স্বর্ণের গহনার আবেদন কখনোই ফুরায় না। এটি শুধু অলংকারই নয়—ব্যক্তিত্ব প্রকাশ, স্টাইল স্টেটমেন্ট এবং আর্থিক বিনিয়োগ হিসেবেও যুগে যুগে জনপ্রিয়। সময়ের সঙ্গে বদলেছে এর রূপ, ডিজাইন ও পরিধানের ধরন। বিশেষ করে আধুনিক কর্মজীবী নারীদের কাছে এখন স্বর্ণের গহনা শুধু উৎসব বা বিয়ের সাজের অনুষঙ্গ নয়; বরং এটি দৈনন্দিন অফিস বা ক্যাজুয়াল পোশাকেও মানানসই ফ্যাশন উপাদান হয়ে উঠেছে। স্বর্ণের গহনার নানান দিক নিয়ে লিখেছেন—বৃষ্টি শেখ খাদিজা
গহনার ইতিহাস হাজার বছরের পুরোনো। প্রাচীন সভ্যতা মিশর, মেসোপটেমিয়া, সিন্ধু উপত্যকা—সবখানেই স্বর্ণের গহনার ব্যবহার ছিল উচ্চশ্রেণির প্রতীক। মিশরের রানি ক্লিওপেট্রা স্বর্ণ ও রত্নপাথরে মোড়া অলংকার পরতেন, যা আজও অনুপ্রেরণা হয়ে রয়েছে ডিজাইনারদের কাছে। উপমহাদেশে স্বর্ণের গুরুত্ব ছিল ধর্মীয়, সাংস্কৃতিক ও সামাজিক পরিপ্রেক্ষিতে। হিন্দু শাস্ত্রেও স্বর্ণকে ‘শ্রী’ বা লক্ষ্মীর প্রতীক হিসেবে দেখা হয়। বাংলার গহনাশিল্পের ইতিহাসও ঐতিহ্যবাহী—নকশি কাঁকন, ঝুমকা, টিকলি, বালা, চুড়ি—এসবের সূক্ষ্ম কারুকার্য আমাদের সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য বহন করে।
আজকের আধুনিক নারীরা শুধু ঘর নয়, অফিস আর সামাজিক জীবনেও সমান সাবলীল। ব্যস্ত এই জীবনযাপনে একসঙ্গে ফ্যাশন ও ফাংশনালিটি মেলানো জরুরি। তাই দরকার এমন গহনা, যা অফিসের পর বন্ধুদের সঙ্গে গেট-টুগেদার কিংবা পারিবারিক অনুষ্ঠানে সামান্য পরিবর্তনে মানিয়ে যায় অনায়াসে।
বর্তমানে কর্মজীবী নারীরা এমন গহনা খোঁজেন যা হালকা, স্টাইলিশ ও বহুমুখী। সকাল ৯টার অফিস মিটিং হোক বা সন্ধ্যার ক্যাজুয়াল আড্ডা—একই গহনাতে যেন চলা যায় সব জায়গায়।
অফিস লুক থাকুক
সাদাসিধে কিন্তু স্টাইলিশ
অফিস পরিবেশে গহনা হওয়া উচিত হালকা, মার্জিত ও প্রফেশনাল। এজন্য প্রাধান্য দিতে পারেন স্লিম চেইন, ছোট পেনডেন্ট, মিনিমাল গোল্ড স্টাড ইয়াররিংস বা ছোট হুপস, হালকা ব্রেসলেট বা ঘড়ি স্টাইল ব্যাঙ্গেল এবং হালকা নকশার তৈরি আংটি। ফরমাল শার্ট/টপস/প্যান্ট/সালোয়ার-কামিজ/শাড়ি হালকা রঙের পোশাকের সঙ্গে প্রতিদিন গোল্ড বা হোয়াইট গোল্ডের তৈরি গহনা বেশ মানিয়ে যায়।
আড্ডা বা ক্যাজুয়াল আউটিংয়ে
যোগ করুন একটু গ্ল্যাম
অফিসের পরের সময় মানেই নিজের মতো করে সময় কাটানো। তখন চাই একটু স্টাইলিশ ছোঁয়া। এ ক্ষেত্রে অফিসে যাওয়ার সময় যে মিনিমাল চেইনে ব্যবহার করেন, তার সঙ্গে যোগ করুন ড্যাংলি পেনডেন্ট, স্টাড ইয়াররিং বদলে ছোট ঝুমকা বা হ্যাংগিং ইয়াররিং, ব্রেসলেটের সঙ্গে আরেকটি ব্যাঙ্গেল বা চুড়ি যোগ করুন, একাধিক আংটি পরা যেতে পারে।
পোশাক হিসেবে বেছে নিতে পারেন কুর্তির সঙ্গে পালাজো, স্টাইলিশ শাড়ি। পোশাকের রং উজ্জ্বল হলে ইয়েলো গোল্ড মানায়, হালকা রঙে রোজ গোল্ড বা হোয়াইট গোল্ড।
বিয়ে বা সামাজিক অনুষ্ঠানের গহনায় থাকুক গ্ল্যামার ও ঐতিহ্য
বিয়ে, জন্মদিন, এনগেজমেন্ট বা পারিবারিক দাওয়াতে গহনার গ্ল্যামার একটু বেশিই দরকার। হেরিটেজ ডিজাইনের সোনার ঝুমকা বা চাঁদবালি, চোকার, লেয়ারড নেকলেস কম্বো, জমকালো চুড়ি বা ঐতিহ্যবাহী বালা, পাথর বসানো বা এমবেলিশড আংটি বেছে নিতে পারেন।
এতে করে গ্ল্যামারের পাশাপাশি ঐতিহ্যের সংমিশ্রণও হয়ে যাবে। সিল্ক শাড়ি, লেহেঙ্গা, হেভি কুর্তি বা আনারকলি গহনার সঙ্গে পোশাকের কাজ ও রং মিলিয়ে নিতে হবে (যেমন, লাল-সোনালি পোশাকে ইয়েলো গোল্ড, হালকা পিচ বা প্যাস্টেল রঙে রোজ গোল্ড)।
স্বর্ণের গহনায় বিনিয়োগ
কতটা যৌক্তিক
যেভাবে স্বর্ণের দাম বিশ্ববাজারে প্রতিনিয়ত বাড়ছে, তাতে স্বর্ণ শুধু অলংকার নয়, একটি আর্থিক বিনিয়োগও। বর্তমানে (২০২৫ সালের অক্টোবর পর্যন্ত) প্রতি ভরিতে স্বর্ণের দাম ২ লাখ টাকা ছাড়িয়ে গেছে। গত এক দশকে স্বর্ণের দাম প্রায় দ্বিগুণ হয়েছে। তাই দামি এ ধাতুতে বিনিয়োগ করার কিছু সুবিধাও রয়েছে। এগুলো হলো—
মূল্য হ্রাসের ঝুঁকি কম
অর্থনীতির মন্দা বা রাজনৈতিক অস্থিরতায়ও স্বর্ণের দাম সাধারণত বাড়ে, কমে না।
তারল্য
জরুরি প্রয়োজনে স্বর্ণ দ্রুত নগদ অর্থে রূপান্তরযোগ্য।
উপহার ও উত্তরাধিকার
স্বর্ণের গহনা প্রজন্ম থেকে প্রজন্মে হস্তান্তর করা যায়, যা ঐতিহ্য ও সম্পদের ধারক।
ফ্যাশন ও বিনিয়োগের সংমিশ্রণ
স্বর্ণের গহনা ব্যবহারও করতে পারেন, আবার বিনিয়োগ হিসেবেও ধরে রাখতে পারেন। তবে বিনিয়োগের উদ্দেশ্যে স্বর্ণ কিনতে হলে অলংকারের চেয়ে বার (Gold Bar) বা কয়েনে বিনিয়োগ বেশি লাভজনক, কারণ এতে মজুরি কম থাকে।
গহনার যত্ন
যে কোনো মূল্যবান সম্পদের মতোই, স্বর্ণের গহনাও যত্নের দাবি রাখে। নিয়মিত পরিষ্কার না করলে স্বর্ণের উজ্জ্বলতা কমে যেতে পারে।
গহনা পরে ঘুমানো, গোসল বা রান্না করা থেকে বিরত থাকুন।
নিয়মিত ব্যবহার করা গহনা সপ্তাহে একবার কুসুম গরম পানিতে হালকা ডিটারজেন্ট দিয়ে পরিষ্কার করতে পারেন।
গহনা দীর্ঘ সময় না পরলে নরম কাপড়ে মুড়িয়ে আলাদা জায়গায় রাখুন।
পারফিউম, মেকআপ গহনার ওপর সরাসরি প্রয়োগ এড়িয়ে চলুন।
স্বর্ণের গহনা কেনার আগে যা যা যাচাই করবেন
হলমার্ক চিহ্ন (BIS)
স্বর্ণের বিশুদ্ধতার সবচেয়ে বড় প্রমাণ হলো হলমার্ক। বাংলাদেশে সাধারণত ২২ ক্যারেট (৯১.৬%) ও ২১ ক্যারেট (৮৭.৫%) স্বর্ণ জনপ্রিয়। হলমার্ক ছাড়া গহনা কেনা একপ্রকার ঝুঁকিপূর্ণ।
রিটার্ন ও এক্সচেঞ্জ পলিসি
ব্র্যান্ডেড দোকান থেকে কিনলে রিটার্ন বা এক্সচেঞ্জ পলিসি সম্পর্কে স্পষ্ট ধারণা নিন।
ওজন ও ডিজাইনের বিবরণ
গহনার ওজন ও মজুরির ভিত্তিতে দাম নির্ধারিত হয়। ডিজাইনের জটিলতা অনুযায়ী মজুরি বাড়তে পারে। সবসময় মজুরি ও ওজন আলাদাভাবে জেনে নিন।
বিল ও সঠিক কাগজপত্র
প্রতিটি কেনাকাটার রসিদ রাখুন।
এটি ভবিষ্যতে পুনঃবিক্রয়ের সময় দরকার হবে।
বিশ্বস্ত ও ব্র্যান্ডেড জুয়েলারি দোকান
নামকরা জুয়েলার্স থেকে স্বর্ণ কেনা নিরাপদ। তারা সাধারণত মান নিয়ন্ত্রণ ও গ্রাহকসেবায় সচেতন।
মন্তব্য করুন