বাংলা বর্ষপঞ্জির হিসেবে পৌষ মাসের শেষে শীত মৌসুমের বার্ষিক উৎসবকে ‘সাকরাইন উৎসব’ নামে পালন করা হয় রাজধানীর পুরান ঢাকায়। বিপুল উৎসাহ ও উদ্দীপনার মধ্য দিয়ে ছোট-বড় সবাই মেতে ওঠেন এ উৎসবে। এ বছর ১৪ জানুয়ারি পালিত হবে অন্যতম ঐতিহ্যবাহী এই উৎসব। এই উৎসবকে কেন্দ্র করে এ বছর শাঁখারীবাজার, তাঁতীবাজার ও চকবাজারে ঘুড়ি-লাটাইয়ের চাহিদা বেড়েছে।
সাকরাইন উৎসবকে কেন্দ্র করে শাঁখারীবাজারে ঘুড়ি বিক্রির ধুম পড়েছে। ঘুড়ি তৈরির কারখানা থেকে প্রতিদিনই হাজার-হাজার পিস ঘুড়ি আসছে শাখাঁরীবাজারের দোকানগুলোতে। দক্ষ কারিগরদের সুনিপুণ হাতে তৈরি এসব ঘুড়ি শাঁখারীবাজার থেকে ছড়িয়ে পড়ছে পুরান ঢাকার অলি-গলির কিশোরদের হাতে। ডিসেম্বর মাস থেকেই পুরান ঢাকার আকাশে উড়তে শুরু করেছে এসব ঘুড়ি।
সরেজমিনে শাঁখারীবাজারে দেখা যায়, বাজারের অধিকাংশ দোকানগুলোতেই রয়েছে ঘুড়ি, লাটাই ও সুতা। বিক্রেতারা সকাল থেকে বিকেল অব্দি ঘুড়ি, লাটাই ও সুতা বিক্রিতে ব্যস্ত সময় পার করছেন। সাকরাইনকে কেন্দ্র করে শাখাঁরীবাজারের দোকানগুলোর সামনে ফুটপাতের রাস্তায়ও বসেছে অনেক ভ্রাম্যমাণ ঘুড়ি, লাটাই ও সুতার দোকান।
এ সময় ১৫-৬০ বছর তরুণ-প্রবীণদের দেখা যায়, ঘুড়ি, লাটাই, সুতা কিনতে। এদের মধ্যে সবাই নিজের জন্য ঘুড়ি বা লাটাই কিনতে এসেছেন তা কিন্তু নয়, অনেক বাবা তার সন্তানের জন্য এমনকি দাদারা এসেছেন তার নাতি-পুতিদের জন্য লাটাই ও ঘুড়ি কিনতে।
চকবাজার থেকে ঘুড়ি কিনতে আসা আসিল (১৬) জানান, প্রতি বছরের মতো এবারও সাকরাইন উৎসবকে ঘিরে পুরান ঢাকার কিশোররা এখন থেকেই ঘুড়ি, লাটাই ও ধারাল সুতো সংগ্রহ করতে শুরু করেছে। তাই আমিও কিছু ঘুড়ি কিনতে এসেছি। কিন্তু এ বছর ঘুড়ির দাম একটু বেশি চাচ্ছে তবুও ১০টা ঘুড়ি নিলাম ১০০ টাকা দিয়ে, যা গতবার আমি ৮০ টাকা দিয়ে কিনেছি।
যাত্রাবাড়ী থেকে শাঁখারীবাজার ঘুড়ি ও লাটাই কিনতে আসা মেহেদী বলেন, আর কয়েক দিন পর সাকরাইন। ওই দিন পুরান ঢাকায় আমরা যারা থাকি তারা পরিবার-বন্ধুবান্ধব, আত্মীয়স্বজন মিলে একসাথে ভালো খাবার খাই, ঘুড়ি উড়াই, বাসার ছাঁদে সন্ধ্যায় গান-বাজনা করি। আমার ছেলে ছোট ওর জন্য একটা লাটাই ও পাঁচটা রকমের ঘুড়ি কিনলাম। কিন্তু গত বারের তুলনায় এবার ঘুড়ি ও লাটাইয়ের দাম বেশি নিল।
আরেকজন ক্রেতা তাঁতীবাজার এলাকার বাসিন্দা শুভ জানান, অনেক আগে থেকেই সাকরাইন একটি ঐতিহ্যবাহী উৎসব। সবাই আনন্দ উল্লাস করে, তাই আমরা সবার সাথে আনন্দ করার জন্য ঘুরি কিনে নিয়ে যাচ্ছি। বন্ধুরা মিলে বাসার ছাদে আজকে বিকেল থেকেই ঘুড়ি উড়াবো। তাই বাঁশের লাটাই তিনশ টাকা দিয়ে নিলাম সাথে দুইশ টাকা দিয়ে ১৫টা ঘুড়ি কিনলাম বিভিন্ন রকমের। ৮ টাকা থেকে শুরু করে ৫০ বা ৬০ কিংবা দেড়-দুইশ টাকায়ও ঘুড়ি বিক্রি হচ্ছে। বিভিন্ন ধরনের নাটাই যেমন বাঁশের ও স্টিলের নাটাই বিক্রি হচ্ছে। ছোট নাটাইগুলো বিক্রি হচ্ছে ১৫০ থেকে ১৬০ টাকা, মাঝারি ধরনের নাটাইগুলো বিক্রি হচ্ছে ২০০ থেকে ২৫০ টাকা। বড় নাটাই গুলো বিক্রি হচ্ছে ৩০০ থেকে ৭০০ টাকা।
ঘুড়ি বিক্রি প্রসঙ্গে মাতাশ্রী বিপণিবিতানের দোকানি চয়ন সুর(১৯) বলেন, করোনার পর দুই-তিন দফায় কাগজের দাম বেড়েছে, তার সাথে এখন কারিগরদের ও বেশি পারিশ্রমিক দিতে হয় তাই প্রতিটি ঘুড়ি প্রতি দুই থেকে তিন টাকা বেড়েছে। এতে করে সাকরাইন উপলক্ষে বিক্রিতে কোন প্রভাব পরেনি বরং গত দুদিন ধরে ঘুড়ি ও লাটাই কিনতে আসা কাস্টমারের চাপে হিমশিম খেতে হচ্ছে।
শাঁখারীবাজারের গলির ফুটপাতে টেবিল পেতে রঙবেরঙের ঘুড়ি উড়ানোর ধারালো সুতো বিক্রি করছেন করুণা রানী সাহা। তিনি বলেন, সাকরাইন উৎসবকে কেন্দ্র করে ঘুড়ি উড়ানোর জন্য প্রয়োজনীয় সুতো বিক্রি করতে বসেছি। পিছনে স্বামীর দোকান আছে সেখানে ঘুড়ি ও ঘুড়ি উড়ানোর জন্য সুতো বিক্রি করতো কিন্তু সাকরাইনের বেঁচাবিক্রির চাপ এত বেশি যে তার ছোট দোকানে একা বেঁচা-বিক্রি করা সম্ভব হচ্ছিল না তাই আমি তাকে সাহায্য করতে টেবিল-চেয়ার নিয়ে দোকানের সামনে সুতা বিক্রি করছি।
ঢাকায় পৌষসংক্রান্তির এই দিনকে বলা হয় সাকরাইন। ঢাকাই ভাষায় ‘হাকরাইন’। আদি ঢাকাই লোকদের পিঠাপুলি খাবার উপলক্ষে আর সাথে ঘুড়ি উড়াবার প্রতিযোগিতার দিন। সাকরাইন একান্তই ঢাকার, যুগের পরিক্রমায় তাদের নিজস্ব উৎসব। এটা বাংলাদেশের কোথাও পালিত হয় না। যা ঢাকার জনপ্রিয় ও দীর্ঘ সাংস্কৃতিক চর্চার ফল। শাঁখারীবাজার, তাঁতীবাজার, গোয়ালনগর, লক্ষ্মীবাজার, সূত্রাপুর, গেণ্ডারিয়া, লালবাগ ও এর আশেপাশের এলাকাগুলোতে বিপুল উৎসাহ ও উদ্দীপনার মধ্যে ছোট, বড় সকলেই মেতে উঠে এ উৎসবে। সাইকরাইনের দিন বিকেল বেলা এই সব এলাকায় আকাশে রঙ বেরঙের ঘুড়ি উড়ে। ছাদে কিংবা রাস্তায় দাঁড়িয়ে ঘুড়ি ওড়ানো হয়। অধিকাংশ সময়ে ভোঁ কাট্টার (ঘুড়ি কাটাকাটি) প্রতিযোগিতা চলে। একজন অপরজনের ঘুড়ির সুতা কাটার কসরত করে।
মন্তব্য করুন