ঢাকা কলেজিয়েট স্কুলের প্রায় দুইশ বছর বয়সী ভবন ভাঙার প্রতিবাদে মানববন্ধন করেছে পুরান ঢাকার ঐতিহ্য নিয়ে কাজ করা সংগঠন আরবান স্টাডি গ্রুপ-ইউএসজি। মানববন্ধনে আরও অংশ নেয়, ইনস্টিটিউট অব আর্কিটেক্টস বাংলাদেশ, ঢাকা কলেজিয়েট স্কুল এলামনাই এসোসিয়েশন- ৭৬ ব্যাচ, সেভ দ্য হেরিটেজ বাংলাদেশের প্রতিনিধিরা।
বৃহস্পতিবার (২১ মার্চ) সকাল সাড়ে ১১টায় ভাঙা ভবনের সামনেই এ কর্মসূচি আয়োজন করা হয়।
গত কয়েক দিন ধরে স্কুল প্রাঙ্গণে অবস্থিত এই ঐতিহ্যবাহী দ্বিতল ভবনটি ভাঙার কাজ চলছিল। এরইমধ্যে ভবনটির দরজা-জানালা, ছাদ ও মেঝের বিভিন্ন জায়গার অংশ ভেঙে ফেলা হয়েছে। স্কুলের এলামনাই এসোসিয়েশনের কয়েকজন সদস্যের একাংশের উদ্যোগে একটি বহুতল ভবন নির্মাণের উদ্দেশে এই ঐতিহ্যবাহী ভবন ধ্বংসের এই কার্যক্রম পরিচালনা করা হচ্ছে।
কর্মসূচির শুরুতে একটি নাতিদীর্ঘ বক্তব্যে ঐতিহাসিক এই ভবনটির গুরত্ব ব্যাখ্যা করে স্থপতি তাইমুর ইসলাম বলেন, এই ভবনটি ঢাকা তথা বেঙ্গল প্রেসিডেন্সির প্রথম সরকারি বিদ্যালয়। প্রায় ২শ বছর পুরাতন ঢাকা কলেজিয়েট স্কুলের প্রথম ভবন না হলেও, স্থাপনাটির ঐতিহাসিক গুরুত্ব অপরিসীম। ঐতিহাসিকগণ ভবনটিকে ব্রিটিশ আমলের ডাক বাংলো হিসেবে চিহ্নিত করেছেন। মতান্তরে পর্তুগিজদের রেস্ট হাউসও বলা হয়। সেই অর্থে ভবনটি আরও প্রাচীন। তবে মূল স্থাপনাটি যে মুঘল আমলে নির্মিত, তাতে সন্দেহের অবকাশ নেই। এই সব নিরিখে ভবনটির Historic & Evidential Value-এর কারণে ঐতিহ্যবাহী স্থাপনা হিসেবে গুরুত্ব অপরিসীম।
তিনি জানান, ২০১৮ আরবান স্টাডি গ্রুগের দায়ের করা রিটের প্রেক্ষিতে হাইকোর্টের রায়ে আরবান স্টাডি গ্রুপ প্রণীত ঢাকা মহানগরীর ঐতিহ্যবাহী স্থাপনার ২ হাজার ২০০ ভবনে কোনোরকম ধ্বংস বা পরিবর্তন এর ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হয়েছে। এমতাবস্থায় এই ভবনটি ধ্বংসের এই কার্যক্রম অবশ্যই আদালত আবমাননার শামিল।
সকল সচেতন নাগরিকের পক্ষে উক্ত ঐতিহ্যবাহী স্থাপনা রক্ষায় উপস্থিত সেভ দ্য হেরিটেজের সদস্য ওয়ালিউল হক বলেন, খড়খড়ি, জানালা, চুন সুরকির তৈরি পুরোনো যে ভবনগুল রয়েছে সাক্ষী হিসেবে তা আগামী প্রজন্মের জন্য রক্ষা করা অতি আবশ্যক।
ইন্সটিউট অব আর্কিটেক্টস বাংলাদেশ থেকে সম্পাদক (ঐতিহ্য ও সংস্কৃতি ) স্থপতি জিয়াউল উল শরিফ বলেন, এই ভবনটি ঝুঁকিপূর্ণ অজুহাতে ভেঙে ফেলার যে যুক্তি দেখান হচ্ছে তা কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য নয়। বর্তমান প্রযুক্তি ব্যবহার করে ভবনটিকে অতি সহজেই রেট্রফিটিং ও স্রেন্দেনিং পর adaptive reuse এর মাধ্যমে নতুন ভবন নির্মাণের পাশাপাশি সংরক্ষণ করা সম্ভব।
তিনি পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের উদাহরণ টেনে বলেন, এখনও হাজার বছরের রোমানদের স্থাপনা সংরক্ষণ করা হচ্ছে। সকল মহলের ঐতিহ্য সংরক্ষণের ক্ষেত্রে উদ্যোগ নেওয়া প্রয়োজন।
স্বাধীনতা পূর্ব কালের ছাত্র ছিলেন মেসবাউল। ভবনটির সামনে তার সহপাঠীদের সঙ্গে দাঁড়িয়ে পুরোনো দিনের স্মৃতিতে আপ্লুত হয়ে তিনি বলেন, এই প্রাণের স্কুলে হাতুড়ির আঘাত যেন সরাসরি বুকে আঘাত লাগছে। এই ভবনে তারা এক সময় ক্লাসও করেছেন। আজকে ভবনটিকে নির্মমভাবে ধ্বংস করে ফেলেটা তারা কোনোভাবেই মেনে নিতে পারছেন না। তারা আশা করেন স্কুল কর্তৃপক্ষ এবং সরকার শেষ পর্যন্ত ভবনটি রক্ষা করার জন্য উদ্যোগ গ্রহণ করবেন।
পুরান ঢাকার স্থানীয় হেলাল উদ্দিন বলেন, এই ভবনটির পাশাপাশি পুরান ঢাকার সকল ঐতিহ্যবাহী স্থাপনা সংরক্ষণ করার দাবি জানাচ্ছি। তিনি গেন্ডারিয়া স্কুলের কথা উল্লেখ করে বলেন, দীর্ঘদিন আন্দোলন করার পরেও সরকারের কাছ থেকে কোনো সুনির্দিষ্ট সিদ্ধান্ত না পাওয়ার ফলে ভবনটি ঈদের পরে ভেঙে ফেলার সম্ভাবনা দেখা দিয়েছে। এ বিষয়ে সকলের সহযোগিতা কামনা করেন তিনি।
স্থপতি সামিরা ইসলাম বলেন, স্কুলের ছাত্রছাত্রীরা যেখানে লেখাপড়ার পাশাপাশি নিজেদের সাংস্কৃতিকভাবে সমৃদ্ধ করবে সেখানে সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের এমন একটি গুরুত্বপূর্ণ নিদর্শন রাষ্ট্রের প্রচলিত আইনের ও আদালতের রায় অবজ্ঞা করে ভেঙে ফেলার বিষয়টি নিঃসন্দেহে কোমলমতি শিশুদের মনে একটি অত্যন্ত নেতিবাচক প্রভাব ফেলবে।
মানববন্ধন শেষে স্কুলের প্রধান শিক্ষকের সঙ্গে উপস্থিত আরবান স্টাডি গ্রুপ, ইনস্টিউট অব আর্কিটেক্টস বাংলাদেশ, সেভ দ্য হেরিটেজের প্রতিনিধিগণ সাক্ষাৎ করে হাইকোর্টের রায়ের কপি হস্তান্তর করে ভবনটি ভাঙা তাৎক্ষণিক বন্ধের জন্য দাবি জানানো হয়। সেই প্রেক্ষিতে তিনি সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের অনুমতি সাপেক্ষে কাজ বন্ধ রাখার বিষয়ে নির্দেশ প্রদান করেন।
সর্বশেষে আরবান স্টাডি গ্রুপের পক্ষ থেকে আদালত অবমাননার অভিযোগে আগামী রোববার উচ্চ আদালতে একটি আবেদন দাখিল করা হবে বলে জানান তারা।
মন্তব্য করুন