় ২ বছর ধরেই ব্যাকটেরিয়া বিটিআই দিয়ে মশার লার্ভার ধ্বংস করার বিষয়ে বিভিন্ন কীটতত্ববিদদের সঙ্গে বৈঠক করেছেন সংস্থাটির স্বাস্থ্য বিভাগের কর্মকর্তারা। সর্বশেষ যুক্তরাষ্ট্রের মিয়ামি শহর পরিদর্শনে গিয়ে গত ২১ জানুয়ারি ঢাকায় মশা নিধনের পদ্ধতিতে ভুল রয়েছে বলে জানান ডিএনসিসি মেয়র আতিকুল ইসলাম।
পরে মেয়র আতিক মিয়ামির মশক নিধন কার্যক্রম নিয়ে স্বাস্থ্য কর্মকতাদের সঙ্গে আলোচনা করেন। সেখানে বিটিআই দিয়ে লার্ভা ধ্বংসের চিত্র তুলে ধরে তিনি স্বাস্থ্য কর্মকর্তাদের ব্রিফ করেন এবং অতি দ্রুত পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে বিটিআই মাঠপর্যায়ে লার্ভিসাইডিংয়ের জন্য প্রস্তুত করার নির্দেশ দেন। এর পরেই জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের ল্যাবে প্রথমে বিটিআইর কার্যকারিতা পরীক্ষা করা হয়। ২২ ফ্রেব্রুয়ারি ল্যাব পরীক্ষায় এর শতভাগ কার্যকারিতার প্রতিবেদন পাওয়া যায়। পরে ১২ থেকে ১৯ মার্চের মধ্যে গুলশান লেক, উত্তরা ৪ নম্বর সেক্টরের লেক ও বারিধারায় একটি ড্রেনে লার্ভিসাইটিং করে ৩ দফায় এর কার্যকারিতা ফের পরীক্ষা করা হয়। এসব জায়গায় ট্রায়ালের পরেও শতভাগ সাফল্য পাওয়া যায়।
যুক্তরাষ্ট্রের রোগনিয়ন্ত্রণ ও প্রতিরোধ সংস্থার (সিডিসি) তথ্য অনুযায়ী, বড়ি, তরল, গুলি, পাউডার ইত্যাদি নানা ফর্মুলেশনে বিটিআই পাওয়া যায়। জমে থাকা পানি, বিভিন্ন পাত্রে থাকা পানিসহ পুকুর, নর্দমা, ড্রেন, ডোবা বা যে কোনো স্থানে প্রয়োগ করা যায়। এ লার্ভানাশক যানবাহন, উড়োজাহাজ, হাতেচালিত স্প্রে মেশিনের মাধ্যমে ছড়িয়ে দেওয়া যেতে পারে। যুক্তরাষ্ট্রের এনভায়রনমেন্টাল প্রটেকশন এজেন্সি অনুমোদিত, এটি পরিবেশের জন্য ক্ষতিকর নয়। মানুষ, পোষা প্রাণী বা অন্য প্রাণী, জলজ প্রাণী ও মৌমাছির জন্য ক্ষতিকর নয়।
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক কবিরুল বাশার কালবেলাকে বলেন, বিটিআই একটি ব্যাকটেরিয়া। এটি সারা বিশ্বে নিয়মিত মশা নিয়ন্ত্রণ এবং এগ্রিকালচারে ব্যবহৃত হয়। এর সবচেয়ে ভালো দিক হলো এর গন্ধ নেই। মানুষের স্বাস্থ্য ও পরিবেশের জন্যও ক্ষতিকর কিছুই নেই।
তিনি বলেন, ডিএনসিসিতে অনেকদিন ধরেই লার্ভিসাইডিংয়ে টেমিফস ব্যবহৃত হচ্ছে। অনেক দিন ধরে ব্যবহারের ফলে এতে মশা সহনশীল হয়ে যায়। তখন এটি পরিবর্তন করে নতুন কিছু প্রয়োগ করা খুবই জরুরি। এ কারণেই আমরা অনেক বিবেচনা করে বিটিআই সিলেক্ট করেছি। ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনও পরীক্ষামূলকভাবে কিছু অংশে বিটিআই ব্যবহার করবে দুটি সভায় এ সিদ্ধান্ত ছিল। পরে আর তা কার্যকর করা হয়নি।
ডিএনসিসির উপপ্রধান স্বাস্থ্য কর্মকর্তা লে. কর্নেল গোলাম মোস্তফা সারওয়ার বলেন, বিটিআই ট্রায়ালের আগে প্রথমেই আমরা দেখেছি লার্ভা জন্মানোর সম্ভাব্য স্থানগুলোয় লার্ভা আছে কি না। পরে সেখানে বিটিআই প্রয়োগ করলাম। সকালবেলা প্রয়োগের পর বিকেলে দেখেছি সেখানে কোনো লার্ভা নেই। সারা পৃথিবীতেই মশক নিয়ন্ত্রণে বিটিআই ব্যবহার করা হয়।
মন্তব্য করুন