

বগুড়ার পুত্রবধূ তিনবারের সাবেক প্রধানমন্ত্রী ও বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়ার প্রয়াণে গভীর শোকে আচ্ছন্ন হয়ে আছে তার স্মৃতিবিজড়িত নিজ জেলা বগুড়া।
বুধবার (৩১ ডিসেম্বর) বিকেলে ঢাকার মানিক মিয়া অ্যাভিনিউয়ে বেগম খালেদা জিয়ার জানাজা শেষ হওয়ার পরপরই বগুড়া শহরের আলতাফুন্নেছা খেলার মাঠে এক অভূতপূর্ব দৃশ্যের অবতারণা হয়। কোনো পূর্ব ঘোষণা বা মাইকিং ছাড়াই কেবল শোকাতুর মনের টানে একে একে সাধারণ মানুষ মাঠে জড়ো হতে শুরু করেন।
মুহূর্তের মধ্যেই কানায় কানায় পূর্ণ হয়ে ওঠে বিশাল এ খেলার মাঠ। প্রিয় নেত্রীর অনুপস্থিতিতে তার আত্মার মাগফিরাত কামনায় সেখানে এক বিশাল গায়েবানা জানাজা অনুষ্ঠিত হয়।
গায়েবানা জানাজায় ইমামতি করেন আলতাফুন্নেছা খেলার মাঠ সংলগ্ন বাইতুল হাফিজ জামে মসজিদের ইমাম হাফেজ মাওলানা মো. আব্দুল আজিজ। কোনো আনুষ্ঠানিক প্রচার না থাকলেও স্বতঃস্ফূর্তভাবে কয়েক হাজার মানুষের এ অংশগ্রহণ ছিল চোখে পড়ার মতো।
এদিকে শহরের কেন্দ্রস্থল সাতমাথা থেকে শুরু করে বড়গোলা, নিউ মার্কেট ও রানার প্লাজা হকার্স মার্কেট এলাকা ঘুরে দেখা যায় সব প্রতিষ্ঠান বন্ধ। প্রিয় নেত্রীর প্রতি শ্রদ্ধা জানাতে ও রাষ্ট্রীয় শোকের প্রতি সংহতি প্রকাশ করে সকাল থেকেই জেলা শহরের ফুটপাথ থেকে শুরু করে বড় বড় শপিংমল বিপণিবিতানসহ ছোট-বড় সব ধরনের দোকানপাট ও ব্যবসা প্রতিষ্ঠান মার্কেট বন্ধ রেখেছেন ব্যবসায়ীরা। এক দিকে সাধারণ ছুটি, অন্যদিকে প্রিয় ছেলের বউ হারানোর বেদনা— সব মিলিয়ে বগুড়ার জনপদ কার্যত স্থবির হয়ে পড়ে।
খালেদা জিয়া দেশের সংকটে পথপ্রদর্শক ছিলেন উল্লেখ করে জেলা বিএনপির সভাপতি রেজাউল করিম বাদশা বলেন, ‘বগুড়াবাসী সবচেয়ে বেশি কাছে পেয়েছিলেন বেগম খালেদা জিয়াকে। তিনি আবার বগুড়ায় আসবেন, সেই অপেক্ষায় ছিলাম আমরা। শত নির্যাতন সহ্য করেও তিনি গণতন্ত্রের জন্য লড়াই করে গেছেন। তিনি সব সময় দেশের মানুষের চিন্তা করতেন, কীভাবে মানুষের ভালো হয়। তিনি পরিবার, ঘর ছাড়া হলেও কখনো জনগণকে ছাড়েননি, জনগণও তাকে ছাড়েনি। তার মৃত্যুতে শুধু বগুড়া নয়, গোটা দেশ অভিভাবক হারিয়েছেন।’
তিনি বলেন, প্রিয় নেত্রী চিরনিদ্রায় শায়িত হবেন তার স্বামীর পাশে। বগুড়া থেকে অগণিত মানুষ সেই ঐতিহাসিক মুহূর্তের সাক্ষী হতে ঢাকায় আছেন।
জেলা বিএনপির ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদক মোশারফ হোসেন জানান, সাবেক প্রধানমন্ত্রী ও বিএনপির চেয়ারপার্সন খালেদা জিয়া বলেছিলেন, সুস্থ হলে আবার বগুড়ায় আসবেন। এবার হাসপাতালে ভর্তি হওয়ার কিছুদিন আগে রাজধানীর গুলশানে নিজস্ব বাসভবনে বগুড়ার নেতাদের সঙ্গে এটাই ছিল তার শেষ কথা। বেশ অসুস্থ থাকার পরও সেদিন দলীয় নেতাদের সঙ্গে কথা বলেছিলেন তিনি। কিন্তু সেই আসা হলো না আর। তার মৃত্যুতে স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে বাকরুদ্ধ হয়ে পড়ছেন বগুড়ার নেতাকর্মীরা। সেই স্মৃতিতে মুহ্যমান বগুড়ার নেতাকর্মীরা।
সরেজমিনে দেখা গেছে, শহরের কেন্দ্রস্থল সাতমাথা থেকে শুরু করে বড়গোলা, নিউ মার্কেট, রানার প্লাজা ও হকার্স মার্কেট এলাকা ঘুরে দেখা যায় সব প্রতিষ্ঠানের ঝাঁপ নামানো। বড় বিপণিবিতান থেকে শুরু করে পাড়ার মুদি দোকানটিও আজ খোলেননি ব্যবসায়ীরা।
নিউ মার্কেট এলাকার ব্যবসায়ী আকবর হোসেন বলেন, বেগম জিয়া আমাদের বগুড়ার মানুষের কাছে নেত্রীর চেয়েও বড় পরিচয়ে ছিলেন, তিনি আমাদের ঘরের মানুষ। আজ তার জানাজা ঢাকায়, কিন্তু আমাদের মন পড়ে আছে সেখানে। তার প্রতি সম্মান জানাতেই আমরা আজ দোকান বন্ধ রাখার সিদ্ধান্ত নিয়েছি।
শহরের রানার প্লাজা এলাকার ব্যবসায়ী আব্দুল করিম বলেন, বগুড়া থেকে তিনি বারবার নির্বাচন করেছেন, আমরা তাকে ভোট দিয়েছি। তিনি আমাদের গর্ব ছিলেন। আজ এমন শোকের দিনে ব্যবসা করার মতো মানসিকতা নেই।
তরুণ ব্যবসায়ী সালমান সাদিক, ক্ষুদে ব্যবসায়ী আলম মিয়া বলেন, খালেদা জিয়ার আকস্মিক মৃত্যুতে তারা বাকরুদ্ধ। দেশের স্বার্থের তার আরও কিছুদিন বেঁচে থাকা জরুরি ছিল। তারা (স্থানীয়রা) আশা করেছিলেন, আগামী নির্বাচনে বিএনপি ক্ষমতায় এলে তার হাত ধরে বগুড়ায় আবারও উন্নয়ন হতো। এই জেলার সব উন্নয়নের সঙ্গেই তিনি জড়িত। তাই তাকে ঘিরে স্থানীয়দের আবেগও বেশি। সব মিলিয়ে এক থমথমে ও বিষণ্ন পরিস্থিতির মধ্য দিয়ে প্রিয় নেত্রীকে বিদায় জানাচ্ছে বগুড়াবাসী।
পুরো জেলায় বিভিন্ন মসজিদ ও মাদ্রাসায় কোরআন খতম ও বিশেষ দোয়ার আয়োজন করা হয়েছে।
শোকের প্রকাশ হিসেবে শহরের নবাববাড়ী সড়কে অবস্থিত জেলা বিএনপির কার্যালয়ে বুধবার (৩১ ডিসেম্বর) কালো পতাকা উত্তোলন করা হয়।
বিএনপির নেতারা জানান, বগুড়ার সঙ্গে খালেদা জিয়ার সম্পর্ক দেশের অন্যান্য অঞ্চলের চেয়ে বেশি ছিল। নেতাকর্মীদের সঙ্গে যেমন হৃদ্যতা ছিল, সাধারণ মানুষের কাছেও ছিলেন প্রিয় নেত্রী। তাই তার মৃত্যুর খবরে দলের নেতাকর্মীসহ শোকে ভেঙে পড়েছেন সাধারণ মানুষ। তার জানাজায় অংশ নিয়ে বগুড়ার বিপুল নেতাকর্মী সাধারণ মানুষ রাজধানীতে ঢাকায় গেছেন।
সকালে শহরের জেলা বিএনপির কার্যালয় গিয়ে দেখা গেছে, সকাল থেকেই কার্যালয়ে আসা শুরু করেছেন নেতাকর্মীরা। কালো ব্যাচ ধারণ করেছেন তারা। শোক বইয়ে স্বাক্ষর করছেন। খালেদা জিয়ার প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে কার্যালয়ের পাশে নবাববাড়ী সড়কে সব ধরনের দোকান বন্ধ রেখেছেন ব্যবসায়ীরা।
এদিকে খালেদা জিয়ার রুহের মাগফিরাত কামনায় বগুড়ায় দোয়া মাহফিল করেছে জেলা বিএনপি। বাদ জোহর শহরের বায়তুর রহমান সেন্ট্রাল মসজিদে এ মাহফিল হয়। এতে খালেদা জিয়ার আত্মার মাগফিরাত কামনাসহ জিয়া পরিবারের জন্য দোয়া করা হয়েছে।
এদিকে বগুড়ার গাবতলীতে বিএনপি চেয়ারপারসন ও তিনবারের সাবেক প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়ার গায়েবানা জানাজা অনুষ্ঠিত হয়েছে।
বুধবার (৩১ ডিসেম্বর) দুপুরে বাদ জোহর গাবতলী পাইলট উচ্চ বিদ্যালয় মাঠে এ গায়েবানা জানাজা অনুষ্ঠিত হয়। জানাজায় ইমামতি করেন গাবতলী কেন্দ্রীয় জামে মসজিদের সাবেক পেশ ইমাম হাফেজ আব্দুল মান্নান।
জানাজায় বিভিন্ন মসজিদ থেকে আগত হাজারো মুসল্লিসহ বিএনপি ও অঙ্গ-সহযোগী সংগঠনের নেতাকর্মী, স্থানীয় রাজনৈতিক ও সামাজিক সংগঠনের প্রতিনিধি এবং সাধারণ মানুষ অংশ নেন। জানাজা শেষে বেগম খালেদা জিয়ার রুহের মাগফিরাত কামনায় বিশেষ দোয়া ও মোনাজাত করা হয়।
এদিকে, গাবতলী উপজেলার বিভিন্ন এলাকায় পৃথকভাবে আরও নয়টি স্থানে বেগম খালেদা জিয়ার গায়েবানা জানাজা অনুষ্ঠিত হয়।
খালেদা জিয়ার মৃত্যুতে গভীর শোকের ছায়া নেমে এসেছে গাবতলীতে। শহীদ রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের স্ত্রী ও গাবতলীর পুত্রবধূ হিসেবে পরিচিত এ জনপ্রিয় নেত্রীর প্রয়াণে বুধবার পুরো উপজেলা যেন স্তব্ধ হয়ে পড়ে।
মন্তব্য করুন