বিদ্বেষ থেকে এনবিআরকে বিলুপ্ত করে দুই ভাগ করা হলে জাতির জন্য ভয়ংকর পরিস্থিতি তৈরি হবে বলে সতর্ক করার পরদিন সংস্থাটির সংস্কার বিষয়ক পরামর্শক কমিটি বিলুপ্ত করেছে সরকার।
রোববার (২৮ সেপ্টেম্বর) অভ্যন্তরীণ সম্পদ বিভাগ এক প্রজ্ঞাপনের মাধ্যমে এ কমিটির কার্যক্রমের সমাপ্ত ঘোষণা করে। তার আগে গত শনিবার জাতীয় রাজস্ব বোর্ড-এনবিআরকে দুই ভাগ করে রাজস্ব নীতি ও রাজস্ব ব্যবস্থাপনা বিভাগ করার অধ্যাদেশে পরামর্শক কমিটির সুপারিশ ঠিকঠাক প্রতিফলিত হয়নি বলে মন্তব্য আসে এ কমিটিরই একজন সদস্যের তরফে।
পরামর্শক কমিটির সদস্য ফরিদ উদ্দিন বলেছেন, অধ্যাদেশটি বাতিলের দাবিতে এনবিআর কর্মীরা আন্দোলনে নামার ফলে এখন যদি বিদ্বেষ থেকে সংস্থাটিকে দুই ভাগ করা হয়, তাহলে তা জাতির জন্য ভয়ংকর পরিস্থিতি তৈরি করবে। রাজধানীর গুলশানে এনবিআর সংস্কার বিষয়ক এক রাউন্ড টেবিল আলোচনায় তিনি এ পর্যবেক্ষণ তুলে ধরেন।
ফরিদ উদ্দিন বলেন, রাজস্ব নীতি ও রাজস্ব ব্যবস্থাপনা নামে ভাগ করার বিষয়টা এখানে (সংস্কার প্রতিবেদন) আমরা এনেছি। আমরা কমিটি থেকে যে সুপারিশ করেছি, আসলে সেভাবে বিষয়টা, আমি ব্যক্তিগতভাবে মনে করি, সেভাবে হয় নাই। আমি কিন্তু সরকারকে বলেছি, আমার দৃষ্টিভঙ্গি থেকে, যদি ভুল হয়, এটা কোনো বিদ্বেষ থেকে বা যদি ভুল করে করা হয়, তাহলে এটা জাতির জন্য ভয়ংকর অবস্থা, পরিস্থিতি হবে।
এ বক্তব্যের পরদিন অভ্যন্তরীণ সম্পদ বিভাগের জারি করা প্রজ্ঞাপনে বলা হয়েছে, রাজস্ব নীতি ও রাজস্ব ব্যবস্থাপনা কার্যক্রম পৃথকীকরণের লক্ষ্যে রাজস্ব নীতি ও রাজস্ব ব্যবস্থাপনা অধ্যাদেশ, ২০২৫ জারি করায় এনবিআর সংস্কার বিষয়ক পরামর্শক কমিটির কার্যক্রম সমাপ্ত করা হল। তবে গতবছরের অক্টোবরে গঠিত এ কমিটির মূল কাজ এনবিআর পৃথক করা ছিল না। রাজস্ব নীতি ও ব্যবস্থাপনা পৃথকের সুপারিশ তারা করলেও অধ্যাদেশ যেভাবে হয়েছে তা তাদের সুপারিশ মতে হয়নি বলেই তাদের ভাষ্য।
পাঁচ সদস্যের এ কমিটি গঠনের সময় বলা হয়, কমিটি এনবিআরের সংস্কার প্রস্তাবের পাশাপাশি রাজস্ব নীতি সংস্কার বিষয়ে পরামর্শ দেবে। এছাড়া রাজস্ব প্রশাসন সংস্কার, রাজস্ব বোর্ডের প্রাতিষ্ঠানিক সক্ষমতার মূল্যায়ন ও আধুনিকায়ন, শুদ্ধাচার ও সুশাসনের প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামো ও নীতিমালা প্রণয়ন, নাগরিক যোগাযোগ এবং অংশীজন সম্পৃক্ততার কার্যক্রম এবং রাজস্ব সংস্কার সংশ্লিষ্ট যে কোনো নীতিগত পরামর্শ ও সুপারিশ দেবে কমিটি।
গত ১২ মে রাতে এনবিআর বিলুপ্ত করে রাজস্ব নীতি ও রাজস্ব ব্যবস্থাপনা অধ্যাদেশ, ২০২৫ জারি করে সরকার। পরের দিন থেকে আন্দোলনে নামেন দেশের প্রধান রাজস্ব আহরণকারী সংস্থাটির কর্মীরা। অবস্থান, কলমবিরতিসহ কর্মবিরতির মতো টানা কর্মসূচি পালন করেন তারা। তাদের দাবি ছিল, প্রতিষ্ঠানটির শীর্ষ পদে প্রশাসন ক্যাডার থেকে আসা সচিবদের যেন না বসানো হয়। এর পরিবর্তে বিসিএস (কর) ও বিসিএস (শুল্ক ও আবগারি) ক্যাডারের অভিজ্ঞদেরকেই যেন নিয়োগ দেওয়া হয়। তাদের দাবির মুখে অধ্যাদেশ বাস্তবায়ন থেকে সরে আসে সরকার। তখন সরকারের তরফে সংশোধনের প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়।
সরকার বলেছে, এনবিআরকে বিলুপ্ত করে রাজস্ব নীতি ও রাজস্ব ব্যবস্থাপনা বিভাগ নামে যে দুই ভাগ করা হচ্ছে, সেগুলোর শীর্ষ পদে সংশ্লিষ্ট বিষয়ে অভিজ্ঞ সরকারি কর্মচারীদের দায়িত্ব দেওয়ার বিধান রাখা হচ্ছে সংশোধিত অধ্যাদেশে। এই বিধান রেখে রাজস্ব নীতি ও রাজস্ব ব্যবস্থাপনা (সংশোধন) অধ্যাদেশ, ২০২৫ সংশোধন করে ১১টি পরিবর্তন আনার প্রস্তাব করা হয়েছে।
সংস্কার কমিটির সদস্য ফরিদ উদ্দিন বলেছেন, সরকার যে অধ্যাদেশটা দিয়েছে, তাতে কী বলা আছে, আমি এই শিটে বলেছি। আর কী হওয়া উচিত, তাও আমি কিন্তু এক পাশে দিয়েছি। এই নথিটা আপনাদের পড়া উচিত, এটা নিয়ে আলোচনা করা উচিত। ব্যবসায়ীদের উদ্দেশ করে তিনি বলেন, এখন তো একটা জায়গা আছে (এনবিআরের), কিন্তু এখন যদি ওটা একটা ব্যুরোক্র্যাসি হয়, আর এটা (এনবিআর) যদি আলাদা হয়, তাহলে পরিস্থিতি আপনাদের জন্য আরও ভয়াবহ হবে। কাজেই ভুলটা যেন না হয়, সেজন্য আমি অনুরোধ করি, আপনারা এটা পড়েন। পড়ার পর আপনাদের মতামতটা সরকারকে দেন। বিভিন্ন ফোরামে কিংবা সংবাদমাধ্যমে সবকিছু জানান।
সঠিকভাবে কমিটির সুপারিশ বাস্তবায়ন রাজনৈতিক কমিটমেন্টের ব্যাপার বলে মন্তব্য করেন কমিটির আরেক সদস্য এনবিআরের সাবেক চেয়ারম্যান মোহাম্মদ আব্দুল মজিদ। তিনি বলেন, এটা রাজনৈতিক কমিটমেন্টের ব্যাপার। কারণ হচ্ছে, দেখা গেল যে পরবর্তীকালে আমরা যে পৃথক করেছিলাম, সেটা শোনাও হয়নি। বাতিলও করা হয়নি। ওভাবেই রয়েছে। সেজন্যই ভয় হয়, শুধু আমরা রিপোর্ট দিলাম, একটা অর্ডিন্যান্স জারি হয়ে গেলৃ ফরিদ যেটা বারবার বলছেন। দেখা গেল যে বাস্তবায়নের সময় যদি আবার ওইটা না থাকে, পলিটিক্যাল কমিটমেন্ট’ যদি না থাকে। এনবিআর সংস্কার এখন যেভাবে করা হচ্ছে, তা আসলেই ব্যবসায়ী সমাজ চাচ্ছে কিনা, তা নিয়ে প্রচুর বিভ্রান্তি রয়েছে বলেও মনে করেন কেউ কেউ।
এমসিসিআইয়ের সাবেক সভাপতি নিহাদ কবির বলেন, আরেকটি বিষয় আমরা দেখেছি, তা হলো, আমরা হঠাৎ করে এনবিআরকে আলাদা করা দেখেছি। আমরা দেখেছি যে, বোর্ডটি নিজেই আর থাকবে না। বর্তমান কর্মকর্তারা অর্থ মন্ত্রণালয়ে ন্যস্ত হবেন। এটি কীভাবে কাজ করবে এবং আমরা কি আসলেই এ ধরনের সংস্কার খুঁজছি কিনা, তা নিয়ে আমাদের মনে প্রচুর বিভ্রান্তি রয়েছে।
নিহাদ কবিরের মতো পলিসি এক্সচেঞ্জ বাংলাদেশের চেয়ারম্যান মাশরুর রিয়াজ বলেন, সংস্কারে এ কমিটি চমৎকার ‘ইনেশিয়েটিভ’ ছিল। তারা বিভিন্ন ‘স্টেকহোল্ডার’-এর সঙ্গে আলোচনা করে সুপারিশ দিয়েছে। তবে তাদের সুপারিশ বাস্তবায়নে সরকারের মধ্যে আগ্রহের অভাব দেখা যাচ্ছে। এছাড়া পৃথক যেভাবে করা হচ্ছে, তা সরকারের ‘সঠিক সিদ্ধান্ত’ কি না, সেই প্রশ্ন তোলেন তিনি। মাশরুর রিয়াজের মতে, এই পৃথকীকরণ কার্যকরী না হলে তখন দুই বিভাগেই ঝামেলা হবে।
মন্তব্য করুন