নিরন্তর সংগ্রাম ও উন্নতির পথে এক অদম্য শক্তির নাম নারী। বিশেষ করে গ্রামীণ নারীরা, যারা জীবনযুদ্ধে নানা প্রতিবন্ধকতা পার করে এগিয়ে চলেছেন, তাদের সংগ্রামের গল্প আমাদের সমাজের প্রতিটি স্তরে প্রেরণা জোগায়। তারা শুধু পরিবারের মুখে হাসি ফোটান না, বরং সমাজে একটি শক্তিশালী ভূমিকা পালন করে থাকেন। যারা নিজেদের দুঃখ-কষ্টের পরেও সব ধরনের বাধা অতিক্রম করে নিজেদের সাফল্যের গল্প লেখেন, তারা শুধু তাদের পরিবারের নয়, বরং পুরো সমাজের জন্য একটি আশার প্রদীপ হয়ে ওঠেন।
খাদিজা পারভীন খুশি
স্বপ্নের স্যানিটারি ন্যাপকিন
কুড়িগ্রামের প্রত্যন্ত এক গ্রামের মেয়ে খাদিজা পারভীন খুশি। দুই বোন, এক ভাইয়ের মধ্যে তিনি মেজো। ছোটবেলা কেটেছে দাদির আদরে, বাবা-মায়ের স্নেহে। দুরন্ত শৈশবের পর, এইচএসসি পেরিয়ে তার বিয়ে হয় মো. মাহবুব মিলনের সঙ্গে। মিলন পেশায় ডিশ ব্যবসায়ী। তবে বিয়ের পরও থেমে থাকেননি খুশি। পরিবারের সহযোগিতায় তিনি স্নাতকোত্তর সম্পন্ন করেন, সেই পথচলায় এক কন্যাসন্তানেরও জন্ম দেন।
ছোটবেলা থেকেই স্বাবলম্বী হওয়ার স্বপ্ন ছিল তার। সে স্বপ্ন বাস্তবায়নের জন্য স্বামীর সঙ্গে পরামর্শ করে চাকরি খোঁজা শুরু করেন। এরপর যোগ দেন ব্র্যাকের একটি এনজিওতে, যেখানে তিনি স্যানিটারি ন্যাপকিন এন্টারপ্রাইজ সেক্টরে কাজ করেন। ১০ বছর নিষ্ঠার সঙ্গে দায়িত্ব পালনের পর, ২০১৯ সালে হঠাৎ বন্ধ হয়ে যায় প্রতিষ্ঠানটি। তিনি ভেবেছিলেন, হয়তো এটি আবার চালু হবে, কিন্তু সময়ের সঙ্গে বুঝতে পারেন যে ফেরার পথ নেই। তখনই সিদ্ধান্ত নেন নিজের কিছু একটা করার।
নিজের অভিজ্ঞতা কাজে লাগিয়ে স্যানিটারি ন্যাপকিনের ব্যবসা শুরু করার পরিকল্পনা করেন খুশি। স্বামীর সঙ্গে পরামর্শ করে স্থানীয় সরকার বিভাগের ‘স্বপ্ন ভূকল্প’ প্রকল্পের সহায়তা নেন এবং সাবেক জেলা প্রশাসক রেজাউল করিমের সহযোগিতায় একটি উদ্যোগ গ্রহণ করেন। গ্রামের দরিদ্র নারীদের সঙ্গে নিয়ে একটি সমিতি গঠন করেন, যেখানে সদস্যদের জন্য সঞ্চয় ও শেয়ার ব্যবস্থার সুযোগ রাখা হয়। আস্তে আস্তে যখন সমিতির তহবিল গড়ে ওঠে, তখন তারা সবাই মিলে স্বল্পমূল্যে ব্যবসাটি দাঁড় করানোর পরিকল্পনা করেন।
কিন্তু উদ্যোগ নেওয়া যতটা সহজ ছিল, বাস্তবে এটি বাস্তবায়ন করা ছিল চ্যালেঞ্জিং। বিশেষ করে, একজন নারী হয়ে স্যানিটারি ন্যাপকিনের মতো একটি স্পর্শকাতর বিষয় নিয়ে কাজ করায় সমাজের অনেকের কাছ থেকেই বাধার সম্মুখীন হতে হয়েছে তাকে।
পণ্য বাজারজাত করতে গিয়ে নানা অবজ্ঞা সহ্য করতে হয়েছে খুশিকে। অনেক দোকানদার তার পণ্য নিতে চাননি, নারীরা মুখ ফিরিয়ে নিয়েছেন আর পুরুষরা কটূক্তি করতে দ্বিধা করেননি। একপর্যায়ে তাকে জীবননাশের হুমকিও দেওয়া হয়। কিন্তু হাল ছাড়েননি তিনি।
মাত্র দেড় লাখ টাকা মূলধন নিয়ে শুরু করা ‘কল্যাণী স্যানিটারি ন্যাপকিন’ আজ মূলধন ২০ লাখেরও বেশি। সিলেটের বন্যার সময়ও তিনি সেখানে তার পণ্য পাঠিয়েছেন, যাতে দুর্গত নারীরা প্রয়োজনীয় স্যানিটারি সুবিধা পায়।
শুরুতে নানা প্রতিবন্ধকতা থাকলেও আজ খুশি আত্মবিশ্বাসী। তার স্বপ্ন, দেশের প্রতিটি দরিদ্র নারী যেন সাশ্রয়ী মূল্যে স্যানিটারি ন্যাপকিন ব্যবহার করতে পারে। শুধু ব্যবসা নয়, তিনি চান এ নিয়ে সচেতনতা বাড়াতে।
শিক্ষক সর্বানী সাহা
শিক্ষার আলো ছড়িয়ে দেওয়া এক যোদ্ধা
সর্বানী সাহা—একজন সংগ্রামী নারী, একজন মমতাময়ী মা, একজন দায়িত্বশীল স্ত্রী এবং একজন নিবেদিতপ্রাণ শিক্ষক। তিন বোন ও এক ভাইয়ের মধ্যে তিনিই সবার বড়। শৈশব থেকেই তার স্বপ্ন ছিল উচ্চশিক্ষা নিয়ে ভালো একটি চাকরি করা, বাবা-মায়ের দায়িত্ব নেওয়া এবং পরিবারের পাশে দাঁড়ানো। স্বপ্নপূরণের লক্ষ্যে তিনি এগিয়ে যান, তবে পথটা কখনোই সহজ ছিল না।
ভাঙ্গা কেএম কলেজ থেকে বিএ পাস করেন ১৯৯৫ সালে। পড়াশোনার পাশাপাশি জীবিকার প্রয়োজনে বেশ কয়েক বছর একটি কিন্ডারগার্টেন স্কুলে শিক্ষকতা করেন। এরপর ১৯৯৯ সালে বিয়ের বন্ধনে আবদ্ধ হন। কিন্তু বিয়ে মানেই কি দায়িত্বের বেড়াজালে স্বপ্নকে বিসর্জন দেওয়া? সর্বানী তা মানতে রাজি ছিলেন না। তাই বিয়ের পরও শিক্ষকতার পেশায় নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করতে সংগ্রাম চালিয়ে যান।
বিয়ের পর তিনি শরীফাবাদ হাই স্কুল অ্যান্ড কলেজে শিক্ষকতা শুরু করেন। তবে এ চাকরি পেতে তাকে অসংখ্য প্রতিকূলতার সম্মুখীন হতে হয়েছে। শিক্ষক নিবন্ধন পরীক্ষায় টানা তিনবার প্রথম হলেও নারী হওয়ায় এবং রাজনৈতিক চক্রান্তের কারণে তিনি চাকরির সুযোগ থেকে বঞ্চিত হন। কিন্তু হাল ছাড়েননি। চতুর্থবার পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে অবশেষে স্বল্প বেতনে হলেও স্বপ্নের শিক্ষকতা পেশায় যুক্ত হতে পেরেছিলেন।
পরিবার থেকে কোনো সমর্থন পাননি, না বাবার বাড়ি থেকে, না শ্বশুরবাড়ি থেকে। তবে পাশে ছিলেন তার স্বামী। সর্বানী বলেন, স্বামী যদি পাশে না থাকতেন, তবে হয়তো আমি এতদূর আসতে পারতাম না। সংসার সামলানো, সন্তান মানুষ করা, চাকরির লড়াই চালিয়ে যাওয়া—সবই কঠিন হয়ে যেত।
আজ সর্বানী সাহার সংসারে এক ছেলে ও দুই মেয়ে। ছেলে শিক্ষাজীবন শেষ করে নিজের পায়ে দাঁড়িয়েছে, দুই মেয়েকে এখনো পড়াচ্ছেন। তবে সংগ্রাম এখনো শেষ হয়নি। স্বামী অসুস্থ, সংসারের পুরো দায়িত্ব তার কাঁধে।
শ্যামবাজারের শেফালী বেগম
সবজির ঝুড়িতে জীবনের গল্প
পৃথিবীটা সবার জন্য সমান সুন্দর নয়। কারও জন্য জীবন সহজ, কারও জন্য কঠিন। কেউ জন্ম থেকেই সবকিছু পেয়ে যায়, আবার কেউ জীবনের প্রতিটি মুহূর্তে সংগ্রাম করে বেঁচে থাকে। তবুও কিছু মানুষ থাকে, যারা দুঃখ-কষ্ট, পরিশ্রম আর অদম্য ইচ্ছাশক্তি দিয়ে নিজেদের জীবনকে সুন্দর করে নেয়। ঠিক এমনই এক সাহসী নারী শেফালী বেগম। জীবনযুদ্ধে হার না মানা এই নারী পুরান ঢাকার শ্যামবাজারে সবজি বিক্রি করেন, যেখানে শতাধিক পুরুষ বিক্রেতার ভিড়ে তিনি যেন এক অনন্য দৃষ্টান্ত।
শেফালীর বয়স এখন প্রায় চল্লিশের কোঠায়। স্বামী-সন্তানহীন এই নারী আট বছর ধরে শ্যামবাজারে সবজি বিক্রি করছেন। প্রতিদিন ভোরে ঘুম থেকে উঠে বাজারের আনাচে-কানাচে ঘুরে বাছাই করা টাটকা সবজি এনে প্লাস্টিকের বস্তার ওপর সাজিয়ে বসেন। মুলা, বেগুন, বরবটি, লাউ, ঢ্যাঁড়শ, মিষ্টি কুমড়া, চিচিঙ্গা, শিম, ফুলকপি, গাজর, আলু, টমেটো ও ধনেপাতার রঙিন সমারোহে তার ছোট্ট দোকানটি যেন জীবনের নতুন গল্প বলে। তবে এ দোকানের পেছনে লুকিয়ে আছে এক বেদনাময় অতীত, যা শেফালীর জীবনকে কষ্টের এক কঠিন পাঠশালা বানিয়ে তুলেছে।
শেফালীর জন্ম এক দরিদ্র পরিবারে। সংসারে অভাব ছিল নিত্যসঙ্গী। মাত্র ১৪ বছর বয়সে বাবা-মা তার বিয়ে দিয়ে দেন এক দিনমজুরের সঙ্গে। শুরুতে সংসার ভালোই চলছিল। কিন্তু কয়েক বছরের মধ্যেই জীবনের কঠিন বাস্তবতা এসে ধাক্কা দেয় তার কপালে। শেফালী লক্ষ করেন, তার শরীরের বিভিন্ন জায়গায় সাদা দাগ দেখা দিচ্ছে, যা দ্রুত ছড়িয়ে পড়ছে। পরে জানা যায়, এটি শ্বেতী রোগ। কিন্তু আমাদের সমাজে এখনো অনেকেই এই রোগকে নেতিবাচকভাবে দেখে। শেফালীর স্বামীও ব্যতিক্রম ছিলেন না। বরং রোগ ধরা পড়ার পর থেকে শেফালীর প্রতি তার আচরণ পাল্টে যেতে থাকে।
শেফালী তার ছোট্ট মেয়েকে নিয়ে বাবার বাড়িতে আশ্রয় নেন। কিন্তু বৃদ্ধ বাবা ছাড়া সেখানে কেউ ছিল না আর বাবার পক্ষেও মেয়ের পুরো দায়িত্ব নেওয়া সম্ভব ছিল না। তাই বাধ্য হয়ে তিনি কাজের সন্ধানে নামেন। প্রথমে অন্যের বাড়িতে গৃহকর্মীর কাজ নেন, তারপর ইসলামপুরের একটি পোশাক কারখানায় শ্রমিক হিসেবে কাজ শুরু করেন। সেখানে প্রায় ছয় বছর কাজ করে নিজের এবং মেয়ের খরচ চালান। কষ্ট হলেও তিনি মেয়েকে স্কুলে পাঠিয়েছেন, ভালোভাবে বড় করার চেষ্টা করেছেন। একসময় মেয়েকে বিয়ে দেন আর তখনই নতুন এক সংকট সামনে আসে—নিজের জীবিকা। তিনি শ্যামবাজারে এসে দেখেন, এখানে অনেকেই সবজি বিক্রি করছে। কিন্তু বেশিরভাগই পুরুষ। সমাজের বাধা উপেক্ষা করে তিনিও এ ব্যবসায় নামার সিদ্ধান্ত নেন। হাতে ছিল সামান্য কিছু টাকা। সেই টাকা দিয়ে কয়েক ধরনের সবজি কিনে প্লাস্টিকের বস্তার ওপর বসে বিক্রি শুরু করেন। শুরুতে মানুষ অবাক হয়ে তাকাত, অনেকেই কটু কথা বলত। কিন্তু শেফালী জানতেন, তার বাঁচতে হবে, তাই তিনি দমে যাননি।
আজ আট বছর ধরে তিনি প্রতিদিন ভোরবেলা ঘুম থেকে উঠে বাজারে আসেন, সবজি কিনে সাজিয়ে বসেন। তার দোকানে সবসময় টাটকা সবজি পাওয়া যায়, তাই ক্রেতার অভাব হয় না। এখন আর তাকে অভুক্ত থাকতে হয় না, কারও দয়া-দাক্ষিণ্যের অপেক্ষায় বসে থাকতে হয় না। নিজের পরিশ্রমে জীবিকা নির্বাহ করতে পারছেন, এটাই তার কাছে সবচেয়ে বড় প্রাপ্তি।
ফিরুজা আক্তার
রিকশার হ্যান্ডেলে নারীর হাত
রাজধানীর ব্যস্ত রাস্তায় যখন হাজারো যানবাহনের ভিড়, তারই মধ্যে এক অসম লড়াই চালিয়ে যাচ্ছেন এক নারী—ফিরুজা আক্তার। জীবনের কঠিন বাস্তবতা তাকে বাধ্য করেছে সমাজের প্রচলিত নিয়ম ভেঙে রিকশাচালকের পেশা গ্রহণ করতে। পুরান ঢাকার সরু রাস্তাগুলোতে প্রতিদিন সকাল থেকে রাত অবধি রিকশা চালিয়ে জীবিকা নির্বাহ করেন তিনি। সমাজের প্রচলিত ধারণা অনুযায়ী, যানবাহন চালানো পুরুষদের কাজ। কিন্তু বেঁচে থাকার লড়াইয়ে তিনি এ বাধাকে উপেক্ষা করেছেন, প্রমাণ করেছেন যে কঠোর পরিশ্রমে নারী-পুরুষের ভেদাভেদ নেই।
কেরানীগঞ্জের খলিফাগড়ে একা বসবাস করেন ফিরুজা আক্তার। একসময় ছিলেন স্বামী-সংসার নিয়ে ব্যস্ত, কিন্তু ভাগ্যের নিষ্ঠুর পরিহাসে প্রায় ১৮ বছর আগে স্বামী মারা গেলে বদলে যায় তার জীবন। পরিবারে তখন একমাত্র সম্বল ছিল তার ছোট মেয়ে। স্বামীর মৃত্যু যেন তার জীবনের সবকিছু ওলটপালট করে দেয়। আর্থিক অনটন চরমে পৌঁছায় আর সেই সংকট সামাল দিতে তিনি নেমে পড়েন কঠোর পরিশ্রমের পথে।
প্রথমে গৃহপরিচারিকার কাজ করতেন, যখন যা কাজ পেতেন তাই করতেন। কিন্তু এসব কাজ করে যে আয় হতো, তা দিয়ে সংসার চালানো কঠিন হয়ে পড়ে। চার বছর আগে এক নতুন সিদ্ধান্ত নেন—রিকশা চালাবেন! একজন নারীর জন্য এ পেশায় আসা সহজ নয়, তবুও বেঁচে থাকার জন্য বাধ্য হন। রিকশা কেনার সামর্থ্য ছিল না, তাই ভাড়ায় রিকশা চালানো শুরু করেন। এখনো প্রতিদিন ৫০০ টাকা ভাড়া দিয়ে রিকশা চালান। যেদিন আয় কম হয়, সেদিন খালি পেটে থাকতে হয়। তবু হাল ছাড়েননি, লড়ে যাচ্ছেন প্রতিদিন।
নারী হিসেবে রিকশা চালানো নিয়ে তাকে অনেক বাধার মুখে পড়তে হয়েছে। অনেকেই বাঁকা কথা বলে, কটূক্তি করে। ফিরুজা আক্তার বলেন, ‘নারী হয়ে রিকশা চালানো সমাজ মেনে নেয় না। রাস্তায় চলতে গেলে মানুষ নানা কথা বলে, হাসাহাসি করে। আত্মীয়স্বজনের কাছ থেকেও কোনো সাহায্য পাইনি। কিন্তু কারও কথায় কান দিলে তো জীবন চলবে না। আমি জানি, আমাকে টিকে থাকতে হবে, তাই এসব উপেক্ষা করেই পথ চলছি।’
মন্তব্য করুন